১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমাদের হতে হবে মানবিক ও হৃদয়বান

-

আমরা নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করলেও একজন হৃদয়বান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারছি না! অথচ ইসলামের মূল মানবিক মূল্যবোধই হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসা। পরিবার, সমাজের ব্যাপারে মানবিক হয়ে উঠা। মানুষের বিপদ-আপদে পাশে থাকা। অসহায় মানুষের সেবা করা।
আমরা কি আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসি কখনো? আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের দোয়া দরুদ শিখতে, ফরজের পাশাপাশি নফল নামাজ-রোজার প্রতি নিজের আকর্ষণ তৈরিতে যতটা ব্যস্ত থাকি তার সিকি ভাগও কি আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ গঠনে ব্যয় করি? আমরা একে অপরকে ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেই। ‘নীরব থাকা পরিশ্রমবিহীন ইবাদত’; তাই এই ব্যাপারে অনেককে পরামর্শ দেই কিন্তু আমরা কি কখনো নিজে একবার ভেবেছি যে মানুষকে ভালোবাসা এবং অন্যদের মানুষের প্রতি ভালোবাসা লালনের পরামর্শ দেয়াও এক ধরনের ইবাদত।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন- ‘আমার মহত্বের কারণে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার ছায়াতলে স্থান দেবো। আজ এমন দিন আজ আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া নেই।’ (মুসলিম-২০৬৬)
আমরা পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপাদান মানুষকে সবার আগে ভালোবাসতে হবে, তাদেরকে আপন করে বুকে জড়িয়ে ধরতে হবে। তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে সত্যিকারের বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তারপর তাদের মধ্যে সৎ ও মানবিক গুণাবলি তথা দয়া, মায়া, ভালোবাসা, উদারতা, ক্ষমা, সেবা ও সহনশীলতার উদ্ভব ঘটাতে ঘটাতে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট করে তুলতে হবে।

রাসূল সা: সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের সাথে কোমল আচরণ করা, মানুষের বিপদে পাশে থাকার প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমনকি আল্লাহ তায়ালাও রাসূলের এ বিষয়টিকে অনেক বেশি পছন্দ করেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন- ‘এটা একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ যে আপনি এদের (মুসলমানদের) প্রতি কোমল। যদি আপনি কঠোরভাষী বা তিক্ত মেজাজসম্পন্ন হতেন, তাহলে এরা আপানর চারপাশ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। কাজেই এদের ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখুন, এদের জন্য সাফায়েত চান এবং বিভিন্ন বিষয়ে এদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর পরামর্শের পর যখন কোনো বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প হয়ে যায় তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল ইমরান-১৫৯)
আল্লাহ তায়ালা সব সময় মুসলিম তথা মুমিনদের একে অপরকে ভালোবাসা, একে অপরের বিপদে ও আপদে পাশে থাকা, সর্বোপরি আপন ভাইয়ের মতো সম্পর্ক তৈরির জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘ঈমানদারেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করো।’ (সূরা হুজরাত-১০) অথচ আমরা সেসব ভুলে গিয়ে শুধু দোয়া-দরুদ, নামাজ-রোজা ও হজ-সর্বস্ব মানুষে পরিণত হয়েছি!

