জনগণের সরকার বনাম স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সরকার এবং বিভক্ত সমাজ
- আবদুল আউয়াল মিন্টু
- ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কেবল দেশের আর্থিক খাত বা অর্থনীতি নয়, বরং একই সাথে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক শাসনব্যবস্থাকে অপশাসন ও সুশাসনের পরিবর্তে কুশাসনে পরিণত করে। ফলস্বরূপ, “জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার ও জনগণের জন্য” প্রজাতন্ত্রের নামধারী বাংলাদেশ, এই মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে এক নতুন ধরনের সরকার। যাকে বলা যায়; আত্ম-স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা, আত্ম-স্বার্থান্বেষীদের সরকার এবং আত্ম-স্বার্থান্বেষীদের জন্য”
দেশের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত অর্থে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। জনস্বার্থে কাজ করার পরিবর্তে, এসব প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন দল, তাদের মিত্র, আত্মস্বার্থ সন্ধানী ও তাদের সমর্থকদের সাথে মিলেমিশে অবাধে দেশের সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। একই সাথে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করায় কোনো ত্রুটি করেনি। তারা সদা-সর্বদা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে একত্রে মিলেমিশে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত ছিল। স্থানীয় বা কেন্দ্র, যেকোনো পর্যায়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গত ১৫ বছরের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে সহজেই এই উপসংহারে আসা যায় যে; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণকে সেবা দিতে দুর্বল, অকার্যকর বা অক্ষম হয়ে পড়েছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল পুরোপুরি আত্মস্বার্থ ও স্বার্থান্বেষী মহলের কব্জায়। পরিণতিতে জনগণের প্রত্যাশিত সুশাসনের পরিবর্তে, শাসকদল ও স্বার্থান্বেষী মহল একত্রে মিলেমিশে এমন এক নিম্নমানের কুশাসন প্রবর্তন করেছিল, যা বস্তুত ব্যর্থ রাষ্ট্রের পূর্ব লক্ষণ বা সাঙ্কেতিক চিহ্ন।
এই ধরনের কুশাসন সাধারণ নিয়মেই প্রভাবশালী রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী, তাদের মিত্র, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী, স্বার্থান্বেষী, আত্মস্বার্থান্বেষী ও সুযোগ সন্ধানকারীদের জন্য উর্বর ভূমি সৃষ্টি করে। যাদের আমি আত্মস্বার্থান্বেষী বা বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই গোষ্ঠীকে খাজনা সন্ধানকারী (Rent Seekers) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ গোষ্ঠী সাধারণ নিয়মেই দেশের জন্য নিজেরা কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না। তবে তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে নিজেদের জন্য সম্পদ অর্জন করে। নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। দুঃখের বিষয় হলো যে এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে অনৈতিকভাবে সম্পদ অর্জনের সব সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বলা যায় লাগামহীনভাবে।
দুর্ভাগ্যবশত, এই গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা কেবল ধন-সম্পদ অর্জনে ব্যস্ত ছিল তাই নয়। একই সাথে তারা সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া, নিজেদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নতুন পশ্চাদমুখী বিধিবিধান প্রণয়ন, কোথায় কার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করবে বা করা হবে না, আইন প্রয়োগ করলে তার রায় কী হবে ইত্যাদি সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এককথায় তারা সরকারি কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। অন্যভাবে বলা যায় যে এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কেবল দেশের আর্থিক খাত বা অর্থনীতি নয় বরং একই সাথে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক শাসনব্যবস্থাকে অপশাসন ও সুশাসনের পরিবর্তে কুশাসনে পরিণত করে। ফলস্বরূপ, “জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার ও জনগণের জন্য” প্রজাতন্ত্রের নামধারী বাংলাদেশ, এই মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে এক নতুন ধরনের সরকার। যাকে বলা যায়; আত্মস্বার্থান্বেষীদের দ্বারা, আত্মস্বার্থান্বেষীদের সরকার এবং আত্মস্বার্থান্বেষীদের জন্য”।
এই বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্যরা দিনের পর দিন, যতই প্রভাবশালী ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, ততই তারা দুর্বল ও অকার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বহুমাত্রিক পশ্চাদমুখী নীতি ও বিধিমালা জারি করতে বাধ্য করে। এমনকি পশ্চাদমুখী আইন প্রণয়নের জন্য সরকার ও সংসদকে প্ররোচিত করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিল। তাদের জন্য এটা তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না। কেননা এক ব্যক্তি শাসিত বাংলাদেশের সংসদ আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা ছিল না। সংসদ নামক ওই প্রতিষ্ঠান কেবল দুর্নীতিবাজ ও আত্মস্বার্থান্বেষী আমলা গোষ্ঠী কর্তৃক প্রণীত, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত আইন পাসের জন্য নামে মাত্র সংসদ ও সাংবিধানিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সংসদ ছিল নামে, কাজে কেবল একটি বংশবদ প্রতিষ্ঠান। আত্মস্বার্থসন্ধানকারীরা যত শক্তিশালী হয়েছে, ততই দমনমূলক আইন, পশ্চাদমুখী বিধিবিধান ও প্রবিধানের বিস্তার বেড়েছে। এটা বলাবহুল্য যে, পশ্চাদমুখী বিধিবিধান সব সময় ক্ষমতাসীন দলের সদস্য, তাদের মিত্র ও আত্মস্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করে। তাই ক্রমান্বয়ে ও উত্তরোত্তর দেশ ও জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে, তাদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। নিত্য নতুন সুযোগ সৃষ্টিকারী বিধিবিধান বলে বলীয়ান হয়ে এই গোষ্ঠী কারও কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। বলতে গেলে অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি যাই করুক না কেন, তারা ছিল দায়মুক্ত।
একইভাবে ওই সব বিধিবিধান বলে বলিয়ান হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো, নিয়মিত-প্রতিনিয়ত বিশেষ স্বর্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা ও সমুন্নত রাখাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিল। অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির জন্য কোনো স্তরে কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। কেননা এই গোষ্ঠী অবৈধ শাসক দলের সমর্থিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, সরকারি কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ধরে নেন যে তারাও অন্যায় ও দুর্নীতি জন্য দায়মুক্তি উপভোগ করেন। ফলস্বরূপ, মানুষের চরিত্রের নিয়ামুনাযায়ী নিজস্ব লোভ লালসা থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেরাও দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনে আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছিল। তাই সাধারণ জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তাদের বিবেকের কোনো বাধা ছিল না। এমনকি দমন ও নিপীড়ন করতে কোনো কার্পণ্য করে নাই। উদাহরণস্বরূপ, দেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অকুণ্ঠচিত্তে বিরোধীদের নির্যাতন, অবৈধভাবে আটক, জোরপূর্বক অন্তর্ধান, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্দোষ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক, গায়েবি বা মিথ্যা মামলা দায়েরসহ সব অপকর্মের জন্য সাময়িকভাবে নিজেদের দায়মুক্তি উপভোগ করে।
বিচার বিভাগ ক্ষেত্রেও তাই। লাখ লাখ মিথ্যা মামলা দায়ের করা সত্ত্বেও, এমনকি আসামি হিসেবে মৃত ব্যক্তি বা বিদেশে থাকা নির্দোষ ব্যক্তির নাম এই সব মামলায় অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও তথাকথিত বিচারালয়ে বিচারক নামক মানুষগুলোকে কোনো দিন প্রশ্ন করতে শোনা যায়নি যে; “আসামি যদি মৃত বা বিদেশে অবস্থান করে, তাহলে সে কিভাবে ঘটনায় জড়িত ছিল”। মূল কথা হলো; মিথ্যা মামলায় জড়ানো অথবা লাখ লাখ আসামিকে অজ্ঞাত বলে অভিযোগপত্র দায়ের করার অর্থ হলো; এক দিকে ইচ্ছানুসারে দমন-নিপীড়ন এবং অন্য দিকে পুলিশ বাহিনীর জন্য এক বড় ব্যবসা। অর্থাৎ কোনো সম্পদ সৃষ্টি না করেই সম্পদ অর্জনকে (দুর্নীতি) একটা ব্যবসা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কালক্রমে যদি দুর্নীতিতে জড়িত শাসকদলের কোন সদস্য অথবা তাদের সমর্থিত কোনো ব্যক্তির দুর্নীতি প্রকাশ্যে চলে আসে তাহলে তারা একমাত্র তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। দুই-একদিন পত্রপত্রিকায় একমাত্র তাকে নিয়ে হাউ-মাউ-কাউ চলার পর জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে বা ওই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য নতুন একটা ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসত। সংবাদ ও ইলেট্রোনিক মিডিয়া সবই তাদের নিয়ন্ত্রিত ছিল বিধায়, তাদের জন্য এটা কোনো অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে একজন গবেষক ও কলামিস্ট কল্লোল মুস্তাফা লিখেন যে; ‘বাংলাদেশে যেভাবে দুর্নীতি উপস্থাপন করা হয় তা হলো শুধু একজন ব্যক্তির অপকর্ম। যদি কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়, তবে কেবল তার বিরুদ্ধে তদন্ত করাই যথেষ্ট নয়। এই ধরনের অপরাধে যারা তাকে সমর্থন করেছিল বা তার সাথে জড়িত ছিল তাদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, দুর্নীতিবাজদের একে-অপরের সাথে যোগসাজশ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা এসবই দুর্নীতির অংশ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ জনগণকে সেবা দেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে মাত্র একজন ব্যক্তির দুর্নীতির ফল হিসেবে দেখি, তাহলে কখনই সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল বা কমানো যাবে না। যেমন ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটকে কোনোভাবেই একক ব্যক্তির অপকর্ম বা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।”
কব্জাকৃত সামাজিক ও বেসরকারি সংগঠন
শাসক দল কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে থেমে যায়নি। একই সাথে তারা বেসরকারি সংস্থা যেমন এফবিসিসিআই, বায়রা, হজ এজেন্সি, জেলা চেম্বার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নের মাধ্যমে দেশে উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধিতে নিয়োজিত খাতওয়ারি সংগঠনগুলোকেও এ থেকে মুক্তি দেয় নাই। শাসক দলের সমর্থক এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এগুলো দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের মতোই বিনা-নির্বাচনে অথবা প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় ব্যক্তিরা এগুলো দখল করে নিয়েছিল। ফলস্বরূপ, সরকারি, বেসরকারি, এমনকি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যেগুলো জনসেবা ও জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত, যেমন বাজার, স্কুল, মসজিদ, এতিমখানা, খেলাধুলার ক্লাব ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা দখল করে নিয়েছিল। একই সাথে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বেআইনি ব্যবহার বা অপব্যবহার থেকে সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো, সক্রিয় ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে দ্বিধা করেনি।
