২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইনফ্লুয়েঞ্জার আত্মকথন

-


মাঝে মধ্যেই ইচ্ছা হয় পৃথিবীর মানুষগুলোর ঘাড় মটকে দেই। তেইড়া ঘাড়টা একটু সোজা কইরা দেই। তাই তো বাতাসে ভর করে নেমে আসি মাটির মর্ত্য।ে এ জন্যই মানুষ আমাকে নাম দিয়েছে বাতাসবাহিত জীবাণু। হ্যাঁ আমি ইনফ্লুয়েঞ্জা বলছি। অনেকে সংক্ষেপে ‘ফ্লু’ও বলে থাকে।
আমি একা নই। আমার বেশ কিছু সহচরী আছে যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পৃথিবীতে নেমে এসেছে আর কাবু করে ছেড়েছে বেয়াড়া মানুষগুলোকে। এই যেমন- স্প্যানিশ ফ্লু। এটি মহামারী হিসেবেও পরিচিত। এটি ছিল একটি অস্বাভাবিক ইনফ্লুয়েঞ্জাঘটিত বৈশ্বিক মহামারী। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ১৯২০ অবধি এটি ৫০ কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল- যা সেই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অর্থাৎ ২৫ বিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল একবারে। আরো আছে বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি।

বার্ড ফ্লু যাকে বাংলায় বলা যায় পক্ষী ইনফ্লুয়েঞ্জা। এটিও এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা। ভাইরাসঘটিত এই রোগটি বন্য জলচর পাখিদের প্রাকৃতিকভাবেই সংক্রমিত করে এবং কখনো কখনো গৃহপালিত পশু-পাখিদেরও সংক্রমিত করতে পারে। এটি ইংরেজি ভাষাতে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাভিয়ান ফ্লু, বার্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি নামে পরিচিত। মানুষের মধ্যে, বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার সাধারণ লক্ষণগুলো সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই যেমন- জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, মাথা ব্যথা, পেশীতে ব্যথা এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। H5N1 হলো বার্ড ফ্লুুর সবচেয়ে সাধারণ রূপ।
সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়াইন ফ্লু শূকরের ইনফ্লুয়েঞ্জা নামে পরিচিত। এর প্রধান রূপ হচ্ছে H1N1. শূকরের মধ্যে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পাওয়া যায় বলে একে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস বলে। এই ভাইরাসটি ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে পৃথিবীর কয়েকটি দেশে মানব মৃত্যুর কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এটি মূলত শূকরের মধ্যেই পাওয়া যেত যা কিনা শূকরকে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত করত। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতোই এটি শ্বাসনালিতে সংক্রমণ করে থাকে। ভাইরাসটি হাঁচি এবং কাশির ফোঁটাগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ঘণ্টার জন্য ভূ-পৃষ্ঠে বেঁচে থাকতে পারে। অতএব, H1N1 ফ্লু কখনো কখনো একটি দূষিত পৃষ্ঠ স্পর্শ করে এবং তারপর আপনার নাক বা মুখ স্পর্শ করে ছড়িয়ে যেতে পারে।

আমার এসব সহচর মূলত মহামারীর আকারেই এসে থাকে। আমি যদিও ওদের মতো অতটা নিষ্ঠুর হতে পারি না। তবু বিজ্ঞানীরা আমাকে এ, বি, সি, ডি- এই চারটি টাইপে বিভক্ত করে আমার ধ্যান-জ্ঞান-উচ্চতা নির্ণয় করতে সচেষ্ট রয়েছে।
ওরা বলে- ইংরেজি ভাষায় আমার নামটি আবিষ্কৃৃত হয় ১৭০৩ সালে। আমার আক্রমণে নাকি প্রতি বছর দুই লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ মারা যায়। আরো বলে, আমার চারটি ধরনের মধ্যে এ, বি, সি মানুষের দেহে দেখা মিললেও ‘ডি’ টাইপটা পশুপাখির শরীরে দেখা গেছে। আসলে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস দ্রুত পরিবর্তিত হয় বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন টিকাগুলোর নতুন নতুন সংস্করণ ঘটাচ্ছেন এবং বছরে দুবার করে তৈরি করছেন।
মানুষ মনে করে আমার আক্রমণ শুধু শিশু আর বয়স্কদের মধ্যেই। আরে না! না! যখন খুশি হয় আমার খেয়াল চাপে কী জওয়ান তাগড়া আর কী-ই বা নিটোল রমণী- কোনো ভেদ নেই। এ আমার ইচ্ছা এ আমার স্বাধীনতা। আমার এ ইচ্ছা আকাক্সক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কত কিছুই না বলে তবু বলে না, ‘সব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ! যিনি আমারও প্রভু তারও প্রভু।’ তবে আমি ভয় করি আমার প্রভুকে। তাঁর হুকুম ছাড়া আমি কারো উপর চড়াও হই না এমনকি এক মুহূর্ত বেশিও তাকে নাড়িয়েও বেড়াই না।

যদিও আমার খুব আনন্দ একবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারলে তাকে একটু ঝাকানাকা খাইয়ে দেয়া। এ জন্য আমি আমার সব শক্তি ঢেলে দিয়ে- আমার বাহিনীকে নিযুক্ত করে দেই যার যার দায়িত্ব পালনে। এই যেমন কেউ এসে প্রথমেই গলাটা চিপে ধরবে, কেউ মাথায় উঠে বসে ঘুরঘুরিয়ে নাচাবে, কেউ সারা শরীর দলিত মথিত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে। পেটটার মধ্যে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে কখনো তা পিচকিরি হয়েও বেরিয়ে যেতে চাইবে, কেউ ফুঁ দিয়ে দিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে শরীরটাকে পৌঁছে দেবে হাবিয়ার দোরে। মানুষ যেন একটু হলেও অনুভব করতে পারে হাবিয়া কী?
এরই মধ্যে আবার আমার শব্দ সৈনিকরাও নেমে পড়বে যার যার হাতিয়ার নিয়ে। ওরা গলা থেকে বুক পর্যন্ত এমন লুটোপুটি খেলবে যে কেউ খক খক শব্দে, কেউ চিঁউ চিঁউ শব্দে কিংবা কেউবা শ্বাস-প্রশ্বাসের উঠানামার সাথে জোর ধাক্কায় দোল খেতে খেতে নাচবে। আসলেই কি নাচা? এ নৃত্য মুদ্রার তালে সঙ্গীতের ভঙ্গিতে নয় যদিও রোগী একসময় বুঝে যায় ‘কত ধানে কত চাল।’ বুকের ব্যথায় পিঠের ব্যথায় সর্বাঙ্গের অস্থিমজ্জা এক হতে থাকবে। যদি না তার মুখ দিয়ে সর্বশক্তিমানের স্মরণ ঘটে। এসব কিছু মিলিয়েই আমার নর্তন-কুর্দনে আমি বুঁদ হবো কিছু দিন। এটি আমার রুটিন, এটি আমার ধারা।

আমার লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হচ্ছে-
জ্বর/ঠাণ্ডা অনুভব করা, কাশি, গলা ব্যথা, সর্দি বা নাক বন্ধ, পেশী বা শরীরে ব্যথা, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি , কখনো কখনো বমি এবং ডায়রিয়ার রূপও হতে পারে।
তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আমাকে আমার এ ধারা মতে চলতে দিতেও অনীহা। তারা আমাকে এবং আমার টাইপগুলোকে খতম করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ এমন এমন ওষুধ সেবনে লেগে যায়; আমার বাহিনী তখন কিছুটা দমে আসতে বাধ্য হয়। তবু এ ক’দিনের সখ্য কি ছাড়া যায়?
তাই আমার শব্দ বাহিনীরা শেষ সময় পর্যন্ত কত কিই-না আলাপন জুড়িয়ে দেয় রোগীর সাথে! হায়! মানুষ যদি বুঝত! সে শুধু শুনে ওই চিঁউ চিঁউ শব্দ- আর বলে, ‘ডাক্তার গো বুকের মইধ্যে মুরগি ছানা ডাকে।’ ওরে ও সবজান্তা মানুষ! তুই কত অক্ষম!
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত বছরের ঠাণ্ডা মাসগুলোতে বেশি হয়। কাশি এবং হাঁচির ফলে সংক্রামিত ফোঁটা শ্বাস নেয়ার মতো উপায়ে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে প্রেরিত হয়। তাদের মতে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কণাগুলো শরীরে প্রবেশ করে, তারা বেছে বেছে সিলিয়েটেড এপিথেলিয়াল কোষগুলোতে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে যা উপরের শ্বাসনালীর ব্রঙ্কিয়াল টিউবেও এসে বাসা বাঁধে। রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড হলো এক থেকে দুই দিন, এর পরে লক্ষণগুলোর সূচনা হয় আকস্মিক এবং স্বতন্ত্র ঠাণ্ডা, ক্লান্তি এবং পেশীতে ব্যথাসহ। তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে ৩৮-৪০ °C (১০১-১০৪ °F) হয়ে যায়। এ তো গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ভাষ্য।

‘আসলেই কী তাই? আমার তো ইচ্ছে হলেই প্রচণ্ড গরমেও আমি নেমে পড়তে পারি। ওই যে বললাম, আল্লাহর হুকুম। যে কথাটি বিজ্ঞানীরা বলতে চায় না। তারা শুধু তাদের থিউরিই গেয়ে যায়। তাই তো ইদানীং আমি তাদের লিখিত সব নিয়ম-কানুনের বাইরে গিয়ে অলিখিত কর্মতৎপরতায়ও মেতে উঠছি প্রায়শই। তবু যদি বেয়াড়াগুলোর টনক নড়ত!’
ঋতু পরিবর্তন বা মৌসুমি অসুখ বলে ধরে নিলেও আমি অনেক সময়ই ভাইরাল সংক্রমণ হয়ে দাঁড়াই। আর প্রতিনিয়তঃই রূপ পাল্টাই। এ সময় ওরা আমাকে বলে ‘মিউটেশন’।
তারা আর যা-ই বলুক আর যেভাবেই বলুক, আমাকে বধ করার জন্য ওদের কতই না প্রচেষ্টা। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে চালু করা হয়েছিল বেশ কিছু ওষুধ যা আমার ‘এ এবং বি’ উভয় ভাইরাসকে বাধা দিতে সচেষ্ট।

তবে কি যারা নিয়ম মেনে শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলে আমি পারতপক্ষে তাদেরে অবশেষে আর ধরে রাখি না; বরং ছেড়েই দেই। এই যেমন-
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া।
২. প্রচুর তরল খাবার ও পানীয় সেবন।
৩. ঠাণ্ডা আবহাওয়া বর্জন।
৪. শুষ্ক ও উষ্ণতায় নিজকে আটকে রাখা।
৫. যথাযথ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।
৬. যেখানে সেখানে কফ-থুথু না ফেলা।
৭. আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য বস্ত্রাদি সযতে্ন অন্যের সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে রাখা।
৮. এমনকি বছরে একবার ফ্লুর টিকা গ্রহণ করা।
৯. জনসমাগমে মাস্ক ব্যবহার করা।
১০. যথাযথভাবে সংক্রমণ এড়িয়ে চলা।

আসলে আল্লাহ সুবহানু তায়ালা তো স্বভাবের ধর্মে বিশ্বাসী। যার যা নিয়ম তা চলবেই। কিন্তু আগেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা স্বরূপ যারা এসব নিয়ম মেনে নিজ নিজ স্বভাবকে সুন্দর রাখে- ‘কেন অযথাই তাদেরে আমি নাজেহাল করব? আমার স্রষ্টা তা পছন্দ করেন না।’
তাই ছেলে-বুড়ো-শিশু সবাইকে বলছি : এসো নিয়মের মধ্যে চলো। গরমে অস্থির হয়ে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানীয়, ফ্রিজের খাবার এমন কি আইসক্রিমও খেয়ো না, সে তা যতই গরম পড়ুক। আর ঠাণ্ডার সময়? তখনো মেনে চলবে স্বাস্থ্যবিধি। তাহলেই তো আমার রোষ বেড়ে যায় না তোমাদের উপর- আমার বাহিনীও নিস্তেজ হতে থাকবে মর্তের বুকে- ফলে তোমরাও বেঁচে যাবে মহান রবের কৃপা মতে!
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
করিমগঞ্জের বদলে শ্রীভূমি করল আসাম সরকার ভারত-চীন কূটনীতিতে নতুন সমীকরণ! বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধে অর্থঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত জরুরি অবস্থা জারি করে আমেরিকা থেকে শরণার্থী তাড়াবেন ট্রাম্প! শেষ ম্যাচে হেরে টেনিসকে বিদায় রাফার ২৯ বছরের দাম্পত্য ভেঙে বিচ্ছেদের পথে এ আর রহমান-সায়রা বানু হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি পর্যালোচনা করছে লেবানন আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে অনুসন্ধান কমিটির নির্দেশ হাইকোর্টের ভারতকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে হাসিনাকে নির্বাচন বিলম্বিত করার শঙ্কা বাড়ছে বিএনপিতে নর্থ মেসিডোনিয়ায় ২০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ

সকল