১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিপ্লব ২৪ ও নারীর ভূমিকা

-


‘নারী’ বলতে একজন পূর্ণবয়স্ক ‘মহিলা’ মানুষকে বোঝায়। মহিলারা আজ ‘মহল’ ছেড়ে মানবের পরিপূর্ণ সত্তায় পরিস্ফুটিত হয়ে দিনে দিনে ‘নারী’ হয়ে উঠেছেন। প্রাপ্তবয়স্ককালে পৌঁছাবার পূর্বে একজন নারীকে ‘মেয়ে’ এবং কৈশোরে তাকে ‘বালিকা’ বলে অভিহিত করা হয়। নারী শব্দটিকে যখন ‘নারী অধিকার’ বা ‘নারী ক্ষমতায়ন’ অর্থে ব্যবহার করা হয়, বয়সের ব্যাপারটি তখন গৌণ হয়ে যায় এবং তার ব্যক্তিক বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়।
‘ক্ষমতায়ন’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সবরকম দায়দায়িত্ব বা সমাজ গঠনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। আর নারীর ক্ষমতায়ন কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো নারীকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সবরকম দায়দায়িত্ব বা সমাজ গঠনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। নারীর ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে সমাজে সমূহ উন্নতি সম্ভব। অর্থাৎ বর্তমান প্রেক্ষিতে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আজ থেকে দুই শত বছর আগে ফরাসি সামরিক জেনারেল ও সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন- ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো।’ শুধু দুই শত বছর কেন, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এটাই প্রমাণিত যে, একজন শিক্ষিত নারী পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর সেই শিক্ষার কল্যাণে যদি নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়, তাহলে জাতি এক অন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয় সহজেই।

প্রাচীন কুসংস্কারযুক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর শিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না, ছিল না ক্ষমতায়নের কোনো উদ্যোগ। কিন্তু যুগে যুগে বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, বেগম রোকেয়া প্রমুখগণের চেষ্টায় নারী শিক্ষার অগ্রগতি সাধন হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আধুনিক সমাজে নারী শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের (Women Empowerment) ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবার পর পরই বাংলাদেশ সরকার নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে দশ ভাগ কোটা নারীর জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে মহিলাবিষয়ক স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। সরকার নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গেজেটেড পদে ১০% এবং নন গেজেটেড পদে ১৫% কোটা নির্ধারণ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০% নিয়োগ নারীদের জন্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়াও দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সরকারি প্রচেষ্টা, বেসরকারি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকারকে অনেকখানি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সমাজে নারীর রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষিত হয়েেেছ, সুরক্ষিত হয়েছে পারিবারিক যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সামুহিক যোগ্যতা। প্রকৃতপক্ষে, নারীর ক্ষমতায়ন হলো শিক্ষার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিকসহ জীবনের বিভিন্ন কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে নারী সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে নিজেরাই নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।

সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ নারী ক্ষমতায়ন ছাড়া এককভাবে পুরুষদের অংশগ্রহণে সমাজের উন্নতি সুষ্ঠুভাবে সংঘটিত হতে পারে না। তাই নারীর ক্ষমতায়নের আবশ্যিকতা পরিলক্ষিত হয়। নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য যেসব দিক বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়, তার মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে যতদিন লিঙ্গবৈষম্য থাকবে ততদিন নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভবপর নয়। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর ক্ষমতায়ন করতে হলে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ বা নারী-পুরুষ বিভেদ আগে দূর করতে হবে।
অধিকাংশ পরিবারে পুরুষের দ্বারা মহিলারা অত্যাচারিত হয়। তাই সর্বপ্রথম পরিবারের অত্যাচার এবং পারিবারিক বৈষম্য দূর করার জন্য পারিবারিক সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষভাবে প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পরিবারের পাশাপাশি সমাজেও নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। তাই নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য হলো সর্বাবস্থায় নারীর সুরক্ষা ও তাদের জীবন বিকাশকে সমুন্নত রাখা।
নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যদূরীকরণ সম্ভবপর হয়। নারীরা শিক্ষিত হলে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। যেই পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কর্মজীবী, সেই পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল থাকে, ফলে পরিবার-পরিজনের মধ্যে পারিবারিক শান্তি বিরাজ করে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা নিজেরাই আজ স্বজাতির সঙ্কট উত্তরণে প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করে আসছে।

সাধারণত বাংলাদেশের আন্দোলনগুলোতে, মিছিলে, স্লোগানে খুব বেশি নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায় না; কিন্তু বিগত সরকারের পনের বছরের শাসন ইতি টানার জন্য হাজার হাজার মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছিল, তখন সেই আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক নারীর সরব অংশগ্রহণ বিশ্ব অবাক চোখে দেখেছে। অসংখ্য নারী পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে রাস্তায় নেমে বৈষম্যবিরোধী স্লোগান দিয়েছে। বিশ্লেষকরা আন্দোলনে নারীদের এই অংশগ্রহণের বিষয়টিকে নারীর অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের একজন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ফারজানা লিও একজন পেশাদার বডিবিল্ডার। তিনি নিজে কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন ও স্লোগান দিয়েছেন। সোস্যাল মিডিয়ার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফারজানা লিও স্লোগান দিচ্ছেন- ‘এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার’। তিনি মনে করেন, এই আন্দোলনের সাথে নারীরা যদি একাত্ম না হতো তাহলে পতিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হতো না। নারীরা যখন ব্যাপক সংখ্যায় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে যায় তখন তাদের পক্ষে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।

ফারাজনা লিও কখনোই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না। নিরাপত্তাবাহিনী যেভাবে বিক্ষোভকারী ছাত্রদেরকে গুলি করে মেরেছে সেটি দেখে বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। এই বিষয়টি তাকে রাস্তায় টেনে নামিয়েছে। ফারজানা লিও বলছিলেন-
‘আমি মনে করেছি যে, রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলেদের রক্ষা করতে হবে।’
রাস্তায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আন্দোলন করতে দেখে তিনিও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ যতই বাড়ছিল, সেটি পুরুষদের মনেও সাহস জোগাচ্ছিল।
তিনি আরো বলেন, ‘বহু নারী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে আবার অনেকে বাড়িতে থেকেও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। সন্তান যখন তার মায়ের দিক থেকে সাপোর্ট পায় তখন কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারে না। মায়ের দিক থেকে যখন আপনি সাপোর্ট পাবেন, তখন সন্তান বলেন আর সহকর্মী বলেন, সবারই বুকের সিনা টান হয়ে যায়। মা যদি সাহস দেয় যে তুমি যাও, তুমি না গেলে দেশের কী হবে? তুমি না গেলে এই দেশকে কে রক্ষা করবে? এই সাহসটা তো ঘর থেকে আসতে হবে। আপনি যদি ঘর থেকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখেন, তাহলে সে কী করে সামনে এগোবে?’

কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়- ‘কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারি; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ালক্ষ্মী নারী।’ আসলেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবখানেই আজ নারীর সরব উপস্থিতিই নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তার কাজের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সমন্বিত শিক্ষার প্রয়াস নারীকে এগিয়ে নেবে সহজেই। আমরা জানি, যখন একটি শিশুর জন্ম হয় তখন নবাগত শিশুর সাথে সাথে একজন মায়েরও জন্ম হয়। এ ছাড়া স্ত্রী, বোন, কন্যাসহ মর্যাদাপূর্ণ সব সম্পর্কের বাঁধনে নারীরা সমাজের সাথে আবদ্ধ। এ লক্ষ্যে তাদের প্রতিভা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সমাজে ও রাষ্ট্রের বৃহৎ পরিসরে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় সবার সচেতনতা বৃদ্ধি, সর্বাবস্থায় নারীর নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদান করতে হবে, যাতে করে নারী নির্যাতনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের উচিত নারী ও শিশুবিষয়ক বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং সময়োপযোগী কঠোর আইনসহ এ বিষয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অচিরেই নারী নির্যাতন বন্ধ, যৌন হয়রানি রোধ, বেসরকারি চাকরিতে মাতৃত্বকালীন ছুটির নিশ্চয়তা নারীর ক্ষতায়নেরর পথ সুগম করবে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সুপরিকল্পিত কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মসংস্থানে নারীর নিরাপত্তা, সমানাধিকার প্রদান এবং সমান মজুরি প্রদানের মাধ্যমে নারীকে উৎপাদনশীল কর্মে যোগদানের সুযোগ করে দিতে হবে।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলেজ অধ্যক্ষ


আরো সংবাদ



premium cement
গাজীপুরে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের তোপের মুখে পিপি-এপিপিদের পদত্যাগ বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসা পাবেন গণঅভ্যুত্থানে আহতরা সাফজয়ী সাবিনাদের পুরস্কার দিলো সাউথইস্ট ব্যাংক সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বন্ধে দেশে কোরআনের আইন চালুর বিকল্প নেই : মুজিবুর সিংগাইরে চাঁদাবাজির মামলায় ২ সংবাদকর্মী জেলহাজতে দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ‘জুটমিল বন্ধ করে শেখ হাসিনা শিল্পাঞ্চলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছেন’ দেশে বিনিয়োগ করলে আমরা পাশে থাকব : ডা. শফিকুর রহমান পলকের গামছা বাঁধা মুখের ছবি তুলতে বাধা পুলিশের 'মীর কাশেম আলী সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ গড়ার কাজ করেছিলেন' সোনার দাম আবারো কমলো

সকল