আমরা অন্যের থেকে দয়া ও ভালোবাসা পেতে চাই, কিন্তু দয়া ও ভালোবাসা দিতে জানি না। আমরা অন্যের থেকে সারাক্ষণ উদারতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা প্রত্যাশা করি, কিন্তু নিজে হয়ে উঠি চরম অসহনশীল, ক্ষমা করতে অনিচ্ছুক, ভালোবাসা ও মায়া দিয়ে অন্যকে আগলে রাখতে নারাজ। শুধু নিজের পরিবারের মানুষ ছাড়া অন্যকে ভালোবাসা ও অন্যের জন্য ত্যাগ করাকে বোকামি ভাবি! অথচ ইসলাম সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল মুসলিমদের ভালোবাসাময় হৃদয় ও মহানুভবতার জন্য। যখন মক্কা বিজয় হলো তখন আল্লাহর রাসূল চাইলেই সেই সময় কাফির ও মুশরিকদের হত্যা বা বন্দী করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন; যা রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল মক্কাবাসীদের। রাসূলের এই মহানুভবতার জন্য ইসলামের চিরশত্রু আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবাহ যিনি ওহুদের যুদ্ধে রাসূলের সবচেয়ে প্রিয় শহীদ চাচা হামজা রা:-এর বুক ফেড়ে কলিজা বের করে চিবিয়ে ফেলেছিলেন! অবশ্য পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের বিজয়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবাহই নারী হয়েও পরবর্তীতে অসীম সাহসের মাধ্যমে বিভিন্ন যুদ্ধে সরাসরি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলামের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। কোনো এক যুদ্ধে হিন্দা রাসূল সা:-কে কাফেরদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং তার সামনে ঢাল হয়ে ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছিলেন, ‘আমি যেদিকে তাকাই শুধু হিন্দাকেই দেখতে পেয়েছিলাম।’

রাসূলের কাছে বাইয়াত নেয়ার সময় হিন্দা বিনতে উতবাহ নবীজী সা:-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! জমিনের বুকে তার চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে কেউ ছিল না যে আপনাকে অপমান করতে পারে। অতঃপর আজকের দিনে জমিনের বুকে আমার কাছে সেই অধিক প্রিয় আপনাকে যে অপমান করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।’
এখানে খেয়াল করুন, আল্লাহর রাসূলের চরম শত্রু যিনি রাসূলের মুজাহিদ চাচার কলিজা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি কীভাবে আল্লাহর রাসূলের মানবিক গুণাবলি তথা ক্ষমা, মহানুভবতা ও মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার জন্য সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন হয়ে গেলেন। যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তিনি জালিম থেকে একজন মুখলেস মানুষে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন।
আমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আল্লাহ তায়ালা জাহেল আরব জাতিকে মানব জাতির নেতৃত্ব এবং নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করেছিলেন? জাহেলি যুগের আরবের লোকদের চারিত্রিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী জনপ্রিয় সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুমে উল্লেখ করেন- ‘এটা স্বীকৃত সত্য যে, আরবের লোকদের মধ্যে ঘৃণা ও নিন্দনীয় অভ্যাসসমূহ পাওয়া যেত এবং এমন সব কাজ তারা করত যা বিবেক বুদ্ধি মোটেও অনুমোদন করত না। তবে তাদের মধ্যে এমন কিছু চারিত্রিক গুণাবলি ছিল যা রীতিমতো বিস্ময়কর।’ তিনি তাদের সেই বিস্ময়কর চারিত্রিক গুণাবলির উল্লেখ করতে গিয়ে নিচের মানবিক গুণাবলির উল্লেখ করেন-

১. দয়া ও দানশীলতা; ২. অঙ্গীকার পালন; ৩. আত্মমর্যাদার বিষয়ে সচেতনতা; ৪. প্রতিজ্ঞা রক্ষা; ৫. সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতামূলক প্রজ্ঞা; ৬. বেদুইনসুলভ সরলতা।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা মনে করি জাজিরাতুল আরবের সাথে পুরো বিশ্বের যে ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল সেটি ছাড়া উল্লিখিত চারিত্রিক গুণাবলির কারণেই তাদেরকে মানব জাতির নেতৃত্ব এবং নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। এসব গুণাবলির জন্য যদিও তারা হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত এবং অঘটন ঘটাত তবুও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এসব গুণাবলি ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এসব গুণাবলি ও চারিত্রিক শক্তি ছাড়া বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও অকল্যাণ দূর করে ন্যায়-নীতি ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’
তাই তো দেখা যায়, অমুসলিম থাকা অবস্থায় হিন্দা ইসলামের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষী সত্ত্বেও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নারী ছিলেন। নারী জাতির প্রতি ছিল তার তীব্র সহানুভূতি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর কন্যা জায়নাবের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের সময় তিনি তাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এমনকি হিন্দা তাকে বলেছিলেন, ‘ওহে মুহাম্মাদের মেয়ে! মদিনায় তোমার পিতার নিকট যেতে যদি কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয়, তবে বলো। পুরুষদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ তা নারীদের সম্পর্কে কোনোরকম প্রভাব ফেলে না।’ (সূত্র : উইকিপেডিয়া)