এসব দেখে মনে হয়েছিল যে আমাদের দেশে মনে হয় লজ্জা-শরম বলতে আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। নতুন প্রজন্মের সামনে ন্যায়-অন্যায় ও নিয়ম-অনিয়মের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা অচেনা শব্দ। কারণ সমাজে অনেকের ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে বাংলাদেশে অন্যায় বা অনিয়ম অনেকটা ন্যায় ও নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। যেমন বিদ্যুৎ-পানির বিল ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দিবে এবং ঘুষ দিলে আবার কমিয়ে দেবে। এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি, জমির জমা-খারিজ ও নামজারি থেকে আরম্ভ করে ট্রেড লাইসেন্সের পুনঃনবায়ন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি, জেলখানায় শোয়ার জন্য তিন ফিট থেকে চার ফিট জায়গা বরাদ্দ পাওয়া, আয়কর থেকে ভ্যাট, অর্থাৎ জীবন-যাপনের সর্ব ক্ষেত্রেই এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
আমার বিশ্বাস পাঠকবৃন্দ তাদের টিভি পর্দায় ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে মতবিনিময়ের একটা দৃশ্য দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন। শিল্প ও বাণিজ্য খাতের নামীদামি অনেকেই মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে অনেকেই সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিল। দুঃখের বিষয় এসব বিখ্যাত ব্যবসায়ী বা নেতাদের অনেকেই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ‘জমি, নদী ও খাল-বিল দখলদার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠনকারী, ঋণ খেলাপি ও কর ফাঁকি দেয়া, চোরাচালান ও অর্থ পাচারকারী এবং অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনকারী হিসেবে পরিচিত। এই গোষ্ঠীর অনেকেই দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টি না করেই নিজেদের জন্য সম্পদ অর্জন ও অর্থবিত্তে নিজেকে বলিয়ান করেছে। তাদের অনেকে অর্থ পাচারকারী’ হিসেবে বেশ সুপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, এদের বেশির ভাগই অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেটের সদস্য। অনেকে ধারণা করতেন যে তারা পুলিশ, কোর্ট-কাচারী, এমনকি আইনের ঊর্ধ্বে। ফলে তাদের অনেকেই অগাধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল সরকার সমর্থিত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্য। সরকারের সমর্থনে তারা ছিলেন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাধারী।
শীর্ষ সম্মেলনে তারা কোরাস-গার্লদের (Chorus-Girls) মতো উচ্চস্বরে স্লোগান দিচ্ছিল। অনেকে কবিতা বা গানের মতো বক্তৃতা করেছেন। যেমন ‘শেখ হাসিনা সরকার-বারবার দরকার”। বাস্তবে, তাদের মধ্যে সামান্য দুই-চারজন ছাড়া অন্যরা তেমন কোনো প্রকৃত ব্যবসায়ী ছিল না, নেতাতো দূরের কথা। বরং বলা যায় এই অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীরা নিজেরাই নিজেদের নেতা বানিয়েছে। তারা সবাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের সহচর বা ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্য। এক কথায় সরকার সমর্থক বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্য। এটাই ছিল পালিয়ে যাওয়ার সরকারের শাসনামলের বাস্তবতা।
একই অবস্থা অন্যসব পেশাদার গোষ্ঠী ও অন্যান্য খাতের অবস্থা ছিল একই। তা হোক, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, প্রকৌশল, শিক্ষা, আবাসন, ব্যাংক, বীমা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিকসহ সব খাতেই একই চিত্র।
উদ্যম, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবন এবং দক্ষতা অনুশীলনের পথে প্রতিবন্ধকতা
পশ্চাদমুখী নিয়মকানুন ও বিধি-বিধান দ্বারা সজ্জিত এবং বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক পরিবেষ্টিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দেশের জনগণের উদ্যম, উদ্যোগ, উদ্ভাবনী শক্তি ও সামর্থ্য, উৎপাদনশীলতা, সমতা ও দক্ষতা ইত্যাদি ব্যবহার ও অনুশীলনের পথে বহুমুখী বাধা সৃষ্টি করে। ফলে দেশের জনগণের মনোজগতে এক ধরনের অচলায়ন ও অনাস্থা সৃষ্টি করেছিল। বৃহত্তর অর্থে, এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে পর্বতসমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একই সাথে এসব শক্তিশালী সিন্ডিকেট গোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন, কর ফাঁকি, চোরাচালান, মুদ্রা পাচারসহ যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য পশ্চাদমুখী বিধি-বিধান সম্বলিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাতিয়ার বা যন্ত্রের মতো লাগামহীনভাবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি। আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করলেও তখন কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করেনি বা ক্ষমতা ছিল না, অথবা প্রতিষ্ঠানের হর্তা-কর্তারা ছিল তাদের সহযোগী। তাদের অবস্থান বিধি-বিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যতই দুর্বল করা হয়েছে, ততই রাজনৈতিক অপরাধী, আত্মস্বার্থ অন্বেষণকারী ও সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠীর সদস্যরা, ততই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যারা অবৈধ অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক শক্তির সংমিশ্রণে শক্তিশালী ছিলেন। তারা আরো বেশি অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। অন্যরা নিত্যনিয়ত আরো বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা আরো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পরিণতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা; সমতা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনশীলতা বৃদ্ধি করে দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টির পথে ক্রমবর্ধিত হারে বাধার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও জীবনমান উন্নয়নের পথে সুযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টিকারীরা বনে যান অসহায়, ক্ষমতাহীন। অন্য দিকে অবৈধ সম্পদের মালিকরা বনে যান ক্ষমতাবান। ক্ষমতার এই মালিকানা আর্থিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অর্থাৎ সমাজের সর্বক্ষেত্রে। ফলে রাজনীতিবিহীন আইনের শাসনের পরিবর্তে আইন দ্বারা শাসিত সমাজে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে যার মূল্য হয়তোবা সাধারণ জনগণকে দীর্ঘদিন দিতে হবে।
সম্ভাবনাময় দেশ থেকে সব সম্ভবের দেশে রূপান্তর- বাহামা গরুর গল্প
বর্ণিত পরিস্থিতি বোঝার জন্য, একটি উদাহরণ পাঠকদের জন্য উপযুক্ত বা যথেষ্ট হতে পারে। কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবাদিপশুর জাত (গরু এবং মহিষ) উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সংকর বা অকুলীন (hybrid) জাত উন্নয়নের জন্য বিদেশী জাতের কোনো জীবিত গরু, মহিষ, ছাগল, এমনকি হিমায়িত বীর্য আমদানি করা অতীব প্রয়োজন। এই গবেষণার একমাত্র লক্ষ্য হলো দুধ ও গোশতের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের দৈনন্দিন আবহাওয়া, জলবায়ু, দেশীয় খাদ্য, পশুপালনে ও স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মালিকদের ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য, সবমিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত জাত উদ্ভাবন করা। যাতে দেশে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে দুধ ও গোশত উৎপাদন বাড়ানো যায়। আমদানি করার লক্ষ্যে বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয় নাই। অথচ খাল-বিল দখলদার এবং ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্য সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসাইনের জন্য যেকোনো জাতের গরু, মহিষ বা ছাগল আমদানিতে কোনো বাধা ছিল না। সেটা স্থলবন্দর, নদীবন্দর বা বিমানপথে যেভাবেই হোক তার জন্য তেমন কোনো বাধা ছিল না। সে যেকোনো জাতের গরু-মহিষ-ছাগল, যেকোনো দেশ থেকে আমদানিতে তার জন্য সমস্যা ছিল না।
কয়েক মাস আগে, সে অবৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমানে করে ব্রাহামা জাতের ১৫টি গরু নিয়ে এসেছিল। সাধারণত, এই পশুগুলো অতি সহজেই শুল্ক কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড় করে নেয়া তার পক্ষে কোনো অসম্ভব কিছু ছিল না। তবে সমস্যা হয়েছিল বিমান থেকে নামানোর সময় কয়েকটি গরুর রশি ছিড়ে যায় এবং বিমানবন্দরের রানওয়েতে এদিক-সেদিক বিভিন্ন দিকে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে। তাতে কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে বিমানবন্দর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। খবরটি সবার নজরে আসার পর শুল্ক কর্তৃপক্ষ গরু আমদানির বিভিন্ন ছাড়পত্রকে জাল হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তিতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গরুগুলোকে সাভারের সরকার পরিচালিত গবাদিপশু খামারের তত্ত্বাবধানে রাখার অনুমতি সাপেক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়। জাল-জালিয়াতি করে আমদানি করা সত্ত্বেও সরকারি কোনো সংস্থাই অবৈধভাবে নিষিদ্ধ গরু আমদানির জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো রকম আইনি ব্যবস্থা নেয়নি বা নিতে সক্ষম হয়নি।
এর কিছুদিন পরেই ২০২৪ সালে কোরবানি ঈদের কয়েক দিন আগে সাভার ডেইরি ফার্ম একটি প্রহসনমূলক নিলামের মাধ্যমে গরুগুলো ইমরান হোসেনের কাছে বিক্রয় করে দেয়। আদালত কর্তৃক নিযুক্ত গরুগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সাভার সরকারি খামারের কর্মকর্তারাই এই উপায় বের করে। আশা করি পাঠকেরা অনুধাবন করবেন যে আমদানির সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে নিষিদ্ধ গরু আমদানির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা আদালত তাকে এই বেআইনি কাজের জন্য কোনো শাস্তি দেয়নি। বরং প্রহসনমূলক টেন্ডার করার অনুমতি দিয়ে তাকেই গরুগুলো পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট যে, কিভাবে স্বার্থান্বেষী মহলের সদস্যদের পক্ষে সবকিছু সম্ভব ছিল। অন্যায় অবিচার বা বেআইনি সব কিছুই তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অভিজাতদের সাথে তাদের অন্তরঙ্গতা বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য তখন সব কিছুই সম্ভব ছিল। এটি আরো প্রমাণ করে যে, একটি ‘সম্ভাবনার দেশ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ’ ছিল বল্লে মোটেই ভুল হবে না।
সরকারি দলের আনুকূল্যে থেকে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে মিলেমিশে, কোনো ধরনের শাস্তি ছাড়া এই ধরনের বেআইনি কার্যকলাপ বিশ্বের কোনো দেশেই সম্ভব নয়। এতে আরো প্রমাণ হয় যে ‘আইনের শাসন’ বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আর বাংলাদেশে অবশিষ্ট ছিল না। অতএব, সহজেই অনুমেয় যে, অনির্বাচিত বা অবৈধ সরকার দেশে ‘আইনের শাসনের পরিবর্তে দেশকে আইন দ্বারা শাসিত দেশে’ পরিণত করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছে শাসক দলের অভিজাত মহল, তাদের মিত্র এবং স্বার্থান্বেষী বিশেষ গোষ্ঠী কর্তৃক সব সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে অকার্যকর করে দেয়ার মাধ্যমে। এই পরিস্থিতি কেবল প্রাণিসম্পদ বিভাগে নয় বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত দেশের সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একই। এমনকি বিচার বিভাগও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
চতুর্মুখী বিভক্ত সমাজ- লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিণতি
কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমাদের সমাজ ছিল সংযোগশীল (Cohesive) ও ভ্রাতৃবৎ (Brotherly)। ওপরে বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বা পরিণতিস্বরূপ এখন সেই জনসমাজ খাঁড়া (Vertical) এবং অনুভূমিক (Horizontal) ভাবে বিভক্ত সমাজে পরিণত হয়েছে। এই বিভাজন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো; সমাজকে দুর্বল করে একদলীয় ও একক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা এবং দলীয় স্বার্থ ও অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য অর্জনে। এই বিভাজন কেবল ‘দুটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর’ মাঝে নয়, বরং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন স্তরে। যেমন- ধনী-গরিবসহ প্রতিটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের মাঝে। শাসক দল নিজ স্বার্থে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাণ্ডজ্ঞান বহির্ভূত ইস্যুকে সামনে নিয়ে এনে, ইচ্ছাকৃতভাবেই জনসমাজকে বিভক্ত করেছে। একান্তভাবেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার লক্ষ্য অর্জনে। যেমন; বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ; স্বাধীনতাপন্থী বনাম স্বাধীনতাবিরোধী; স্বাধীনতার চেতনা বনাম স্বাধীনতার বিরোধী চেতনা, মানবতাবিরোধী ও তাদের সমর্থক বনাম মানবতা সমুন্নতকারী; গণতন্ত্র বনাম উন্নয়ন, ধর্মীয় অনুভূতি বনাম মৌলবাদী বা জঙ্গি, পাকিস্তানের বন্ধু বনাম হিন্দুস্তানের বন্ধু, সংখ্যাগুরু বনাম সংখ্যালঘু, মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার, এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিল তা নিয়ে অনবরত বিতর্ক ইত্যাদি।
এই অবৈধ শাসক গোষ্ঠী অনেক তুচ্ছ রাজনৈতিক ও ঐতিহ্যগত মতাদর্শ বা পার্থক্যকে জনগণের সামনে নিয়ে এসে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ডাক-ঢোল বাজিয়ে অনর্থক বাগি¦তণ্ডার সৃষ্টি করে। প্রচলিত বা সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বিভক্তির ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে, জনগণকে একে-অপরের শক্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। পরিণতিতে বর্তমানে আমাদের দেশ এখন এক ধরনের চতুর্মুখী বিভাজিত সমাজে পরিণত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সমাজকে বিভাজিত করার মাধ্যমে জনগণকে তাদের সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। সমান সুযোগ ও সমঅধিকার বঞ্চিত সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জনগণ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকারে পতিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এই বিভক্তি এখন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত।
বহুমাত্রিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী বিতর্কের পরিণতিতে, দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে ও সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে বহুমাত্রিক উদ্ভট ও অর্থহীন দ্বন্ধ ও সংঘর্ষের জন্ম দেয়। ফলে সমাজে রাজনৈতিক দ্বন্ধ ও শত্রুতা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। চরম বিভাজিত সমাজে ইহাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ, অকার্যকার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মিলিত প্রভাব, যেকোনো সমাজেই দুর্বার গতিতে দুর্নীতি বৃদ্ধি করার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাতে আয় ও সম্পদের অসমতা এবং ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ ধরনের বৈষম্য সাধারণত যারা গরিব তাদের জীবনমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে।
একই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকার ফলে দেশের বৃহদাংশ মানুষ নিরাশায় ভুগছিল। তাই সাধারণ জনগণ দেশের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। সর্বোপরি, জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশের মাঝে সমাজে ন্যায়বিচার ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধরনের আস্থার সঙ্কট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্ভাবনাকে গ্রাস করে। এক দিকে সামাজিক অস্থিরতা, অন্য দিকে আস্থাহীনতার ফলে সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ক্রমে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ নিয়মেই বিনিয়োগ কমে যায় ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পায়। তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হ্রাস পায় ও বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যায়। অর্থাৎ গরিব আরো গরিব হতে থাকে। তবে রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী, তাদের মিত্র ও ঘনিষ্ঠজন বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্য অর্থাৎ যাদের হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের অবৈধ উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। এটাই ছিল সদ্য অতীত অবৈধ সরকারের ডাকঢোল বাজানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মহাসাফল্যের ইতিহাস।
চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই - অবৈধ সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা
আগেই বলা হয়েছে যেকোনো একক ব্যক্তি সব প্রতিষ্ঠান বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে নাই। করা সম্ভব নয়। তাই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্যরা, তাদের মিত্র ও নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন খাতকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে নেয়। রাজনৈতিক অভিজাতরা সিদ্ধান্ত নেন যেকোনো গোষ্ঠী, কোন খাতের প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দখলে রাখবেন। দখলকৃত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদের কে কত পাবে। উদাহরণস্বরূপ কিছু সদস্য ব্যাংকিং, কিছু সদস্য পরিবহন, কিছু সদস্য স্বাস্থ্য বা বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণে রাখবে। তবে কে কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন খাত দখলে রাখবে তাতে কিছু আসে যায় না। কেন না, পর্দার আড়ালে, তারা সবাই একই গোষ্ঠীর সদস্য। তারা নির্ধারণ করে দেয় অর্জিত অবৈধ অর্থ বা সম্পদ নিজেদের মধ্যে কিভাবে ভাগ-বাটোয়ারা হবে। তাই কোনো সদস্য বা কোনো গোষ্ঠী কোন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং কার স্বার্থ রক্ষা করেছে তা নির্ধারণ করা তেমন প্রয়োজন নেই। কোনো না কোনোভাবে তারা সবাই শাসক দলের সাথে জড়িত ও সংযুক্ত। অন্য কথায়, এটি একটি পুরনো প্রবাদকে প্রমাণ করে যেমন; "চোরে-চোরে-মাস্তুতো ভাই’ বা ‘সমস্ত চোরেরা একে অপরের সম্পর্কে চাচাতো ভাই’।
পরিণতিতে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনা বা কুশাসন চরম রূপ ধারণ করেছিল। জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো অক্ষম ও অকার্যকর হয়ে যাওয়ায়, নাগরিকদের বৃহত্তর অংশ তাদের ন্যায্য সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠান জনগণকে সেবা প্রদানে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। সাধারণ জনগণের কল্যাণে এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও বস্তুত এসব প্রতিষ্ঠান দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতার সম্মিলিত প্রভাবে জনগণের মনোজগতে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থি মনোভাব সক্রিয় হয়ে উঠে। অর্থাৎ মানুষের মনে কোনো না কোনো কারণে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এর পরিণতিতে আমরা গত জুলাই মাসে জনগণের মধ্যে, দেশের রাস্তাঘাটে-হাটে-মাঠে বাজারে অক্ষম প্রতিষ্ঠান ও পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতির কুৎসিত চেহারা দেখতে পেয়েছিলাম। যেমন দেখা গিয়েছিল তিউনিসিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং অন্যান্য অনেক দেশের জনবিদ্রোহ টেলিভিশনের পর্দায়। এখানে বলা আবশ্যক যে নিবন্ধটি জুলাইয়ের শুরুতে লিখেছিলাম। ইতোমধ্যে, আপনারা বাংলাদেশেও তাই লক্ষ্য করেছেন।
রাজনীতি- অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির পথে প্রতিবদ্ধকতা
চিরাচরিতভাবেই আমাদের দেশে সবসময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোকে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী বাড়িয়ে বা প্রয়োজনমতো কমিয়ে দেখানো হতো। তবে সামরিক বাহিনী অধিনস্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) কিয়দাংশে ধান্ধাবাজি করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখিয়েছিল। হয়তোবা তখন অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের খুশি করার লক্ষ্যে কেবল জিডিপি নয়, আরো বহু ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানগত কারসাজি করা হয়েছিল। যেমন- কৃষি উৎপাদন বা উৎপাদনশীলতা বা রফতানি; সামাজিক সূচক যেমন বাল্যবিবাহ থেকে শিশুশ্রম, সব তথ্য কারসাজি করে দেখানো হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশত, তথাকথিত নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে একই কারচুপির ধারা অব্যাহত রেখেছে। বরং বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমদানি, রফতানি, ধান উৎপাদন, গবাদিপশু যেমন গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা, সুপারির গাছ থেকে নারিকেল গাছ, বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মতো বিষয়গুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হতো। এ ছাড়াও রাজস্ব সংগ্রহ, এডিপির বাস্তবায়ন, বাজেট ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতির হার, বেকারত্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয়, ঋণ বা রিজার্ভের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর পরিসংখ্যানে কারসাজি করতে কোনো ধরনের দ্বিধা করেনি। এ সবই করা হয়েছে জনগণকে বিভ্রান্ত করে অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য অর্জনে। অন্য দিকে বিভিন্ন ধরনের চেতনার কথা বলে বলে সচেতন নাগরিকদের অচেতন করে রাখার অপপ্রয়াস। এভাবে বহুমাত্রিক ও বহুরূপি কারসাজি করা সত্ত্বেও ২০২০ সাল থেকে একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও অন্য দিকে সমাজে বহুমুখী বৈষম্য বাড়তে শুরু করে। প্রথমে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির জন্য কোভিড মহামারীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের শেষের দিকে কোভিডের প্রভাব কমে যায়। এতদসত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী হওয়ায় জোড়াতালি দিয়েও আর লুকিয়ে রাখা বা ধামা-চাপা দেয়া যায়নি।
অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যানে কারসাজি, আইনের শাসনের পরিবর্তে আইন দ্বারা শাসন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক খাতের দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, আইনের অসম-বিষম প্রয়োগ, সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও অকার্যকারিতার পরিণতিতে জনগণের বৃহদাংশের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের দানা বেঁধে উঠেছিল। একই সাথে জনগণের কর্ম-উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাদের উদ্যম, উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির সম্মিলিত প্রভাব ও বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতিপথ ক্রমাগত নিম্নমুখী হতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে শাসকদলের বহুমুখী ও বিভ্রান্তমূলক প্রচারণা ও প্রতারণা সত্ত্বেও মানুষের মনে বারংবার অনেক প্রশ্ন জেগে উঠে। যেমন (ক) কেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে; (খ) কখন পর্যন্ত এবং কিভাবে নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ঊর্ধ্বমুখী হবে; (গ) মূল্যস্ফীতির হার দিন দিন বাড়ছে কেন; (ঘ) সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়া সত্ত্বেও মানুষের জীবনমান নিম্নমুখী কেন?; (ঙ) সরকার কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে বারংবার ক্ষমতা দখল করে অবৈধভাবে কতদিন মসনদে বসে থাকবে; (চ) শাসকদল, তাদের মিত্র ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আর কতদিন লুটতরাজ চালিয়ে যাবে; (ছ) উপরন্তু কুশাসনের মাধ্যমে কি কখনো দেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসবে; (জ) মানুষের জীবনমানের ক্রমাবনতি কি বন্ধ হবে; (ঝ) কোন অনির্বাচিত অবৈধ সরকার কি এই নিম্নমুখী প্রবণতা রোধ করে ঊর্ধ্বমুখী পথে নিয়ে যেতে পারবে; (ঞ) যদি তাই হয়, তাহলে কখন এবং কিভাবে?
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের বিশ্বাস যে ব্যাপক দুর্নীতি, অপশাসন, কুশাসন, অব্যবস্থাপনা এবং অপব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণের ফলে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি পরিবর্তনের মাধ্যমে সক্রিয় করা না যায় তাহলে নেতিবাচক প্রবণতাকে কোনোভাবেই ইতিবাচক করা সম্ভব নয়। পরিণতি হিসেবে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন উভয়ই হ্রাস পাবে। মানুষের জীবনমানের আরো অবনতি হবে। অতএব, কঠোর বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কোনোভাবেই অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। আর যতদিন প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচিত দাবি করা সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখবে এবং তাদের মিত্র ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে রাখবে, ততদিন কোনো সংস্কার সম্ভব হবে না। অতএব সামাজিক বা অর্থনীতির কোন খাতেই উন্নয়ন হবে না। এসব বদলাতে হলে প্রথমে জরুরি বিষয় হলো গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কার ও রাজনীতির আমুল পরিবর্তন। তবে অপরিহার্যরূপে বিষয়গুলো রাজনৈতিক।
নিকট অতীতে বিভিন্ন দেশ যেমন; সুদান, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়ার মতো দেশের অতীতের ঘটনা প্রবাহ ও অভিজ্ঞতা থেকে অনুমেয় যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়ে গেলে বৈষম্যের শিকার জনগণ তাদের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুনরুদ্ধারে আকুল হয়ে উঠে। তারা সাধারণ নিয়মেই একে-অপরের সাথে মিলে নিজেদের সংগঠিত করে এবং আন্দোলন শুরু করতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এই ধরনের আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন তার কেন্দ্রবিন্দু এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আন্দোলন যতই জোরদার হয় ততই দাবি-দাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এর কারণ জনসমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ এক নয়। তবে সবাই মনে করে যে শাসক ও শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন না হলে বিদ্যমান দমন-নিপীড়ন ও বৈষম্য দূর হবে না। তাই বহুমুখী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা জরুরি।
সাধারণ নিয়মে এই আন্দোলনের সূচনা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা থেকে। যে ব্যর্থতা বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমতাবস্থায় আন্দোলনের গতি যেমন বৃদ্ধি পায় তখন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসগংগঠন, তাদের ঘনিষ্ঠমিত্র, আত্ম-স্বার্থসন্ধানী এবং বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পরিণতিতে দেশের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
২০১১ সালে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলুপ্তি ও ২০১৫ সালে এক তরফা নির্বাচনের পর থেকেই সচেতন ও অসহায় জনগণ একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে আসছিল যে: (ক) এর পর কী? (খ) দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ থেকে কখন কালো মেঘ কেটে যাবে?; (গ) অতীব প্রয়োজনীয় বহুমুখী ও বহুমাত্রিক বিশাল বিশাল সমস্যাগুলো কিভাবে সমাধান করা হবে। তার চেয়েও উদ্বেগজনক প্রশ্ন হলো- কে এসবের সমাধান করবে? সাধারণত, বহুমাত্রিক সমস্যা সমাধানে যেমন বহুমুখী সংস্কার প্রয়োজন তেমনি এসবের সমাধানে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও মেধার প্রয়োজন। সমস্যা হলো বিগত দশকে একদলীয় শাসন ও এক ব্যক্তির শাসন কায়েমের ফলে মেধা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন।
এতদসত্ত্বে¡ও বাস্তবতা হলো দেশের সমস্যার একেবারে মূলে রাজনীতি। রাজনীতি ও অর্থনীতি একই মুদ্রার এপিট-ওপিট বা যমজ ভাইবোনের মতো। একে অপরের সম্পূরক ও পরিপুরক। তবে রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতএব, রাজনীতি হলো যেকোনো ধরনের সংস্কার ও সমস্যা সমাধানের সূচনা বিন্দু। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কার, সংস্কারমুখী নীতি, পশ্চাদমুখী বিধি-বিধানের রহিতকরণ, নতুন বিধি-বিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যকীয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বনাম অর্থনৈতিক উন্নয়ন
বিগত দশকে স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এটা স্বৈরাচারী শাসকদের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত সত্য হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মানুষের জীবনমানে উন্নয়ন হয় না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে যদি জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত না হয় তাহলে সাধারণ নিয়মেই সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়, সে সম্পদ ভাগাভাগি বা বণ্টনে যদি বৃহত্তর জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা না হয়, তাহলে সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
অতএব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি সমানতালে হওয়া বাঞ্ছণীয়। প্রবৃদ্ধি অবশ্যই সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির অংশ হতে হবে। দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশকে তাদের জীবন মানের অগ্রগতিতে উপলব্দি করতে হবে, অনুভব করতে হবে। যে অগ্রগতি মানুষের জীবনে সামাজিক শান্তি, মানুষের বহুমাত্রিক অধিকার যেমন মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার, তাদের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা, আয় বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার মতো ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনে অনুভব ও উপলব্দি করতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রিডম্যান এই অনুভবের সঙ্গাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁর বই ‘দ্য মোরাল কনসিউকেন্সেস অফ গ্রোথ’-এ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ‘জীবনযাত্রার মানের ক্রমবর্ধমান মূল্যবোধ কেবল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে সুনির্দিষ্ট উন্নতি নিয়ে আসে তার ওপর নির্ভর করে না, বরং এটি কিভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের নৈতিক চরিত্র, জীবনের দিকনির্দেশনা এবং মেজাজকে রূপান্তরিত করে তার ওপর নির্ভর করে।’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্থ হলো; সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন, যা প্রায়ই জীবনের জন্য বৃহত্তর সুযোগ, সামাজিক গতিশীলতা, সামাজিক ন্যায্যতার প্রতিশ্র“তি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করতে উৎসাহিত করা।
উপসংহার
২০০৭-২০০৮ সালের সেনাবাহিনীর অধিনস্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার আংশিক বাস্তব ও আংশিক কারসাজি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোকে রীতিনীতিতে পরিণত করেছিল। প্রবৃদ্ধির সঙ্গীত শুনতে শুনতে জনগণের হ্নদয়ে এক ধরনের বিরক্তি সৃষ্টি করে তাদের হ্নদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল। কারণ প্রবৃদ্ধি যাই হোক, এ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সমাজে অর্থ-বিত্তে শক্তিশালী করে তুলেছিল এবং তাদের জন্য অবৈধ অর্থ উপার্জনের রাস্তা সুগম করে দিয়েছিল। সেই সুযোগে তারা বিপুল সম্পদের মালিক বনে গিয়েছে।
এই শক্তিশালী গোষ্ঠী অসাধু উপায়ে, এমনকি একে-অপরের যোগসাজশে ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বহু ধরনের পশ্চাদমুখী বিধিবিধান প্রণয়নে বাধ্য করে। এসব বিধিবিধান বলে তারা নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। অবৈধ অর্জিত ঐ সম্পদ তারা নিজেদের মধ্যে ভাগা-ভাগি করে নেয়। অথচ দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টিতে এই গোষ্ঠীর তেমন কোন অবদান ছিল না। এই শক্তিশালী রাজনৈতিক অভিজাত মহল, তাদের মিত্র ও তাদের সহায়তাপুষ্ট সমর্থক বা বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও আত্ম-স্বার্থ সন্ধানকারীরা প্রথমে দেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। পরবর্তিতে একই গোষ্ঠী দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কব্জা করে ফেলেছিল।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যা তাদের উদ্যোগ, উদ্যম, সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি ও দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। ফলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। এই কারণে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধিতহারে তাদের জীবনমান, এমনকি জীবন রক্ষায় এক অভাবনীয় দুর্দশায় নিপতিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে তারা দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা ও সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্য সৃষ্টি করে সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। যার ফলে সাধারণ জনগণের জীবন রক্ষাই দায় হয়ে পড়েছিল। এসব কারণে যুব বেকারত্বের হার অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। সেই সাথে কুশাসন ও সর্বক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার সম্মিলিত প্রভাবে দেশে উৎপাদনশীলতা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উদ্ভাবনশীলতা, সমতা, অদক্ষতা, বাজেট ঘাটতি, বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনে ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সবই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পরিণতিতে দেশে উৎপাদনশীলতা ও মোট উৎপাদন কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও আমদানি বেড়ে গেছে। এসবের ফলে বিদেশের সাথে লেন-দেনের চলতি ও আর্থিক হিসেবে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ইতিপূর্বে দেশে চলতি ও আর্থিক উভয় খাতে একযোগে ঘাটতি কখনো দেখা যায়নি। এসব মিলিয়ে ২০২৩ সালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ তার দায়-দেনা পরিশোধ করতে কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। এই ধরনের সঙ্কট অতি সহজে এড়ানোর কোন উপায় আছে বলে খালি চোখে দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক শূন্যতা ও সঙ্কট এবং গুরুতর অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি করে বিগত সরকার কেবল রাজনীতি নয় বরং দেশকে সামাজিক বিশৃঙ্খলার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলনা। সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝা যায় যে এটা ছিল একেবারেই অদূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার ফল। আওয়ামী লীগ তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নিজেদের দখলে রাখার লক্ষ্য অর্জনে সাধারণ জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তার পরিবর্তে বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে জাতীয় সম্পদ লুট-পাট করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এটা করা হয়েছিল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। যার ফলে ২০২৪ সালের প্রথম দিক থেকেই বাংলাদেশ এক অকল্পনীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে পতিত হয়। অন্যদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে দেশকে এক দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যদি ঐ অবৈধ সরকার আর কিছুদিন ক্ষমতায় আসিন থাকতো, তাহলে ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিণত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের জন্য আর কোন বিকল্প অবশিষ্ট থাকতো না। ডাক-ঢোল বাজিয়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার বলে দাবি করা, যে কোন দেশের জন্য এই পরিস্থিতি কেবল অসাধারণ নয় বরং অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক।
লেখক : সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা