জেন জি প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যম
- মুহাম্মদ কামাল হোসেন
- ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গণমাধ্যম সমাজের আয়না। তবে বর্তমান সময়ে সেই আয়না কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল? এ প্রশ্ন এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে জেনারেশন জি প্রজন্মের জন্য। আজকের তরুণরা সমাজের প্রতি তাদের চেতনা ও পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছে। তারা তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসামঞ্জস্য ও সমস্যা সম্পর্কে অবগত হচ্ছে। তবে তাদের চেতনা ও প্রত্যাশার জায়গায় গণমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করছে, সে প্রশ্নটি ক্রমেই আরো জটিল হয়ে উঠছে। জেনারেশন জি বা সংক্ষেপে জেন জি, হলো সেই প্রজন্ম যারা বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের সন্তান। তাদের জীবনের শুরুটাই ঘটেছে প্রযুক্তি আর তথ্যের চমৎকার উত্থানের সঙ্গে, যেটি এই প্রজন্মকে অতীতের প্রজন্মের থেকে ভিন্নতর এবং দ্রুতগামী করে তুলেছে। এই প্রজন্মকে বলা হয় ‘ডিজিটাল নেটিভস’ কারণ তারা এমন একসময়ে বেড়ে উঠেছে যখন ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং আধুনিক প্রযুক্তির জগতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সহজতর হয়ে উঠেছে। এ কারণে জেন জি প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যমের প্রতি একটি স্বতন্ত্র প্রত্যাশা ও ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। কিন্তু গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি সেই প্রত্যাশার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে।
আজকের তরুণ প্রজন্ম সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, বৈষম্য ও অনিয়ম সম্পর্কে সচেতন। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে তারা সমাজের সমস্যাগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে পারছে। তবে, গণমাধ্যমের বর্তমান ভূমিকা এই তরুণদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে কি? এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, তরুণ প্রজন্মের চিন্তাধারা এবং তাদের সমাজ বদলের ইচ্ছার পথে গণমাধ্যম কতটা সহায়ক? গণমাধ্যমের এই রূঢ় বাস্তবতায়, পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত? তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত জেনারেশন জি, এমন একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে সবার সমান অধিকার, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় থাকে। তাদের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ মুক্তচিন্তার প্রতি উদ্দীপিত,এবং তারা সামাজিক সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে দ্বিধা করে না। তাদের ধারণা, গণমাধ্যম কেবল খবর পরিবেশনের একটি মাধ্যম নয়; এটি সমাজ পরিবর্তনের একটি হাতিয়ারও বটে। তারা আশা করে, গণমাধ্যম তাদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকৃতি দেবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা নিয়ে তাদের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরবে। তবে গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা তরুণদের এই প্রত্যাশা পূরণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। বাণিজ্যিক চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জনপ্রিয়তার দৌড়ে অনেক সময় প্রকৃত সত্য বা গভীর বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টিং গণমাধ্যমে জায়গা পায় না। এটি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে গণমাধ্যমের একটি বিভেদ তৈরি করে, যা তাদের হতাশা এবং অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেনারেশন জি এমন এক প্রজন্ম যারা সত্যিকারের তথ্য, প্রাসঙ্গিক সংবাদ এবং স্বচ্ছ ও নির্ভুল রিপোর্টিং আশা করে। এই প্রজন্মের সদস্যরা গড়পরতা খবরের বাইরেও আরো গভীরতর ও বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পেতে চায়। তাদের আগ্রহ শুধু ঘটনার খবর নয়, বরং কেন ও কীভাবে ঘটল তা জানতে। বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক চিন্তার এই প্রজন্ম গণমাধ্যমের প্রতি আশা করে যে, তারা এমন বিষয়গুলো তুলে ধরবে যা সমাজের গভীর সমস্যা, বিভাজন ও বৈষম্যকে তুলে আনবে এবং তাদের সংস্কৃতি, মতামত ও চিন্তাধারাকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে।
জেন জি প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যম কেবল সংবাদ পরিবেশনকারী মাধ্যম নয়, বরং একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা সমাজের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তারা মনে করে, গণমাধ্যমের একটি বিশাল দায় রয়েছে, যা সত্যকে তুলে ধরা এবং দুর্নীতি, বৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা। এই প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যম এমন একটি প্রতিফলন হওয়া উচিত, যেখানে সমাজের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। এ ছাড়াও তারা আশা করে যে গণমাধ্যম এমন একটি জায়গা হবে যেখানে সৃজনশীলতা ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হবে এবং মেধার চেয়ে জনপ্রিয়তা বা ফাঁপা সেলিব্রিটি কালচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না। তাদের প্রত্যাশা, গণমাধ্যম হয়ে উঠবে এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম, যা সমাজের ন্যায়বিচার ও প্রগতির কথা বলবে। তবে গণমাধ্যমের বর্তমান চিত্রটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রত্যাশার সঙ্গে খাপ খায় না। বাণিজ্যিক চাপে পড়ে গণমাধ্যম অধিকাংশ সময় তুচ্ছ ও ভাইরাল কনটেন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সত্যিকারের সমস্যাগুলো উপেক্ষা করছে। এর ফলে জেন জি প্রজন্মের মনোভাব ও মেধা যথাযথ মূল্যায়ন পায় না।
কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, গণমাধ্যম এই প্রত্যাশাগুলো পূরণে অনেকটাই পিছিয়ে। গণমাধ্যমের বিশাল একটি অংশ আজ বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত, যেখানে সত্যিকারের সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে ভাইরাল কনটেন্ট এবং বিজ্ঞাপন থেকে মুনাফা অর্জনই মুখ্য। অনেক ক্ষেত্রেই সত্যের বিকৃতি ঘটিয়ে অথবা অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গণমাধ্যম প্রচারের চেষ্টা করে। জেন জি প্রজন্মের মেধা, চিন্তাভাবনা এবং তাদের আগ্রহের ক্ষেত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে গণমাধ্যম এমন অনেক কিছুই প্রচার করে যা এই প্রজন্মকে হয়তো সাময়িকভাবে আকৃষ্ট করতে পারে, কিন্তু তাদের গভীর চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি তারা দেখছে, গণমাধ্যমে মেধার চেয়ে ব্যক্তিকে প্রমোট করা হচ্ছে, বিশেষ করে সেলিব্রিটি ও ইনফ্লুয়েন্সারদের অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। এ ধরনের ফাঁপা প্রচার কেবল তাদের বিরক্তিই বাড়াচ্ছে না, বরং তাদের গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাও কমিয়ে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের জন্য গণমাধ্যমের পরিবর্তন আসলে সমাজের জন্যই প্রয়োজন। এ প্রজন্মের চাওয়া হলো গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ আচরণ। গণমাধ্যম যদি এই প্রজন্মের সঙ্গে সঠিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তবে তাদের চেতনা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে আরো বাস্তবমুখী এবং গভীর বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।
গণমাধ্যমের এমন একপেশে ও বাণিজ্যিক মনোভাব জেন জি প্রজন্মের মাঝে হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। তারা প্রত্যাশা করেছিল একটি সাহসী ও দায়িত্বশীল মিডিয়ার, যারা সত্যিকারের ঘটনা ও সমস্যা তুলে ধরবে। কিন্তু পরিবর্তে গণমাধ্যমে যখন তুচ্ছ ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়, তখন এই প্রজন্ম মনে করে তাদের নিজেদের চিন্তা ও মতামত মূল্যহীন। তাদের অনেকে এই বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে, যে গণমাধ্যম তাদের চিন্তা ও মেধাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।গণমাধ্যমের ফাঁপা প্রচারণার ফলে জেন জি প্রজন্মের সদস্যরা বিকল্প মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। তারা নিজেদের চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করতে, বাস্তব সমস্যাগুলো তুলে ধরতে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিচ্ছে। এটি গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় সতর্কসংকেত হতে পারে, কারণ এই প্রজন্মই ভবিষ্যতের মূল গণমাধ্যম ব্যবহারকারী। যদি গণমাধ্যম তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারে, তবে তাদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জেন জি প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণের জন্য গণমাধ্যমের একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। এই প্রজন্মের মেধা ও প্রতিভাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তাদের চিন্তা ও মতামতের প্রকাশের সুযোগ দেয়া উচিত। সত্যিকারের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আনা এবং সৃজনশীল ও মেধাবীদের প্রকৃত মূল্যায়ন করাই গণমাধ্যমের কাজ হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম শুধু জেন জি প্রজন্মের মন জয় করতে পারবে না, বরং তাদের আস্থা এবং শ্রদ্ধাও অর্জন করতে পারবে। গণমাধ্যমের উচিত বাণিজ্যিক চাপে নতি স্বীকার না করা, এবং সঠিক তথ্য, সত্যিকার ঘটনা ও সামাজিক সমস্যা তুলে ধরে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। উদাহরণস্বরূপ পরিবেশ বিপর্যয়, বৈষম্য, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাব্যবস্থা এ ধরনের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে অধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এর মাধ্যমে জেন জি প্রজন্মের জন্য এমন একটি গণমাধ্যম তৈরি করা সম্ভব, যেখানে তারা নিজেদের ভাবনা ও মূল্যবোধকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।
জেন জি প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যম কেবল একটি সংবাদ পরিবেশনকারী মাধ্যম নয়, বরং একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম যা সমাজে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু যখন গণমাধ্যম তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং মেধা বা সৃজনশীলতার মূল্যায়নের চেয়ে ফাঁপা প্রচারণাকে গুরুত্ব দেয়, তখন এই প্রজন্মের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষের জন্ম হয়। জেন জি প্রজন্ম একটি উজ্জ্বল ও সঠিক তথ্যভিত্তিক গণমাধ্যম আশা করে। তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে গণমাধ্যমকে সত্যনিষ্ঠতা, বৈষম্যহীনতা ও গভীরতর অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য গণমাধ্যমের একটি সুসংগঠিত ও নীতিনিষ্ঠ পরিবর্তন আজ জরুরি, যা ভবিষ্যতে একটি দায়িত্বশীল ও প্রগতিশীল গণমাধ্যম গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। গণমাধ্যম যদি সত্যিকার অর্থেই জেনারেশন জি প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তবে তাদের চিন্তা, মেধা এবং প্রত্যাশাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। এই প্রজন্মের প্রতি গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণ ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী, ন্যায়বিচারপূর্ণ ও সত্যনিষ্ঠ মিডিয়া গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সঠিক পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যমের প্রয়োজন মেধা ও মানসিকতার সমর্থন জোগানো এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে জেন জি প্রজন্মের চোখে গণমাধ্যম এক নতুন আস্থা, আশা ও সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠতে পারবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা