ডা: ফয়েজ ভাইকে আজো মনে পড়ে
- নূরুন্নাহার নীরু
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বলা যায় ১৪ হাত দূর থেকেও যার কণ্ঠ শোনা যেত স্পষ্ট হাস্যোজ্জ্বল ও রসিকতায় ভরা গমগম শব্দে, তিনি আমাদের শহীদ ডা: ফয়েজ ভাই। ফয়েজ ভাইয়ের কথা মনে হলেই হাসি-খুশি-উচ্ছ্বল, প্রাণচঞ্চল এক ব্যক্তির কথাই মনে পড়বে সবার আগে। সে ব্যক্তিটি আজ নেই আমাদের মধ্যে। অথচ সীমিত এ জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে রেখে গেছেন কত স্মৃতি! শহীদ ডা: ফয়েজ আহমদ আমার মামাতো ননদের স্বামী। আমার ননদ মার্জিয়া আমার স্বামী ডা: আব্দুল জলিলের একমাত্র মামার ছোট মেয়ে। ওরা দুই বোন, চার ভাই। বলাই বাহুল্য, এক দিকে ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, অন্য দিকে ছাত্রীজীবন থেকেই ডা: জলিলের সাহচর্যে এগিয়ে আসা তার এ প্রিয় বোনটি আজ মহিলা অঙ্গনের একজন পুরোধা ত্যাগী মনীষা।
পরিবারের সবার কাছে মার্জিয়া (রেশমা) হচ্ছে ভীষণ স্নেহের। বিয়ের পর আমার বড় জা ডা: সাজেদ আব্দুল খালেকের আম্মা রওশন আরা এবং মেঝ জা ডা: আব্দুল মুকিতের মা ফরহাদ বানুর কাছে সারাক্ষণ যার গল্প শুনে শুনে আমি অভিভূত হতাম সেই মার্জিয়া, ভাবীদের কাছে আপনের চেয়েও আপন যেন আরো একটি ননদ। আর আমার তো শুধু ননদই নয়; সহপাঠী, সহযাত্রীও বটে।
শহীদ ডা: ফয়েজ ভাই যখন শেরপুরে নিজ শ্বশুরালয়ে আসতেন তখন প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমাদের শহরের বাসায় না এলে যেন বেড়ানোই পূর্ণ হতো না! নিজের গাড়ি নিয়ে সপরিবারে তাদের আগমন প্রতীক্ষায় আমরাও অধীর হয়ে থাকতাম প্রতি বছর। হইচই করে সবাইকে আপন করে নিতে যার ভালো লাগত সেই আমাদের ফয়েজ ভাই আমাকে যাতে কোনো ব্যতিব্যস্ত না হতে হয় (তার দৃষ্টিতে) তাই কোনোরূপ সুযোগ না রেখেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে জানাতেন; ‘ভাবী আসছি’। গেটে না ঢুকতেই চিৎকার করে বলতেন, ‘ভাবী চা, চিনি ছাড়া’। ভেতরে এসে যখন দেখতেন ততক্ষণে সাজানো টেবিল আমার সাধ্যমতো জলখাবারে, ভীষণ অভিভূত হয়ে যেতেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সে ভাব ব্যক্ত করতেন। খাবার খেতেন বেছে বেছে পরিমিত কিন্তু মজাচ্ছলে গর্ব করে বলতেন, ‘দেইখছনি! আঙ্গো দেশী মাইয়্যা দেহি এত সুন্দর করি, কত অল্প সময়ে কত কিছু কইচ্ছে।’ আমার হৃদয় ভরে যেত তার সরল অভিব্যক্তিতে। আমার স্বল্পভাষী ননদটার মুচকি হাসি হাসতে, এটাই ছিল ওনার মজা! আমার ছেলেমেয়েরা ভীষণ মজা পেত ফুফার মুখে ভিন্ন অঞ্চলের ভাষা শুনে। ওদের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি।
একবার দুলাভাইয়ের অসুস্থতায় ফোন করে খবর নিচ্ছিলাম। তিনি নিজের খবর বাদ রেখে তার প্রিয় ভাই, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সঙ্গী, এককাতারের রাহবার যেন আত্মার আত্মীয় তার জলিল ভাইয়ের খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এর কিছু দিন আগেই ডা: জলিলেরও ব্রেইনস্ট্রোক করেছিল। তার ওপর মুহাজির হিসেবে ঢাকায় অবস্থানরত। আমি চাকরির কারণে একাকী শেরপুর। প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী শহীদ ডা: ফয়েজ ভাই এত বড় মাপের মানুষ হয়েও স্বীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করতেন না। সর্বদা কাবলি ড্রেসে পাঞ্জাবিদের মতো দেখতে মানুষটিকে মনে হতো তারুণ্যের উচ্ছ্বল প্রতীক। তার পেশা, পরিবার, সংগঠন, আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ববোধ, কর্তব্যস্পৃহা, আন্তরিকতা, উদারতা তার প্রতি যে কারো শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে যাওয়ার মতো একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। যে মানুষটি একবার তার সাথে পরিচিত হয়েছেন তিনিও তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারতেন না। এসব জেনেছি আমার সে অঞ্চলের আত্মীয় পরিচিতদের কাছ থেকেও। আমার স্বামী নিজ পরিবারের এমন একজন সদস্যকে হারিয়ে এখনো প্রায়ই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। বেদনাবিধুর হয়ে পড়েন প্রিয় ছোট বোনটির জন্যও। তার হৃদয় বিগলিত কষ্ট আমি অনুভব করি যখন মনে হয় ‘আমার ননদটা একা হয়ে গেল! আমাদের স্নেহের বান্না, বেলাল, সালেহা, উজমা এতিম! ওদের কচিকচি শিশুগুলো এমন একজন নানা-দাদার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত! ওরা বড় হবে, জানবে সে করুণ কাহিনী, শুনবে সে লোমহর্ষক ঘটনা।
মার্জিয়ার মুখ থেকেই জানলাম যেভাবে দুলাভাইকে টেনে হিঁচড়ে তিনতলার ছাদে তুলে নিয়ে গুলি করে ওপর থেকে নিচে ফেলে দেয় এবং মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় গুলি চালায়। জোৎস্নার আলোয় দোতলা থেকেই দেখছিল ওরা সেই ঝলমল শহীদের লাশ। সে রাতে যখন সেই পেটুয়া র্যা ব বাহিনীর নেতৃত্বে ওদের নিচতলার গেট, গ্রিল, অফিস ভাঙচুর হচ্ছিল, ওপরে উঠে আসছিল উন্মত্ত সারমেয়রা! তখন দুলাভাই তৈরি হচ্ছিলেন শান্ত-ধীর-স্থিরভাবে। বিশ্বাস ছিল ওরা বড়জোর ওনাকে থানায় নিয়ে যাবে। তিনি ঘরের পোশাক পাল্টে ঝকঝকে পরিপাটি পোশাক পরেন, সাথে ওষুধ নেন, এমনকি ইনসুলিনটি নিতেও ভোলেননি। মার্জিয়া ও নববিবাহিতা ছোট ছেলের বউকে নিজের দুই পার্শ্বে বসিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে প্রয়োজনীয় ওছিয়ত করেন। ক্ষমাও চেয়ে নেন শেষবারের মতো। কী অদ্ভুত! ভাবতেই অবাক লাগে। আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাটিকে এভাবেই তৈরি করে নিয়ে নিচ্ছিলেন। এর চেয়ে উত্তম প্রস্থান আর কি হতে পারে!
উপস্থিত আত্মীয়স্বজন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রুচোখে বিদায় নিচ্ছিলেন। এমনি কান্না দেশে-বিদেশে আরো যে কত অন্তরে বয়ে গেছে সেদিন, বয়ে যাচ্ছে এখনো! ঠিক সেই কাছাকাছি সময়েই বিশিষ্ট সাংবাদিক শেরপুরের কামারুজ্জামান ভাইও শহীদী মর্যাদা লাভ করে তাদের দলে ভিড়েছিলেন।
অথচ কী অপরাধ ছিল ওনাদের? সন্ত্রাস করেছে? গুম হত্যা? ডাকাতি ছিনতাই? খুন রাহাজানি? ধর্ষণ! না কি কালোবাজারি, নারী পাচারকারী, যৌতুকলিপ্সা?
মন বলছে, তারা এখন কুরআনের কথামতো সবুজ পাখি হয়ে বেহেশতের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতায় অবগাহন করে আফসোস করছেন আর হাসছেন পার্থিব মোহে আচ্ছন্ন থাকা দাম্ভিক, অত্যাচারী, অন্যায়কারীদের আস্ফালন দেখে। তাদের জন্যই যেন আল কুরআন বলছে- ‘আর এ ব্যক্তিকে বলে দেয়া হলো, দাখিল হও জান্নাতে। সে বলল হায়! আমার জাতি যদি জানতে পারত আমার রব কোন জিনিসের বিনিময়ে আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করেছেন!’ (সূরা ইয়াসিন : ২৫-২৭) সত্যিই আফসোস! এরা কি পড়ে না আল কুরআন?
শাহাদতের অমীয় সুধা পান করার জন্য ব্যাকুল হৃদয়ী ডা: শহীদ ফয়েজ ভাই তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমার রব যখন চান এবং যেখানে চান আমাকে সেখানে সেভাবে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। তাহলে আমি আমার মালিকের কাছে শাহাদত লাভের প্রার্থনা করব না কেন? কেন আমি শাহাদতের সেই মহান মর্যাদার অধিকারী হওয়ার ইচ্ছা করব না?’ কি গভীর অভিব্যক্তি! এ বক্তব্যটি শুনলে কার না ইচ্ছে হবে মহান সেই শাহাদতের পথেই ধাবিত হতে! নানান রোগে আক্রান্ত মানুষটি বিছানায় পড়েই তো মৃত্যুমুখে যেতে পারতেন কিন্তু মহান আল্লাহ তার চরম আকাক্সক্ষা এভাবেই পূর্ণ করে দিলেন! হায়! আমিও যদি অমন মৃত্যুই লাভ করতে পারতাম! পার্থিব দৃষ্টিতে এ মৃত্যু যতই কষ্টকর, হৃদয় বিদারক হোক না কেন সান্ত্বনা ওখানেই যে, তিনি তো এখন বেহেশতের সবুজ পাখি!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা