সংস্কৃতি চর্চা ও নাগরিক জীবনবোধ
- মতিন বৈরাগী
- ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোতে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ধারায়। মুখরোচক কোনো বয়ানে তার ক্লেদকালিমা মোছা যায় না। যে চিন্তায় অন্যের খবরদারি থাকে, প্রকাশে বিধিনিষেধ খড়গ হয়ে ঝোলে, সেখানে মানুষ স্বাধীনতার অর্থটাই পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না
আমাদের মতো আটকে পড়া সমাজ-মানুষ সর্বপ্রথম যে স্বাধীনতা হারিয়েছে তা চিন্তার, চিন্তা গতিহীন নয়। ভাবুকের চিন্তা রুদ্ধ হলে প্রকাশ বিপত্তি ঘটলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং কল্যাণ যা কিছু তা নিশ্চেতনায় আশ্রয় নেয়। যদিও চিন্তার স্বাধীনতা এমন নয় যে ব্যক্তি তার ধ্বংসাত্মক চিন্তাদ্বারা সমাজের রাষ্ট্রের জাতীয় অগ্রগতি শৃঙ্খলার মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় কল্যাণে তার আধুনিক মনোবৃত্তি অর্জনে যে চিন্তা, তা যদি শাসনের মনেবৃত্তির বাইরেও হয় তাকে আটকে দেয়াই হচ্ছে মধ্যযুগীয় শাসকচিন্তার অংশ। প্রকৃত উন্নয়ন মানে জীবনবোধের উন্নয়ন যার প্রসারতা আজ আর প্রথাবদ্ধ নয় বরং অনুসন্ধান ক্রমাগত নানা মতের মধ্যদিয়ে সত্যকে খুঁজে দেখা এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। কিন্তু লক্ষণীয় যে শাসনকর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বিজ্ঞাপনী পদ্ধতি [যার ভিত্তি পুনরাবৃত্তি] যার দ্বারা কর্তৃত্ব স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। ফলে সমাজে নিকৃষ্ট মতামত প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও তাদের বয়ানের ভাষ্যগুলো কিছু স্বার্থ সুযোগ সন্ধানে মাতিয়ে রাখে কিন্তু ক্ষতির অঙ্কটা বেড়ে যায় রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষের। তারা নির্জীব হতে হতে নিঃস্ব হয়। নতুন ভাবনা নতুন চিন্তা নতুন উদ্ভাবন, প্রয়োগ ও বিস্তার, যা আগামীর, তার সাথে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়। বন্দী মানব অস্তিত্ব সত্তা ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা জেনে স্বাধীনতাহীনতায় জীবন কাটিয়ে দেয়। তার বিকাশ নেই, তার বলবৃদ্ধি নেই, তার সজ্ঞা প্রজ্ঞা ও চিন্তার বিস্তার বিস্তৃতি নেই। সে কাটিয়ে দেয় জীবন সমান সময় এক বিভ্রমী ভৌগোলিক স্বাধীনতার কণ্টকময় আংটায় আটককৃত অস্তিত্বহীন সত্তা নিয়ে। তার জীবন সমৃদ্ধিহীন, উচ্চতর মানবতাবোধহীন, ভাবনা ও প্রকাশ থেকে ছিটকে পড়া তন্ত্রের নামে যেন মন্ত্র আবিষ্ট দাস। তন্ত্র সে যেমনই হোক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্র কিংবা অভিজাততন্ত্র বা ধর্মতন্ত্র সব তন্ত্রই একদল শক্তিমান মানুষের স্বাধীনতার সঙ্কুলান করে দেয়- যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিংস্র বিকৃত এবং উলঙ্গ। প্রকৃত স্বাধীনতা মানবজীবনমুখী সুন্দরে সুস্থে বিকাশমুখী, প্রবৃত্তিতে মানবিক, অন্যায় থেকে অসমতা থেকে হৃদাত্মাকে সংহত করে মানুষকে মহৎ উদ্দেশ্যে সংস্থাপিত করে। ভৌগোলিক সীমারেখা যা ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে এবং স্বাধীনতার নামে মানুষের প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষাকে ছায়া বানিয়ে ক্ষমতাবানদের আরাম আয়েশে জৌলুশে মুগ্ধমান হলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমাজে প্রতারণার মতোই তরল।
বেশির ভাগ উন্নয়নগামী দেশে জাতির ভৌগোলিক সীমারেখার স্বাধীনতা এখনো গায়েবি ছায়ার মতো। সে অদ্ভূত এক হাত দিয়ে স্বাধীনতার রূপরস আনন্দের উল্লাস দেখায় আর কিম্ভূতকিমাকার এক জীবনবোধে মানব আত্মাকে সঙ্কুচিত করে ও সীমারেখাধীন গণমানুষকেও সুস্থতার চিন্তা-চেতনাশিকর থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু তবুও প্রকৃত স্বাধীনসত্তা অর্জনে রাষ্ট্র অনিবার্য এবং গণজীবনকে অনেক কিছু থেকে রক্ষা দেয়। যদি দেয় এবং রাষ্ট্রসমাজ যদি ন্যায়ভিত্তিক ন্যায্য মানবিক এবং আদর্শিক হয়, সে ক্ষেত্রে নিচে পড়ে যাওয়া মানুষও তার অন্তর আত্মাকে সুস্থে সুন্দরে সাজাতে পারে। চিন্তার ঐক্য তৈরি করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে তার যোগ্যতা, সম্পদ হয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্রের। মানবিক গুণাবলি বিকাশের মধ্যদিয়ে সে যখন রাষ্ট্র-সম্পদ তখনই ঘটে প্রকৃত উন্নয়ন। মানুষ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যে স্বাধীনতার বিলুপ্তি ঘটতে দেখে তা একপ্রকার রাষ্ট্র ব্যবস্থারই দৃশ্যমান ক্রিয়া। যদিও বলা হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই মানুষকে স্বাধীনতার সুবর্ণ সুযোগ অবারিত করতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্র তখনই গণতন্ত্র, যখন সুস্থ শাসন ক্রিয়ায় সম-অধিকার সম্পন্ন আইনি ব্যবস্থার উপস্থাপন ঘটে এবং মানুষ সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শাসকবর্গের অন্যায় উপস্থিতি যৌক্তিক পন্থায় স্থাপন/অপসারণ করে নিজেকে স্বাধীন ভাববার প্রকাশপ্রিয়তায় যুক্ত করতে পারে।
০৩.
মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীন সত্তা নিয়ে। জন্মের পরেই শুরু হয় তার স্বাধীন সত্তার দ্বিধা বিভাজন। লাকাঁ বলেন একটা শিশু যখন অন্যমানুষকে দেখে- শিশু নিজের বাইরের কোনো ইমেজের সাথে নিজেকেও একভাবে। লাকাঁ উল্লেখ করেছেন ফ্রয়েডকে। ফ্রয়েড মনে করতেন ‘মনের ভেতর মন আছে’। সে অচেতন মন। এই অচেতন মনের মধ্যেই যত কামনা বাসনা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে। যে মনের খবর আমরা রাখি, আমাদের সচেতনতা-ভাবনা চিন্তা, ইমেজ অনুভব ইত্যাদি। ফ্রয়েড তাকে ইগো বলেছেন বা অহং জগৎ এবং ব্যক্তির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হয়ে যে বোঝাড়া করে। আর সে তা মিথ্যাচারের মধ্যে দিয়ে করে। সংখ্যা মতে পুরুষ-নিত্যমুক্তবুদ্ধ শুদ্ধ। তার অহঙ্কারও নেই। শিশুরও অহঙ্কার থাকে না।’ শিশু বড় হয় সামাজিক বিধিনিষেধের মধ্যে। আর ক্রমবৃদ্ধিমান ক্রিয়ার ভেতরে ঘটে আরো অনেক সব বিষয় আশয়, বিশ^াস অবিশ^াস, ধর্ম পরহিত বা পর অনিষ্ট। অসহায় মানব শিশুর একক মানব সত্তার বিভাজন ঘটে এই পর্বে। ধীরে ধীরে তার সত্তারও বিভাজন ঘটে। সমাজ সুস্থ হলে, বিধিনিষেধের কড়াকড়ির তাড়না না থাকলে এবং তৎপরবর্তীতেও ন্যায় ন্যায্যতার বিধি আরোপ থাকলে, তার মধ্যেই মানব আচরণ শিশু থেকে যুবক পর্যন্ত সুস্থতায় সংহত করতে পারে। কিন্তু তবুও অগুণতি মানুষ মাটির আপেলকে আপেল মনে করে কামড় বসায়। ইয়ুং বলেন মানুষের মন শুধু কোনো একজন একক মানুষকে কেন্দ্র করে অবস্থান করে না, সমাজে অবস্থানকালে সামাজিক সব মানুষের ‘যৌথ মনস্তত্ত্ব’ ব্যক্তি ও সমাজের চরিত্র নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।’ সে কারণে বর্তমান সময়েও সমাজ অধিষ্ঠান সম্পর্কে সব মানুষই যৌথ অসচেতনার দিন যাপন করছে। একইভাবে আমরা যখন শুনি ক্ষমতাবানরা বলছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, তখন এই চেতনাকে বুঝবার ব্যাখ্যা করবার বিশ্লেষণ করবার বা পরিস্থিতির বৈপরীত্য নিয়ে অনুভব করবার কোনো তাগিদ কেউ অনুভব করছি না। না শিক্ষাবিদ, না বুদ্ধিজীবী, না গবেষক। আপ্তবাক্যের মতো এই বয়ান সবার মস্তিষ্কে স্থায়ী ও নিরাপদ আশ্রয় করে নিয়েছে।
০৪.
‘মুক্তি যুদ্ধের চেতনা’ এই আবেগের প্রতিশ্রুতি আজ ভাষণের প্রসঙ্গ হয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তিগুলো সাধারণকে শুনিয়ে অসাধারণ উচ্চতায় কিছুকে উন্নীত করতে পেরেছে। অবশিষ্ট সাধারণ পেশাজীবী, চাষি/ভূমিশ্রমিক শিক্ষা-দীক্ষাহীন শ্রমদাস রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, কুলি-মজুর, কামার-কুমার, মুচি-মেথর, নির্জীব মানুষ। জনগণের প্রারম্ভিক শ্রবণে যে উৎসাহ ছিল সময় ধারায় তা আজ না থাকলেও কেবল শুনে যাওয়ার এক রীতি- তাদের নিয়তি। ভাষণ শুনার অভিপ্রায় নিয়ে নয়, এ নিয়ে কোনো চিন্তা করণীয় কিংবা সম্পৃক্ততারও কোনো সুযোগ তারা জীবনক্ষেত্রে সংস্থিত করতে পারেনি। [ কিছু লোভি মানুষ, ঠিকাদার ও বিভ্রান্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, আমলা, প্রকৌশলী তরুণ ছাড়াও দলবাজিরা লুট করে জনতার পকেট] অন্য দিকে কিছু নগদ পেয়ে জনসভাগুলোতে উপস্থিত হয় কিছু নেতার নামে শিখিয়ে দেয়া স্লোগান তুলে বাড়ি ফেরে। ভুলে যায় নয়, স্মরণেও নিতে পারে না চেতনার সূত্রগুলোর ভাষা-বয়ান। তার চেতনায় কেবল নুন মরিচ তেল আর সম্ভব হলে কয়টা আন্ডার একটা ফর্দ পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। এইভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল যা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আপ্তবাক্যের রসায়নে গরম রসগোল্লা; হাইপার রিয়েলিটির মতো চেতনায় আসে যায়।
০৫.
সংবিধানের চারটি মৌলিক স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যার মাঝে বিশালত্ব পেয়েছে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ চেতনা। বঙ্গবন্ধু তার জগৎ নন্দিত ভাষণে বাঙালির জীবনরূপ বদলানোর জন্য কেবল স্বাধীনতার কথাটিই উল্লেখ করেননি। তিনি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ দ্বারা দুটো পর্বের রূপ রূপায়ন ও রসায়নের দর্শনগত দৃশ্যস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। পরে সংবিধানে যে চারটি মৌলিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ওই ভাষণের কাঠামোগত মৌলিক বিন্যাস রয়েছে। কিন্তু নানা রাজনৈতিক স্বার্থ ভ্রান্তি এবং লোভক্রিয়া পরবর্তীর দৃশ্যগুলোকে দলিত করে অর্ধশতকের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উপস্থিতি ঘটিয়েছে, তাতে রাষ্ট্র সমাজ জনমানুষ আজ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাসিত হয়ে চেতনা হারিয়ে শক্তিমানদের চাপিয়ে দেয়া চেতনায় আটকে পড়েছে। স্বাধীনতার লড়াই কোনো দেশের কোনো লোকসমাজে কখনো অকস্মাৎ লাফিয়ে ওঠে না, সামাজিক রাজনৈতিক কারণগুলো যখন জনগণমানসে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে প্রজ্জ্বলিত হতে হতে আগ্নেয় লাভার শক্তিতে টগবগে ফুটতে থাকে তখনই চূড়ান্ত হয় ইতিহাসের রায়। যে আকাক্সক্ষা মানুষের সারাজীবনের সেই স্বর সেই সুর সেই ধ্বনি তার হৃদয়কে উত্থিত করে, প্রসারিত করে, তখনই সাংগঠনিক শক্তিমত্তা জনগোষ্ঠীর বহুকালের দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে অপসারিত করে। জনগণ ইতিহাসের রায়কেই ফয়সালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জনগণমানসকে নাড়িয়ে দেয়ার শক্তি সঞ্চিত হয় সাংগঠনিক শক্তির মধ্যে। ইতিহাসের বিধান মতে পাকিস্তানিদের জুলুমের শাসন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের হেয় ও নিম্নরক্ত মানুষ এই গোষ্ঠীচিন্তায় যে আচরণ ও বিধিবিধান তারা আরোপ করেছিল, তাই পক্ষান্তরে তাদেরই ফিরিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তিতে লাফিয়ে ওঠা মানুষগুলোর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে পুরো সমাজকাঠামোতে একটা জাগরণধ্বনি। মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা বা বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারও ছিল না। সম্পূর্ণভাবে মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়, যা অস্তিত্ব বিপন্নতা থেকে অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণেরই ক্রিয়া আর সেখানেই থাকে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির অন্তর্গত শক্তি যে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। এটাকেই বলা হয় চিন্তার উত্তরণ। যা স্মৃতি হয়ে গেছে।
পৃথিবীর বহু জাতির প্রত্যাশার পূরণে স্বাধীনতা অর্জনে আশপাশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি সংশ্লিষ্ট লড়াইরত স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য সাহায্য সহযোগিতা দেয়/দিয়েছে। কিন্তু তাদের বেশির ভাগের পশ্চাৎভূমি ছিল তাদের নিজ ভূখণ্ড। কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে থাকেনি তা নয়, সে ক্ষেত্রেও সেসব দেশের প্রভাব ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গে লড়াইরত মানুষের নেতৃত্বকে সজাগ ও সচেতন থাকার অনেকখানি অভাব প্রত্ন পরিস্থিতিতে মেলে। একদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বর্বর আক্রমণ, হত্যা ধ্বংস জ্বালাও পোড়াও নীতি এবং অন্য দিকে দিশাহীন মানুষের আরেকটি ভূখণ্ডে পালিয়ে প্রাণরক্ষার বেদনাদায়ক দৃশ্যপটে পরিকল্পিত প্রতিরোধ নিষ্ক্রীয় থাকায় প্রত্যাবর্তিত রাষ্ট্রক্ষমতার অঙ্গনে দয়া ও দাক্ষিণ্যের অনুবর্তী হতে হয়েছে উদ্যোগ। ফলে ঠাঁই পাওয়া রাষ্ট্রশক্তির বেষ্টনী থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধপরিচালনায় সেই রাষ্ট্রশক্তির অনেকখানি প্রভাবের অস্তিত্ব অনুষঙ্গ লক্ষণীয়। স্বাধীনতার লড়াইয়ের লড়াকুদের পশ্চাৎভূমি নিজ দেশের ভূখণ্ডে না থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা অনুমান করা অবাঞ্চিত হবে না। এই ভুলটাই বহুলাংশে মানুষের স্বাধীনতার ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে রেখেছে। ফলে সমগ্র জাতির মনস্তত্ব আংশিক সফলতা পেলেও পরে তা ভিন্ন অনুষঙ্গে পীড়িত হয়ে রুদ্ধ হয়েছে, থমকে গেছে, কেবল দ্বিতীয় পর্বের ‘মুক্তির সংগ্রামের’ উত্থান ঘটেছে সেই শক্তির যারা নিজভূমির আভ্রুটুকুও লুটে নিতে পূর্ব/পরের দ্বিধা করেনি ।
০৬.
ব্যক্তির মুক্ত প্রকাশ স্বাধীনতা বিকাশের ধারায় চিন্তারসূত্রও মুক্ত হয়- চিন্তার স্বাধীনতা স্থিতি পায়। চিন্তার স্বাধীনতা ব্যাহত হলে ব্যক্তির কর্মদক্ষতা সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। সমাজজীবন, জ্ঞান অনুসন্ধান, সুন্দরের অনুভব, নান্দনিক চর্চা, নতুন যা কিছু শুভ তাকে গ্রহণ নিজ অন্তর শক্তি থেকে ছিটকে পড়ে। ব্যক্তি নানা কুসংস্কারের সঙ্গী হয়। ফলে রাষ্ট্র ও সামাজ জীবন সম-সমৃদ্ধির পথে না এগিয়ে সোয়ার হয় ব্যক্তি-সুবিধাবাদে, তখনই অন্যায় ভোগ প্রতিযোগিতা প্রবল হয়ে ন্যায়কে ক্রমান্বয়ে সমাজ সন্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। উত্থান ঘটে ‘সত্যের মতো বদমাশদের’। এ রকম পরিস্থিতিতে মহা-উদ্যমে একশ্রেণীর লোকেরা চুটিয়ে তার মতলবি স্বাধীনতা ভোগ করে এবং নানা স্বার্থের রসায়নে লুটপাট, দখল, পুনর্দখল, অস্তিত্বমান রীতিনীতিকে কাদায় খাওয়া পায়ের আঙুলের মতো খেতে শুরু করে। সমাজজীবন হারিয়ে ফেলে তার ন্যায়বোধ ও সৌন্দর্য চেতনা। নানা কিসিমের উপদেশাবলী সেই সব লোকেরা বিলিবণ্টন করে, যারা জনগণকে ফতুর করবার জন্য ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট গড়েছে। রাজপুরুষরা সেই সবে একে অন্যকে দোষারোপ করে কিংবা নীরবতায় জনগণকে ফতুর করে আর লোক ভুলানো ক্রিয়াকে দৃশ্যমান করে এবং অনিবার্য নিষ্ক্রীয়তার মধ্য দিয়ে উৎসাহিত করে দলভুক্ত মানুষ। কারণ এই কাদায় প্রোথিত ক্ষমতার টিকে থাকবার খাম্বা হলো অই সব অঙ্গগুলো। তারা ধর্মউপদেশের মানুষদেরও এসবের মধ্যে যুক্ত করে আটকে পড়া মানুষদের পরকালের উপদেশ শোনায়। কেউ কেউ চাবির সন্ধানও বলে দেয়। এভাবে বিপর্যয় ঘটে একটি জাতির জীবনে। সামাজিক জীবন অপরিচ্ছন্ন হতে থাকে এবং স্বার্থের আঁস্তাবল হয়ে ওঠে। নীচতলার মানুষেরা এই দাসত্বের জীবনকেই ‘স্বাধীনতা’ বলে মান্য করে- রাজার কোনো অপরাধ নেই, রাজা কোনো ভুল করে না, রাজা ঈশ^রের প্রতিনিধি এই সব বিশ^াসে রাজবন্দনার বয়ানে নিজেদের উপশম খোঁজে।
চেতনাহীন মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেমালুম উপলব্ধিহীন থাকে। তারা নির্জীব নিস্পন্দ জীবন যাপনের গতিধারায় ক্ষমতাশালীদের বক্তৃতা, উপদেশ গালাগালের নব্য ভাষাবিধানে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতার গুণকীর্তন শোনে। ফলে একটা অদৃশ্য সীমারেখা দ্বারা তা সীমিত যা বহুকালের কিংবা নয়া সময়েরও কেবল রূপের হেরফের থাকে। উপযুক্ত শিক্ষা যা অস্তিত্ব চেতনা গড়তে সহায়ক, ব্যক্তি তার জমকালো আয়োজন প্রত্যক্ষ করে। বড় বড় স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয় ভবন দেখে কিন্তু তার বিচ্ছুরিত জ্ঞানালোক যে কী তা ঠাহর করতে পারে না। যদিও ক্ষমতাবানরা সবই সমাজ মানুষের জন্য, জনগণের মঙ্গলের জন্য, এই কিস্সা সারাদিন প্রচারে প্রপাগাণ্ডায় ছড়িয়ে রাষ্ট্রের দেয়া অর্থ হাপিস করতে থাকে। তারা ভাবে না মুর্খ জনশক্তি তার উন্নয়নকেও উপলব্ধি করতে পারে না কিংবা এর ফলাফলও উপলব্ধিতে নেয় না। মধ্যবিত্ত ছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্তরা কষ্টেশিষ্টে তাদের সন্তানদের এই সব ভবনে পাঠিয়ে আশায় বসে থাকে। কালের ধারায় সেই সব সন্তান ভুল শিক্ষার মঙ্গলালোকে সিদ্ধ হয়ে নানাভাবে স্বার্থপর অভিজাতদের পরিচালিত ক্ষমতাবলয়ের থাবায়/ফাঁদে অঙ্গীভূত হয়, নেতার পেছনের শোভা হয়, তার বক্তৃতায় মাথা দোলায়। কেউ হাক্কানি কেউ রাব্বানি কেউ তেলেসমাতি হেলমেট রামদা পিস্তল কিরিচের সমর্থক হয়ে নেতা ও নেত্রীর পদলেহনে অস্তিত্ব বিলীন করে। আর কৃষক শ্রমিক মজুর তাঁতির সন্তানরা শিক্ষাহীন থেকে রিকশাওয়লা, দোকান কর্মচারী, টিবয়, জুতা সেলাই পলিশওয়ালার জীবিকায় লেগে পড়ে। এভাবেই বিপুল মানুষ পরিণত হয় এক বোধহীন দঙ্গল মানুষে। ফলে সমাজে যা কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক বলবৃদ্ধিকারক সৃষ্টির প্রত্যাশায় থাকে, তা হয়ে পড়ে অর্থহীন গতানুগতিক গিল্টি করা এক রোগা সময়ের জগাখিচুড়ি। মানুষ নিজের অস্তিত্বে আর বিশ^াসী থাকে না, সে তাকিয়ে থাকে বাইরের শক্তির দিকে, তার চেহারায় তখন তারা দেবতার রূপ দেখে।
স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোতে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ধারায়। মুখরোচক কোনো বয়ানে তার ক্লেদকালিমা মোছা যায় না। যে চিন্তায় অন্যের খবরদারি থাকে, প্রকাশে বিধিনিষেধ খড়গ হয়ে ঝোলে, সেখানে মানুষ স্বাধীনতার অর্থটাই পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। মুক্ত সমাজ মুক্ত জীবন বোধ সম্বলিত স্বাধীনতা যা দায়হীন নয় আবার রাষ্ট্রকাঠামো বিঘ্নকারী নয়, তাই কেবল যৌথ অসচেতনার বেঁড়ি ভাঙতে পারে। বিকশিত হতে পারে মানব মনে অস্তিত্ব চিন্তা। অস্তিত্ব প্রখরভাবে ব্যক্তি মানসে প্রথিত হলে সে রাষ্ট্র ও সমাজসম্পদের উপকরণে নিজকে যুক্ত করে। স্বাধীনতা হীনতার অভিজ্ঞতা নাগরিক জীবনে ক্ষতিকর মানসিক প্রভাব ফেলে। একাকিত্ব বোধ, কম আত্মমর্যাদাবোধ, স্বার্থ উদ্ধারের কীট কিংবা একেবারেই পদলেহনকারী, আক্রমণাত্মক মনোবৃত্তি, আত্মবিক্রির বিচিত্র মানসিকতা, মোসাহেব, তেলবাজিকর, দলবাজিকর, ঘুষবাজ, দুর্নীতি, লুটপাট, মিথ্যে বলার প্রবণতা ইত্যাদিকে ইত্যাদির পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। এ রকম পরিস্থিতির নাগরিক জীবনবোধ রাষ্ট্রের জন্য যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব রক্ষায়ও অপারক্ষম। তবুও অপেক্ষা কবে সকাল হবে..?
লেখক : কবি, প্রবন্ধকার ও চিন্তক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা