২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিস্ময়কর অজন্তা চিত্রের রচনাশৈলী

-


অজন্তা শিল্পীরা চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে যেসব ধারা অনুসরণ করেছেন তা যে শুধু ঐতিহ্য কিংবা অলঙ্করণের প্রয়োজনে করেছেন এমনটি মনে করা হয় না। মনে করা হয় তাদের এই ধারা অনুসরণের পেছনে গূঢ়রহস্য কিংবা মরমিবাদের চিন্তা কাজ করেছে বলে মনে করা হয়

ভারতের মহারাষ্ট্রের খান্দেশ জেলায় ইন্দ্র্যদি পর্বতের উপত্যকায় অগভীর গুহা রয়েছে। পর্বতের নিকটবর্তী গ্রাম অজন্তার নামানুসারে এই গুহাসমূহের নামকরণ করা হয়েছে ‘অজন্তা গুহা’। এই নামেই দেশ-বিদেশে নাম ছড়িয়ে পড়েছে। অজন্তাসংলগ্ন ওয়াঘোড়া নদী অশ্বখুরাকৃতি বাঁক নিয়েছে। পাহাড় বা পর্বতের অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাদদেশে গুহাগুলোর অবস্থান। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- কঠিন পাথরের বিশাল পাহাড় কেটে গুহাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের সামনে থেকে পাথর কেটে কেটে পাহাড়ের গভীরে প্রবেশ করে ৩০টি গুহা নির্মাণ করা হয়েছে। গভীর অরণ্য পরিবেষ্টিত আলোহীন অবস্থায় সুন্দর কক্ষগুলো কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তা সত্যি এক রহস্যের বিষয়। রহস্যে ঘেরা এই কক্ষ বা গুহাগুলোতে আলোহীন অবস্থায় কিভাবে রঙ ও রেখার সাহায্যে অপূর্ব সুন্দর চিত্র আঁকা সম্ভব হয়েছে তা সত্যিই এক বিস্ময়কর ঘটনা। অনেকের ধারণা কৃত্রিমভাবে আলোর ব্যবস্থা করেই চিত্রগুলো আঁকা হয়েছে। এখানে নির্মিত ৩০টি গুহার মোট দৈর্ঘ্য ৬০০ গজ। গুহাগুলোতে যে ছাদ রয়েছে তার উচ্চতা কোনো কোনোটির ৩৫ ফুট। আবার কোনো কোনোটির উচ্চতা ১০০ ফুট। গুহার দেয়ালগুলো মসৃণ করে বিশেষ পদ্ধতিতে তার ওপর আস্তর লাগিয়ে তবেই চিত্র আঁকা হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় যে, অজান্তার চিত্র ফ্রেস্কো সেক্কো বা শুকনো পদ্ধতিতে আঁকা। ফ্রেস্কো সেক্কো হচ্ছে- শুকনো ক্ষেত্রে বা আস্তরের ওপর আঁকা চিত্র। এই পদ্ধতিতেতে দেয়ালচিত্র আঁকতে হলে প্রথমে কাদা, গোবর, পাথর চূর্ণ এবং কখনো কখনো তুষ মিশিয়ে দেয়াল গাত্রে আস্তর প্রস্তুত করতে হয়। আস্তর ৮ ভাগের ১ ইঞ্চি থেকে ৪ ভাগের ১ ভাগ ইঞ্চি পর্যন্ত পুরু হতে পারে। পরে এই আস্তরের ওপর ঝিনুক বা শামুকের চুনের পাতলা প্রলেপ দিতে হয়। চুনের আস্তর লাগাবার পর আস্তর শুকিয়ে গেলে তার ওপর গেরিমাটি বা ইন্ডিয়া রেড দ্বারা সমগ্র চিত্রের বহিঃরেখা এঁকে তার ওপর অন্য আর এক রঙের হালকা শেড দিতে হয়। অনেকসময় আস্তর হিসেবে পুরা ফিগারে সবুজ রঙও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অজন্তার কোনো কোনো ফিগারে এভাবে রঙ ব্যবহার করা হয়েছে বলে অশোক মিত্রের ‘ছবি কাকে বলে’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। রঙ ব্যবহারের রীতি হচ্ছে প্রথমে নরম বা হালকা সবুজে পুরো শরীর রঙ করা, এরপর তার ওপর গোলাপি রঙের প্রলেপ দেয়া। এরূপ প্রয়োগ কৌশলের কারণে স্নিগ্ধ অথচ স্বচ্ছ একপ্রকার ধূসর রঙ পাওয়া যায়। এ ছাড়া লাল, কালো, ব্রাউন প্রভৃতি রঙ প্রয়োজনমাফিক চিত্রে প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে শুকনো আস্তরের ওপর ছবি আঁক শেষ হওয়ার সাথে সাথে পানির ছিটা দিতে হয়। যতক্ষণ না সম্পূর্ণরূপে ভিজে যায়। এভাবে ভেজালে একপর্যায়ে রঙ, চুন ও প্লাস্টার একসাথে শুকিয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। এভাবে আঁকা রঙিন চিত্র দেয়ালে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

অজন্তার অঙ্কিত গুহায় চিত্র ছাড়া কিছু কিছু মূর্তিও রয়েছে। বিষয় হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের জীবনী এবং জাতিকের কাহিনী। গুহার চিত্র এবং ভাস্কর্যের বিষয়ের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গুহাগুলোর নির্মাণকাজ শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের দশ বছর পূর্বে থেকে। এরপর প্রায় ৮০০ কিংবা ৯০০ বছর ধরে চলে গুহার কাজ। যে ৩০টি গুহা নির্মাণ করা হয়েছে তার মধ্যে পাঁচটি উপাসনা গৃহ বা চৈতি হল। এগুলো হলো- ৯, ১০, ১৯, ২৬, ২৯। ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ এবং ৩০ নম্বর গুহাগুলো নির্মিত হয়েছে হীনমান বৌদ্ধ যুগে। এর মধ্যে ১৩ নম্বর গুহায় পাওয়া যায় সবেচেয় প্রাচীন চিত্রগুলো। উল্লিখিত গুহাগুলো ছাড়া বাদ বাকি গুহা নির্মিত হয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে। এসব গুহায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা শ্রমণগণ ধর্মালোচনা, আরাধনা এবং শিল্পচর্চা করতেন। প্রকৃতির এই রম্যনিকেতনকে শুধু ধর্মের স্থান কিংবা শিল্প নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবেই যে বেছে নিয়েছিলেন তারা এমন নয়। তারা এটাকে বিশ্রামের স্থান হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোনো একসময় অজ্ঞাত কারণে তাদের সৃষ্ট এবং শিল্পসম্ভারে সমৃদ্ধ প্রকৃতির এই রম্যনিকেতন ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যান তারা। এরপর হাজার বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকে শিল্পমনস্ক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সৃষ্ট বিস্ময়কর এই রম্যনিকেতন। অর্থাৎ অজন্তাগুহামালা। সম্রাট আওরঙ্গজেব বহুকাল অজন্তার কাছে বসবাস করেছেন; কিন্তু কোনোভাবেই জানতে পারেননি এই পরিত্যক্ত স্বর্ণোজ্জ্বল শিল্পসম্ভারে সমৃদ্ধ অজন্তানামক এই গুহাগুলোর কথা। ইংরেজ আমলে অবিশ্বাস্য কর্মযজ্ঞের ফসল অজন্তার এই গুহাগুলো সাধারণের দৃষ্টিসীমায় আসে। ১৮১৯ (কেউ কেউ ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দ উল্লেখ করেছেন) খ্রিষ্টাব্দে একদল ইংরেজ সৈন্য অজন্তা গুহার কাছে শিবির স্থাপন করে। তথায় থাকাকালীন সময় অজন্তা স্থাপত্য তাদের নজরে আসে। ফলে তাদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে গুহায় প্রবেশ করে এবং অপূর্ব সুন্দর চিত্রগুলো দেখে বিস্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে তারা অজন্তার কথা জনসমক্ষে প্রচার করে। কিন্তু তাদের এই আবিষ্কারের বিষয়টিকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে প্রায় ১০ বছর পর একদল লোক ইংরেজদের আবিষ্কারের বিষয়টি যাচাই করার উদ্দেশ্যে অজন্তায় গমন করে। তারা গুহাগুলো পরিদর্শন করেন এবং তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়টি প্রকাশ করেন।

এর পরেও এ বিষয়ে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি। এরপর শিল্পবিষয়ক পণ্ডিত ফার্গুসেন এ বিষয়ে উৎসাহ দেখান। তিনি অজন্তায় গমন করেন এবং গুহাগুলো পরিদর্শন করেন। গুহা পরিদর্শন শেষে তার অভিজ্ঞতার কথা রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপাত্র একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি পড়ার পর শাসকদের পক্ষ থেকে বাবার্টগিল নামে এক শিল্পীকে অজন্তা গুহার চিত্রগুলোর অনুলিপি প্রস্তুত করে দেখাতে বলেন। শিল্পী রবার্ট গিল অজন্তায় প্রায় ২০ বছর অবস্থান করে অজন্তা চিত্রের অনুলিপি প্রস্তুত করেন। অঙ্কিত অনুলিপিগুলো পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু ক্রিস্টাল প্যালেস প্রদর্শনীতে আগুন লেগে ২৫টি চিত্র পুড়ে বিনষ্ট হয় বলে জানা যায়।
অজন্ত গুহার শিল্পকর্ম আবিষ্কারের প্রথমপর্যায়ে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় একশ্রেণীর দর্শকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশী-বিদেশী দর্শকদের কেউ কেউ দেয়ালে অঙ্কিত চিত্রের ওপর নিজেদের নাম খোদাই করেছে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রেখা টেনে চিত্রের ক্ষতি সাধন করেছে। ইংরেজ কর্মচারীদের কেউ কেউ ছবিসহ দেয়ালের আস্তর খুলে নিয়ে গেছে। এরূপ ১ ফুট আস্তরের ছবি, ইংল্যান্ডে নিলামে বিক্রি করেছে ১০০০ পাউন্ডে। চিত্রটি বর্তমানে আমেরিকার বোস্টন জাদুঘরে রক্ষিত আছে।

দুর্ঘটনা ঘটার পর অর্থাৎ চিত্রগুলো আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর একপর্যায়ে বোম্বে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ জর্জ গ্রিফিতা অনুলিপি প্রস্তুত করবার উদ্দেশ্যে অজন্তায় গমন করেন। সাথে তার কিছু ছাত্রকেও নিয়ে যান। তারা প্রায় ১৩ বছর (১৮৭২-১৮৮৫) কাজ করে ৩৩৫টি চিত্রের অনুলিপি করতে সক্ষম হন। ১, ২, ৬, ৯, ১০, ১১, ১৬, ১৭, ১৯, ২১ এবং ২২নং গুহার চিত্রের অনুলিপি ছিল এগুলো। অন্বিত এসব চিত্র কেমসিল্টন চিত্রশালায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু এবারো ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। অগ্নিকাণ্ডে অধিকাংশ চিত্রই বিনষ্ট হয়ে যায়। রক্ষা পায় মাত্র ৫৬ খানা চিত্র। এর পরেও অনেকেই অজন্তার চিত্র অনুকরণ করেছেন। লেডি হেরিংহ্যামের উদ্যোগে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অজন্তা চিত্রের নকল বা অনুলিপি প্রস্তুত করা হয়। প্রস্তুতকৃত এসব চিত্র তিনি লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটিকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক শিল্পীও অজন্তা চিত্রের অনুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন। শিল্পীদের মধ্যে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, মুকুল দে, সমরেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অজন্তা গুহা আবিষ্কারের পর বেশ কিছুদিন অরক্ষিত থাকায় নানাজন নানাভাবে দেয়ালের চিত্র বিনষ্ট করেছে। অনেকে দেয়ালের প্লাস্টার খুলে নিতেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তবে একজন যে, কিছুটা নিতে সমর্থ হয়েছে সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে এবং মানুষের দ্বারা বিনষ্ট হওয়ার পর বর্তমানে সেসব গুহায় চিত্রকর্ম টিকে আছে সেগুলো হলো ১, ২, ৯, ১০, ১৬ এবং ১৭ নম্বর গুহা। এসব গুহায় টিকে থাকা চিত্রের বিষয়বস্তুর অধিকাংশই জাতকের কাহিনী। গৌতম বুদ্ধকে তার শিষ্যরা কিংবা ভক্ত বা অনুসারীরা দেবতা হিসেবে পূজা করতে থাকে তার মৃত্যুর পর। শুধু তাই নয় তাকে নিয়ে নানাভাবে কল্পিত কাহিনী রচনা এবং প্রচার করতে থাকে। শিষ্যদের বিশ্বাস গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে বহুবার জন্মগ্রহণ করেছেন। বুদ্ধের এই জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়ই হচ্ছে জাতকের কাহিনী। এসব কাহিনী ও বিষয়ের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধের জীবনী, ধর্মের প্রতীক, প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলি এবং প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান।

অজন্তাচিত্রের রচনাশৈলী
অজন্তাচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে নারীচিত্র অন্যতম। নারীকে নানা ভঙ্গিতে, নানা রূপে আঁকা হয়েছে। এসব চিত্রে নারী মাতারূপে, বাজ্ঞীরূপে, প্রণয়িনীরূপে, নর্তকীরূপে, পূজারিণীরূপে, দাসীরূপে উপস্থিত হয়েছে। এ ছাড়া নানা ধরনের জন্তু-জানোয়ারের ছবিও এসব চিত্রে স্থান পেয়েছে। হাতি, ঘোড়া, হরিণ, ষাঁড়, বানর, হাঁস প্রভৃতি বিষয়ের চিত্রশিল্পীরা নিপুণ হাতে এঁকেছেন। অজন্তাচিত্রের আর এক উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- ছায়াহীনতা। অর্থাৎ অজন্তাচিত্রে ছায়া নেই। ফলে অজন্তাচিত্র দিন কিংবা রাতের কোনো সময়কে প্রকাশ করে না। যেমন, প্রাতঃকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা রাত্রিকাল এসবের কোনো ইঙ্গিও নেই অজন্তাচিত্রে। তবে রেখার জাদুকরী ব্যবহার রয়েছে অজন্তাচিত্রের সর্বত্র। রেখা বলতে চিত্রের ড্রইংকেই বুঝায়। যে ড্রইং ছাড়া চিত্রকে কল্পনাই করা যায় না। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য সর্বত্রই ড্রইংয়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে প্রাচ্যের ড্রইং বা রেখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রাচ্যচিত্রের ড্রইং দুই ধারায় ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটিকে সাধারণ ড্রইং বলা হয়। যেমন, নকশা বা রেখাকৃতি, কিংবা বলা যায় রেখাশ্রিত রূপ। অন্যটি হচ্ছে- সমগ্র প্লাস্টিক উপাদানের সম্মিলিত প্রয়োগের রূপ। এর অর্থ ব্যাপক যা চিত্রের সামগ্রিক ডিজাইনকে রূপ দেয় এবং চিত্রকে নান্দনিক রস বা সৌন্দর্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। অজন্তাচিত্রে এই দুই ধারার ড্রইংয়ের ব্যবহারই লক্ষ করা যায়। যার মাধ্যমে শিল্পীর দক্ষতা এবং সাবলীলতা প্রকাশ পেয়েছে। দুই ধারার রেখাশ্রিত চিত্রে রূপারোপের ক্ষেত্রে অজন্তায় স্পষ্টতই তিনটি ধারা বা স্টাইল লক্ষ করা যায়।

৯ এবং ১০ নম্বর গুহায় লক্ষ করা যায় প্রথম ধারার বা স্টাইলের কাজ। এ গুহা দু’টির চিত্রগুলোর পুনঃসস্কারের কারণে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, অজন্ততার ফ্রেস্কোচিত্রের কাজ শুরু হয়েছে সাঁচি যুগে এবং শেষ হয়েছে গুপ্ত যুগে। ফিলিপ স্টার্ন নামে এক ফরাসি পণ্ডিত অজন্তার স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের প্রমাণাদির ওপর নির্ভর করে ২৯টি গুহার ক্রমধারা বা ক্রমপঞ্জি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই ক্রমপঞ্জি অনুসারে ৯ এবং ১০ নম্বর গুহার চিত্রাবলিকে সবচেয়ে প্রাচীন এবং উন্নতমানের বলে মন্তব্য করা হয়েছে। অজন্তা চিত্রের গৌরবময় যুগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ছয় ছতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কে। ৯ এবং ১০ নম্বর গুহার চিত্রাবলিতে সাঁচি, ভারহুত এবং অমরাবতীর টেকনিক এবং শিল্পনৈপুণ্য পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত বলে মনে করা হয়। উন্নত মানসম্পন্ন এই সময়ের অজন্তাচিত্র ভারতের নানা স্থানের ভাস্কর্যকে অনুধাবন করতে সাহায্য করে।

গুপ্তযুগের ফ্রেস্কোচিত্রগুলো সমগ্র দেয়ালজুড়ে এমনভাবে করা যে একটা থেকে আর একটা বিষয় বা একটি ফিগার থেকে আর একটি বিষয় বা ফিগারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। দেয়ালের ওপর নিচ এবং ডান কক্ষের অংশজুড়ে বিষয়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোথাও শূন্যস্থান নেই। বিষয় এবং ফিগারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে না পারার এটাও একটা কারণ। নরনারী, অট্টালিকা, নগর, পাহাড়, পাথর, গাছপালা, পশুপাখি সমগ্র দেয়ালজুড়ে এমনভাবে গিজ গিজ করছে যে, সেগুলোকে আলাদা বা বিচ্ছিন্নরূপে চিহ্নিত করাই কঠিন। তবে দীর্ঘক্ষণ সেই দেয়ালময় গিজ গিজ করা বিষয়গুলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে ধীরে ধীরে কিছু কিছু বিষয় বা বিষয়ের গ্রুপ দৃষ্টিসীমায় আলাদাভাবে স্পষ্ট হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে চিত্রের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নজর কাড়তে থাকে। এ ধরনের কম্পোজিশনকে বলা হয় ‘প্রতিসাম্যমূলক কম্পোজিশন’। তবে এই কম্পোজিশনকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, বিহার, মঠ, মন্দির সর্বত্রই দেয়ালে এই ধরনের অসংখ্য ভাস্কর্য দেখা যায়। যার সাথে গ্রিক-বৌদ্ধ রীতির মিল আছে বলে মনে করা হয়।
উল্লেখিত সরল পদ্ধতি বা প্রতিসাম্যমূলক কম্পোজিশনের পর দ্বিতীয় পদ্ধতি সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, কোনো দৃশ্যের বিভিন্ন গ্রুপগুলো যেন একত্রে গেঁথে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের রীতি পদ্ধতির নাম ‘যোগসূত্র রচনা বা কনোক্টিং-লিঙ্ক’ কম্পোজিশন। অজন্তাচিত্রে এই যোগসূত্র রচনার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আর এ জন্যই এটাকে অজন্তাচিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যোগসূত্র বা কনোক্টিং কম্পোজিশনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে একই আখ্যান বা কাহিনীর একাধিক দৃশ্য পরপর সাজানো হয় একই দেয়ালের কম্পোজিশনে।

এভাবে সাজানোর মধ্যে কোনো বিরাম চিহ্ন থাকে না। এ ধরনের কম্পোজিশন প্রাচীন ভারতে নিজস্ব বেশিষ্ট্য মনে করা হয়। পূর্বে যে ১০ নং গুহার কথা বলা হয়েছে সেই গুহার চিত্র ধারাতেই এর সূচনা হয়েছে। এসব চিত্রে অর্থাৎ দ্বিতীয় ধারার চিত্রে গান্ধারা চিত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পোশাক পরিচ্ছদে এর প্রভাব স্পষ্ট।
অজন্তা চিত্রে তৃতীয় যে ধারাটি লক্ষ করা যায় তার সাথে পূর্বে আলোচিত দ্বিতীয় ধারার কিছুটা মিল রয়েছে। তবে স্পষ্ট যে অমিল অর্থাৎ তৃতীয় ধারার প্রধান যে বৈশিষ্ট্য তা হচ্ছে চক্রাকার কম্পোজিশন। যেমন ১নং গুহার চিত্র। এ চিত্রে স্পষ্টত দু’টি ভাগ লক্ষ করা যায়। ভাগ দু’টির প্রত্যেকটি দৃশ্যের মধ্যের দিকে অর্থাৎ মধ্যবর্তী কেন্দ্রের চারধারে গোল করে সাজানো। দৃশ্য মঞ্জার এই ধারা অজন্তার বহু চিত্রে লক্ষ করা যায়। যেমন ১নং গুহার আর এক চিত্র ‘মহাজনক জাতক কাহিনী। এ ক্ষেত্রেও দু’টি আলাদা অংশ রয়েছে। এ চিত্রের একটি দৃশ্যে রাজ কুমার রাজকুমারীর সামনে নৃত্য পরিবেশিত হচ্ছে। রাজপরিবারকে ঘিরে রয়েছে একটি গ্রুপ। আর নর্তকী ও বাদকদের নিয়ে হয়েছে আর এক গ্রুপ। এই গ্রুপ দু’টি কেন্দ্রের চারপাশে বৃত্তাকার বা গোলাকারে সাজানো। ২নং গুহার চিত্রেও এ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ দুটো গুহার চিত্রে অন্যান্য গুহার চিত্রের তুলনায় আধুনিকতার ছাপ রয়েছে বলে মনে করা হয়। চিত্র অঙ্কন প্রদ্ধতিতে পারসিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। অঙ্কন রীতিতে কিছুটা হলেও গতানুগতিকতার ছাপ দৃশ্যমান হয়েছে।

অজন্তা শিল্পীরা চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে যেসব ধারা অনুসরণ করেছেন তা যে শুধু ঐতিহ্য কিংবা অলঙ্করণের প্রয়োজনে করেছেন এমনটি মনে করা হয় না। মনে করা হয় তাদের এই ধারা অনুসরণের পেছনে গূঢ়রহস্য কিংবা মরমীবাদের চিন্তা কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। কারণ গোলাকার কম্পোজিশন রচনার ক্ষেত্রে মণ্ডলস্থ গূঢ়তত্ত্বের সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে গভীর তাৎপর্য। এসব মণ্ডলে কিছু সংখ্যক এককেন্দ্রিক বৃত্ত বা প্রকোষ্ঠ থাকে। যার রহস্যময় মধ্যাংশে অবস্থান করেন স্বয়ং ঈশ্বর কিংবা ধ্যানের দেবতা। যেখানে পৌঁছতে ধ্যান ও আরাধনার প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজন হয় মণ্ডলে অধিষ্ঠাত্রী দেবগণ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বা অভিজ্ঞতার। এভাবে স্তরে স্তরে সাজানো মণ্ডল ভেদ করতে পারলে তবেই সঠিক বা ধ্যানীর হয় চরম ব্রহ্মাস্বাদ। হয় ঈশ্বরের সঙ্গে মরমি মিলন। এসব বিষয় অজন্তা চিত্রের ধর্মীয় চেতনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন ২নং গুহার চিত্রসমূহে বৌদ্ধধর্ম ও জাতক কাহিনীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। এসব চিত্রে নানাভাবে ধর্মের বিষয় সংযোজিত হয়েছে। বুদ্ধের নানা ভঙ্গির পাশাপাশি রয়েছে ভিন্ন দৃশ্যও। যেমন আলপনার নকশায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ২৩টি হাঁসের চিত্র। ২নং গুহায় কয়েকটি প্রস্তর নির্মিত মূর্তিও আছে। বুদ্ধদেব, জম্বল, হারিতি, শঙ্কনিধি এগুলোর অন্যতম। ১৭নং গুহার চিত্রেও রয়েছে জাতক কাহিনী। চিত্রগুলোর বেশির ভাগই জাতক কাহিনী সম্মন্ধীয় এবং ধর্মীয় প্রভাব যুক্ত।

অজন্তায় বসবাসরত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উপাসনালয় ছিল ৯নং গুহা। এ গুহাতেও বেশ কিছু চিত্রকর্ম রয়েছে। এগুলো বৌদ্ধধর্মের হীনযান ও মহাযান যুগে অঙ্কিত। এসব চিত্র নিপুণ হাতে এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞতার আলোকেই যে করা হয়েছে তার স্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে চিত্রগুলোতে। স্বাক্ষর রয়েছে চিত্রের বিভিন্ন বিষয়ের ভারসাম্য আনয়নের মধ্যে। ১০নং গুহাকে অজন্তার প্রাচীনতম গুহা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে থাকে। কিন্তু প্রাচীনত্বের কারণেই হয়তোবা এই গুহার বেশি ভাগ চিত্র বিনষ্ট হয়ে গেছে। বাকিগুলোও অস্পষ্টতার কারণে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে গেছে কোনটা কিসের চিত্র। তবে অনুমান করা হয় যে, চিত্রগুলো যাতকের কাহিনী অবলম্বনে চিত্রিত। এ গুহার যেসব চিত্রের নকল বা অনুলিপি করা হয়েছিল সেগুলো দেখে বুঝা যায় যে, দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালে ছিল নাগরাজের শোভাযাত্রার দৃশ্য। অনুমান করা হয় যে, এ গুহার কিছু চিত্র খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে অঙ্কিত। কিছু চিত্র আঁকা হয়েছে মহাযান যুগে। গৌতম বুদ্ধের প্রথম জীবনের কিছু কিছু ঘটনাকে অবলম্বন করেও বেশ কিছু চিত্র আঁকা হয়েছে। আঁকা হয়েছে মুমূর্ষু রাজকুমারী নামের একটি চিত্রও। এই চিত্র দেখে পণ্ডিত গ্রিফিথ সাহেব বলেছিলেন- ‘ফ্লোরেন্টাইন শিল্পীরা হয়তো এর চেয়ে ভালো ড্রইং করতে পারতেন। ভেনিসিয়ানরা হয়তো আরো ভালো রঙ ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তাদের কেউই এত প্রচণ্ড দুঃখের বিষয়কে এত স্ন্দুরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন না (কামাল আহমেদ, শিল্পকলার ইতিহাস, পৃ. ৬৭)। চিত্র দুটি ১৬ নং গুহায় আঁকা হয়েছে।

অজন্তা গুহাচিত্রের বিষয়বস্তুর সার্বিক বিবেচনা তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- একক বা স্বতন্ত্র চিত্র, কাহিনী চিত্র এবং অলঙ্করণ চিত্র। যে চিত্র একটি দৃশ্যেই সম্পন্ন হয়েছে তাকে একক চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব দৃশ্যে নানা কাহিনী রয়েছে সেসব দৃশ্যের সমন্বয়ে সৃষ্ট চিত্রকে বলা হয়েছে কাহিনী চিত্র বা কাহিনী নির্ভর চিত্র। আর নানা ধরনের লতাপাতা ফল সমন্বয়ে অঙ্কিত চিত্র হচ্ছে নকশা চিত্র। অন্তার এসব চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যে পারস্পেকটিভ বা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার করা হয়েছে তা পাশ্চাত্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে একেবারেই ভিন্ন স্বভাবের। অজন্তার শিল্পীরা দৃশ্যমান জগতের বিষয়বস্তুকে সরলীকরণ করেছেন। ঘনবস্তুর গভীরতাকে ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে তারা বস্তুকে সমগ্রভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাদের আপন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন। পেছনের বিষয়কে চোখে দেখা না গেলেও সুকৌশলে চিত্রে তুলে ধরার যে রীতি, তা তাদের দেখার ভিন্নতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তাদের দেখা শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ খুলে খুলে দেখার মতো। এই দেখা একেবারে শাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখার মতো। এ দেখা পাশ্চাত্যের শিল্পীর সৃষ্ট এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দেখার মতো নয়। এ দেখা একই বস্তুর প্ল্যান আর প্রোফাইল দেখার মতো। ফলে চতুর্ভুজ কোন বস্তু, বসার আসন বা সিংহসাসনগুলোর পা গুলিকে উপর দিকে লম্বায় বাড়িয়ে দিয়ে বেশি করে দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। কোন দৃশ্যের পেছন বা পশ্চাদ অস্পষ্ট করার পরিবর্তে উপরের স্তর, মধ্যস্তর, সম্মুখের স্তর এমনিভাবে সাজানো হয়েছে। যাতে করে দর্শক চিত্রের মধ্যে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পান। এই ঘুরে ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতার ফলে পারস্পেকটিভ হয়েছে পাশ্চাত্যের বিপরীতমুখী।
লেখক : চিত্রশিল্পী, সাবেক পরিচালক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরো সংবাদ



premium cement
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে অনুসন্ধান কমিটির নির্দেশ হাইকোর্টের ভারতকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে হাসিনাকে নির্বাচন বিলম্বিত করার শঙ্কা বাড়ছে বিএনপিতে নর্থ মেসিডোনিয়ায় ২০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁড়িয়ে চললেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না : অর্থ উপদেষ্টা মানবসম্পদ উন্নয়নে কাঠামোগত সংস্কার ও জাতীয় উদ্যোগ জরুরি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত ছাড়া সংস্কার কাজে লাগবে না : তারেক অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেয়া হবে : আইন উপদেষ্টা বাতিল কারিকুলামে ৮২৮ কোটি টাকার নিষ্ফল প্রশিক্ষণ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ রোহিঙ্গাবিষয়ক প্রতিনিধি হলেন খলিলুর রহমান সশস্ত্রবাহিনী দিবস কাল

সকল