সমাজে মানুষ আছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে যেন মানবিকতা নেই। আমরা প্রতিবেশীকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়ার জন্য দাওয়াত দেই, কিন্তু তাকে ভালোবেসে তার আর্থিক অনটন দূর করতে সচেষ্ট হই না। আমরা অফিসে পাশের কলিগকে বিভিন্ন দোয়া দরুদ শিখিয়ে অল্প সময়ে অনেক সওয়াব কামাইয়ের পথ বাতলে দেই, কিন্তু ভালোবেসে তার কাজের বোঝা কমিয়ে তাকে একটু প্রশান্তি দিতে আগ্রহী হই না। নিজেকে ও নিজের পরিবারের বাইরে আর কাউকে ভালোবাসা মানুষ যেন ভুলে গেছে। আর যারা ভালোবাসা দেখায় তাদের ভালোবাসার মধ্যেও কেমন যেন একটি মেকিভাব থাকে। হৃদয়ের নিগড় থেকে সেই ভালোবাসা আসে কিনা সন্দেহ! আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসার শিক্ষা আল্লাহর রাসূল তার সাহাবিদের দিয়েছিলেন সেটি যেন বর্তমান পৃথিবীর মুসলিমরা ভুলে গেছে।
উমর ইবনে খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দারদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছেন, যারা নবীও নন এবং শহীদও নন, কিন্তু কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে তাদের মর্যাদার কারণে নবী ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন।’ সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাদের অবহিত করুন তারা কারা? রাসূল সা: বললেন, ‘তারা ওইসব লোক, যারা আল্লাহর মহব্বতে পরস্পরকে ভালোবাসে, অথচ তারা পরস্পরের আত্মীয়ও নয় এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক কোনো সম্পদের লেনাদেনাও নেই। আল্লাহর শপথ! তাদের মুখমণ্ডল যেন নূর এবং তারা নূরের আসনে উপবেশন করবে। যখন অন্যান্য মানুষ ভীত থাকবে তখন তারা ভীত হবে না। তারা দুশ্চিন্তায় পড়বে না, অথচ তখন মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকবে।’ তারপর রাসূল সা: এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, ‘জেনে রেখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না।’ (সূরা ইউনুস, আবু দাউদ-৩৬২৭)

ইসলাম মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে সবচেয়ে বেশি। অথচ আজ আমরা মুসলিমরা আসলেই কি হৃদয় থেকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি? কেমন যেন ভালো বন্ধু বা ভালো প্রতিবেশী হওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসান আল বান্নার মতে- সমাজকে পরিশোধিত করতে হলে মুমিন হওয়ার পাশাপাশি সবার আগে হৃদয়বান মানুষ হতে হবে। তার জীবনের কথা, কাজ ও কর্মে তার মহানুভবতার গল্পই ফুটে উঠেছে। তিনি তার বন্ধু ও কর্মীদের হৃদয়বান মানুষ হওয়ার আহ্বানই বারবার করেছেন। তরুণ ইমাম হাসান আল বান্না তার লেখায় বলেছেন- ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো সেই, যে মানুষের কল্যাণ এবং মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর মধ্যে কল্যাণ অন্বেষণ করে, তাতেই নিজের কল্যাণ মনে করে।’

এক সাংবাদিক একবার ইমাম বান্নাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, আচ্ছা আপনি নিজের পরিচয় কীভাবে দেবেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি! আমার পরিচয়! আমার পরিচয় হলো আমি এমন একজন পর্যটক, যে হাকিকতকে খুঁজে ফিরছে; জীবনের নিগূঢ় রহস্যকে অনুসন্ধান করছে। আমার পরিচয় হলো আমি এমন সাধারণ মানুষ, যে মানুষের মধ্যে ডায়োজিনিসের বাতি দিয়ে মানবতাকে খুঁজে ফিরছে। আমার পরিচয় আমি এক কপর্দকশূন্য মানুষ, যে নিজের অস্তিত্বের রহস্যকে বুঝতে চায়। আমি ঘোষণা করছি- আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ আল্লাহর জন্য।’
এখানে ডায়োজিনিসের বাতির কথা বলতে গিয়ে হাসান আল বান্না বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস দ্য সিনিকের জীবনে ঘটা ঘটনাকে ইঙ্গিত করেছেন। একদা দিন-দুপুরে ডায়োজিনিস লণ্ঠন হাতে বাজারে উপস্থিত হলেন। দিন-দুপুরে ডায়োজিনিসের হাতে লণ্ঠন দেখে অনেকে হাসতে লাগল। তখন লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই ভরদুপুরে লণ্ঠন হাতে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি উত্তর দিলেন- আমি আসলে মানুষ খুঁজছি। গ্রিসের কোথায় মানুষ পাওয়া যাবে, কেউ বলতে পারবে কি?’

শিক্ষকদের নিয়ে এক আলোচনা সভায় ইমাম হাসান আল বান্না বলেন, ‘জনতার এখন খুব বেশি প্রয়োজন হৃদয়বান মানুষের, যার হৃদয় থেকে তার চারপাশের মানুষের হৃদয়গুলো দীপিত ও আলোকিত হবে। এমন রব্বানি ঝরনাধারা আবশ্যক, যে ঝরনাধারা থেকে তার চারপাশের মানুষগুলো সিক্ত হবে এবং এর মাধ্যমে মানুষের অবস্থার রূপান্তর ঘটবে; ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাবে। ধীরে ধীরে মানুষ ধর্মহীনতার অন্ধকার থেকে দ্বীনের আলো ঝলমল উপত্যকায় চলে আসবে।’
ইমাম হাসান আল বান্না আরো বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইখয়ানুল মুসলিমিন এমন একটি সংগঠন যা মানুষের সেবা এবং সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সব সময় উন্মুখ থাকে।’

(সূত্র: বই- ইখওয়ানুল মুসলিমিন, দাওয়াত, তারবিয়াত ও সংগ্রামের সত্তর বছর, লেখক : ইউসুফ আল কারজাভি)
আমরা সব সময় বলি, আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। অথচ আমরা আসলে জানি না আল্লাহকে ভালোবাসা যায় কীভাবে? আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত মানুষকে দিয়ে, মানুষকে সৎ পথে চলতে বলে এবং অসৎ পথ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমেই আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভালোবাসা বলি। কিন্তু আল্লাহকে ভালোবাসা বলতে আসলে আল্লাহর সৃষ্টি মানবজাতিকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসাই বুঝায়।
ইসলামের মূল মন্ত্রই হচ্ছে মানবিকতার চর্চা। মানুষের ভালো গুণগুলো তথা মানবিক গুণাবলি নিজের মধ্যে লালন ও তার চর্চা করার নামই মূলত ইসলাম। কিন্তু আমরা মুসলিমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, সারা বছরে মাসে একবার রোজা করি কিন্তু আমাদের হৃদয় গরিব, নিঃস্ব সহায়তা দানের জন্য কাতর হয় না। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি না, তাই তো শিসা ঢালা প্রচীরের মতো হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে পারি না। আমরা শুধু আনুষ্ঠানিক ইসলাম নিয়ে ব্যস্ত; কিন্তু ইসলামের যে কোর ভ্যালু তথা পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষের মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধানের কাজ করা; সেখানে একেবারে ব্যর্থ। সে জন্যই কি জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন. ‘ÔIslam is the best religion but Muslim are the worst followers’ অর্থাৎ- ‘ইসলাম হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম কিন্তু মুসলিমরা হচ্ছে সর্বনিকৃষ্ট অনুসারী।’

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও মিসাইল ম্যান এ পি জে আবুল কালাম আজাদ তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘উইংস অব ফায়ার’-এ উল্লেøখ করেন, ‘আমার বাবা সবসময় আমাকে মনে করিয়ে দিতেন কিংবদন্তি আবু বিন আদমের কথা। আবু বিন আদম শান্তির এক গভীর ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন একজন ফেরেশতা সোনার একটি গ্রন্থে সেই ব্যক্তিদের নাম লিখছেন যারা স্রষ্টাকে ভালোবাসে। আবু জানতে চাইলেন তালিকায় তার নাম আছে কি না। ফেরেশতা নেতিবাচক উত্তর দিলেন। হতাশ হলেও তখনো উৎফুল্ল আবু বললেন, সহগামী লোকদের ভালোবাসি এই হিসেবে আমার নাম লেখো। ফেরেশতা লিখলেন তার নাম এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরের রাতে আবারো সবকিছু আলোকিত করে ফেরেশতা এলো। তারপর সেই সব লোকের নামের তালিকা দেখাল যাদের প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা বর্ষিত হয়েছে। তালিকার প্রথমে ছিল আবুর নাম।’

ছোটবেলায় আমরা সম্ভবত সবাই ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিলাম, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকে ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা হক্কুল ইবাদ পালন করে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পারি। তার ক্ষমা পেয়ে যেতে পারি হাজার গুনাহ করার পরও। মানুষকে ভালোবাসার পাশাপাশি অবুঝ প্রাণীদেরকেও ভালোবাসতে জানতে হবে। সারাজীবন ধরে জেনা করা এক মহিলাকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছিলেন শুধু এ জন্য যে, তিনি তৃষ্ণার্ত এক কুকুরকে পানি পান করিয়েছিলেন।
ইসলাম কত সুন্দর মানবিকতা ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয় যা রীতিমতো অবাক করার বিষয়! ভালোবাসা প্রদানের মাধ্যমেই মানুষ মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করতে পারে। এমনকি আপনি যদি কোনো প্রাণীকেও ভালবাসেন সেও আপনাকে ভালোবাসবে। আপনার কথা শুনবে, আপনার আনুগত্য করবে। জাপানি লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগি ‘তোত্তোচান (জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি)’ নামক তার বইয়ে অসাধারণ সততা শেখানোর গল্প তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশি সবসময় তোমোয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের শেখান- ‘খেলাচ্ছলেও পশুপাখির সাথে কখনো প্রতারণা করবে না। যে পশুপাখিরা তোমাদের বিশ্বাস করে তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করবে না। কুকুরকে বলবে হাত তোলো খাবার দেবো। এই বলে তারপর যখন দেবে না তখন কুকুর আর তোমাদের বিশ্বাস করবে না। তার স্বভাব মন্দ হয়ে যাবে।’

মুসলিমদের নিজেদের হৃদয়ে ভালোবাসার চাষ করতে হবে। নিজেদের মানবিক গুণাবলির পরিচর্যার মাধ্যমে এমনভাবে নিজেদের তৈরি করতে হবে, যাদের জীবনের উদ্দেশ্যই হবে মানবসেবা। এই মুহূর্তে Samuel Taylor Coleridge-এর সেই কথা খুব মনে পড়ছে-
‘He prayeth best, who loveth best
All things both great and small;
For the dear God who loveth us,
He made and loveth all.’

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজীপুরে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের তোপের মুখে পিপি-এপিপিদের পদত্যাগ বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসা পাবেন গণঅভ্যুত্থানে আহতরা সাফজয়ী সাবিনাদের পুরস্কার দিলো সাউথইস্ট ব্যাংক সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বন্ধে দেশে কোরআনের আইন চালুর বিকল্প নেই : মুজিবুর সিংগাইরে চাঁদাবাজির মামলায় ২ সংবাদকর্মী জেলহাজতে দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ‘জুটমিল বন্ধ করে শেখ হাসিনা শিল্পাঞ্চলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছেন’ দেশে বিনিয়োগ করলে আমরা পাশে থাকব : ডা. শফিকুর রহমান পলকের গামছা বাঁধা মুখের ছবি তুলতে বাধা পুলিশের 'মীর কাশেম আলী সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ গড়ার কাজ করেছিলেন' সোনার দাম আবারো কমলো

সকল