০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

জাতিসঙ্ঘে ‘ফারাক্কা’ ইস্যু উত্থাপনের ৪৮ বছর

জাতিসঙ্ঘে ‘ফারাক্কা’ ইস্যু উত্থাপনের ৪৮ বছর -


গঙ্গা নদীর উপর ভারতের নির্মিত ও বহুলালোচিত ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত তথা সার্বিক জীবনযাত্রার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে শুরু করলে বিষয়টির প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু ভারত তাতে ভ্রুক্ষেপ করা দূরে থাকুক, উপেক্ষার নীতি গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশ বাধ্য হয় এর প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে। যার ফলে এটি জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত হয়। বাংলাদেশের ফারাক্কা ইস্যু জাতিসঙ্ঘে উত্থাপনের এই উদ্যোগ ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর প্রভাবেই ভারত বাধ্য হয় দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিলে বসতে।
গত আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশের জন্য অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যু জাতিসঙ্ঘে তুলে ধরার ৪৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। ২১ আগস্ট সকালে জাতিসঙ্ঘে এটি আলোচনার জন্য প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করা হয়। সে সময় বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। ভারতের বৃহৎ দেশ হওয়ার অহমিকার প্রতাপকে উপেক্ষা করে এটি জাতিসঙ্ঘে নিয়ে যাওয়া এবং একে আন্তর্জাতিক আলোচনার আলোয় নিয়ে যাওয়ার সাহসিকতা জিয়া প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন। এর আগে মাত্র কয়েক মাস আগে ১৬ মে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। এই লংমার্চ যথারীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে এবং ফারাক্কা ইস্যু জাতিসঙ্ঘে উত্থাপনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।

এ বিষয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (পরে প্রেসিডেন্ট) জিয়ার পানিসম্পদ-বিষয়ক উপদেষ্টা বি এম আব্বাস এটি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ব্যাপারটি হঠাৎ ঘটে যায়। ঢাকায় ১৯৭৬ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে ভারতের গঙ্গায় পানি প্রত্যাহারের বিষয়টির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। তখন প্রকাশ পেলো যে, ওই দিনই জাতিসঙ্ঘে নোটিশ দেয়ার শেষ দিন। কোনো বিষয়ে উত্থাপনের নোটিশ দিতে হয় অধিবেশন শুরুর অন্তত একমাস আগে এবং জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২১ সেপ্টেম্বর। সেদিনই সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক ডাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ বৈঠকে বিশদ আলোচনার পর ফারাক্কা প্রসঙ্গ নিয়ে জাতিসঙ্ঘে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখনই নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি খাজা মোহাম্মদ কায়সারকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। সৌভাগ্যবশত ঢাকা ও নিউইয়র্কের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় ১২ ঘণ্টা। তাই তখনো আবেদন পেশ করার সময় ছিল। নিউইয়র্কে তখন ২১ আগস্টের সকাল।’

এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৫ নভেম্বর (১৯৭৬) জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে ফারাক্কা প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর পানিবিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ভারত কর্তৃক ফারাক্কায় গঙ্গার পানি এক তরফাভাবে প্রত্যাহারের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ যে প্রস্তাব এনেছে তা আলোচনার জন্য ১৫ নভেম্বর বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে উত্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ যদিও প্রস্তাবটি তাড়াতাড়ি বিবেচনার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল তবুও সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়েই সে বিশেষ রাজনৈতিক কমিটির উপরোক্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। কমিটির বৈঠকে বক্তব্য দিতে গিয়ে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি কে এম কায়সার ফারাক্কার মাধ্যমে ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে উদ্ভূত পরিস্তিতির গুরুত্বের কথা পুনরুল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের জনগণের প্রভূত দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টিকারী এই বিরোধটি সমাধানের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ সার্বিক ঐকান্তিকতা নিয়ে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অধিবেশনের জন্য আলোচনার কাঠামো প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিশেষ কমিটি বুধবার সকালে বৈঠকে বসে। বৈঠকে অস্ট্রেলিয়া, সেনেগাল এবং শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরা ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। সেনেগালের প্রতিনিধি বিষয়টির উপর আলোচনা থেকে তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতকে অনুরোধ করেন। অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরাও আলোচনার জন্য আরো সময় নিতে উভয় পক্ষকে অনুরোধ জানান। রাষ্ট্রদূত কায়সার বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিকে বলেন, অস্ট্রেলিয়া, সেনেগাল এবং শ্রীলঙ্কার সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক স্থগিত রাখতে রাজি আছে। তিনি বলেন, বিষয়টির উপর গঠনমূলক আলোচনা এবং একটি সুনির্দিষ্ট সমাধান বের করার মতো পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ এই বিলম্বে সম্মত হচ্ছে।

সেনেগাল আফ্রিকান দেশগুলোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শ্রীলঙ্কা জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর মতামতই ব্যক্ত করেছে। বিশেষ রাজনৈতিক কমিটির আলোচনায় এই তিনটি দেশের অংশগ্রহণকে পর্যবেক্ষকরা ফারাক্কা সমস্যার দ্রুত সমাধানে বিশ্ব সংস্থার অধিকাংশ সদস্যের আগ্রহের প্রকাশ বলে মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে বি এম আব্বাস উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সেদিন জাতিসঙ্ঘের কার্যবিধির ১৪ নং ধারা অনুযায়ী জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৩১তম অধিবেশনে অতিরিক্ত আলোচ্য বিষয় হিসেবে ফারাক্কা সমস্যা অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন পেশ করে। ২৬ আগস্ট কার্যবিধির ২০ ধারা অনুসারে একটি ব্যাখ্যাও আবেদনের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথমে বিষয়টির শিরোনাম বেশ দীর্ঘ করা হয়েছিল। পরে ৮ সেপ্টেম্বর শিরোনাম ছোট করে বলা হয় ‘ভারতের একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি।’ এই পরিবর্তন করা হয় আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুুক্ত হতে সাহায্য করবে বলে। জাতিসঙ্ঘে কোনো বিষয়ে আলোচনা উত্থাপনের জন্য দুটো পর্যায় রয়েছে। প্রথমে বিষয়টি কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং পরে জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন কমিটির মধ্যে কোন কমিটিতে আলোচনা করা হবে তা ঠিক করা। তারপর বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানো হয়। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ কমিটি বিষয় অন্তর্ভুক্তি অনুমোদনের ব্যাপারে সুপারিশ করে। জাতিসঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট, ১৭ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সাতটি প্রধান কমিটির চেয়ারম্যানদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত। কমিটি বিবেচনা করে শুধু পদ্ধতিগত প্রশ্ন।

জাতিসঙ্ঘের এই কমিটিতে বিতর্কে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান। ২৩ সেপ্টেম্বর সাধারণ কমিটিতে বাংলাদেশ তার বক্তব্য প্রথম পেশ করে। পানি নিয়ে বিরোধ যে শান্তি ও সংহতির পরিপন্থী- এটিই বক্তব্যে গুরুত্ব দেয়া হয়। এর সাথে এটিও বলা হয় যে, পারিপার্শ্বিকতা ও প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টনে জাতিসঙ্ঘ বহুদিন থেকে জড়িত এবং সমস্যা সমাধানে কারিগরি ও অর্থনৈতিক সাহায্যদানে জাতিসঙ্ঘ সমর্থন দিতে পারে। ভারত বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপনের প্রতিবাদ করে এই যুক্তি দেয় যে, সমস্যাটি দ্বিপক্ষীয় এবং এর আন্তর্জাতিকীকরণের যেকোনো প্রচেষ্টা সমস্যাকে আরো জটিল করবে, সমাধানে বিলম্ব ঘটাবে এবং দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ভারত আরো বলে, এটি একটি কারিগরি ও আইনগত সমস্যা যার উপর রাজনৈতিক আলোচনা করা ঠিক হবে না। ভারত এও বলে যে, অতীতে সাধারণ পরিষদ এরকম দ্বিপক্ষীয় কোনো ব্যাপারে আলোচনায় সম্মতি দেয়নি এবং এখন যদি সম্মতি দেয়া হয় তবে এর ফল হবে জাতিসঙ্ঘকে সমস্যা দ্বারা প্লাবিত করা।

ভারতের প্রচারণা
বি এম আব্বাস আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশকে তার প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করতে বা সাধারণ কমিটি যাতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করে তার জন্য ভারত অনেক আগে থেকেই প্রচার শুরু করেছিল। দিল্লিতে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের দুদেশের বৈঠক ডাকা এ প্রচারেরই একটি অংশ বিশেষ ছিল। বাংলাদেশ সে বৈঠকে অংশ নেয়াতে ভারত এ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার সুযোগ নিতে পারেনি; বরং সেই বৈঠকের ব্যর্থতা বাংলাদেশের জাতিসঙ্ঘের দ্বারস্থ হওয়ার অনুকূলে যায়। নিউইয়র্কে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে বাংলাদেশ যোগাযোগ করে তাদের ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করে। সাধারণভাবে সব দেশই বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তবে কিছু দেশ বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যারা সব সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতকে সমর্থন করে এ ক্ষেত্রেও তারা ভারতের দিকে ছিল। সাধারণ কমিটিতে ভারতের সাথে রাশিয়াও ফারাক্কা সমস্যা অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে তার মত প্রকাশ করে, তবে এ বিষয়ে চাপ দেয়নি। কোনো প্রকার ভোটাভুটি ছাড়াই তাই সাধারণ কমিটি ফারাক্কা প্রশ্ন অন্তর্ভুক্তির জন্য সাধারণ পরিষদের কাছে সুপারিশ করে।

এদিকে রেডিও বাংলাদেশের বরাতে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে ফারাক্কা বিরোধ নিয়ে যে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা তাতে অংশগ্রহণকারী এক শক্তিশালী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করছেন নৌবাহিনী প্রধান এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান। এডিমরাল খান শনিবার রাতে নিউইয়র্ক গিয়ে পৌঁছেছেন। রিপোর্টে বলা হয়, জাতিসঙ্ঘের আলোচ্যসূচিতে ফারাক্কা সমস্যার অন্তর্র্ভুক্তি এবং বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা এটিই প্রমাণ করে, বাংলাদেশ এত দিন এই সমস্যাকে বহুমুখী ও বহু প্রকৃতির সমস্যা বলে যে জোরালো বক্তব্য পেশ করছিল তা ছিল যথার্থভাবেই সত্য। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সূত্র থেকে বলা হয়েছে, সমস্যাটি শুধু কারিগরি এবং অর্থনৈতিকই নয়, এর সাথে রাজনৈতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশগত এবং মানবিক সমস্যাবলি জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, এই সমস্যাটি প্রকৃত অর্থেই দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুদীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নিষ্ফল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এই প্রসঙ্গ জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। অব্যাহত অচলাবস্থার ফলে অদূর ভবিষ্যতেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার কোনো আশা নেই বলেই বাংলাদেশ এই পথ অবলম্বন করেছে। এ সত্ত্বেও এটি প্রণিধানযোগ্য যে, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পথ পরিহার করেনি এবং দ্বিপক্ষীয় উপায়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় তার জন্য বাংলাদেশ সব প্রচষ্টা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু ভারত সব আন্তর্জাতিক ওয়াদা উপেক্ষা করায় এবং ফারাক্কায় গঙ্গার পানি একতরফাভাবে টেনে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের উপর যে প্রত্যাহিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে তার ফলেই বাংলাদেশ বিশ্বাস করে যে, জাতিসঙ্ঘের মতো কোনো তৃতীয় পক্ষ এই সমস্যার সাথে জড়িত হলে এর একটি আশু এবং পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সুরাহা হতে পারে। কারণ এই সমস্যার সুরাহার সাথে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের শুধু বেঁচে থাকার গভীর প্রশ্নটি জড়িত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি অধ্যুষিত অঞ্চল।

বাংলাদেশ এও বিশ্বাস করে, বিশ^ সংস্থা ভারতের উপর নৈতিক চাপ প্রয়োগ করে এমন একটি অবস্থাকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে যে অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে তার বৃহৎ প্রতিবেশীর হুকুম বিনা বাক্য ব্যয়ে তামিল করতে হয়। বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে বাংলাদেশ তার বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই এলাকার শান্তি এবং সামাজিক স্বার্থে বিরোধটির আশু সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান রাখার উদ্দেশ্যে জাতিসঙ্ঘের প্রতি অনুরোধ রাখবে।
অপর একটি বক্তব্যে ‘ফারাক্কা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানের অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান। তিনি জাতিসঙ্ঘ থেকে ঢাকায় ফিরে বলেন, গঙ্গা নদীর পানির উপর বাংলাদেশের অধিকার যে অবিচ্ছেদ্য এবং যথার্থ তা প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে ফারাক্কা প্রান্তরে বাংলাদেশের যথার্থ দাবি উত্থাপনের পর ঢাকায় ফিরে এসে তিনি বলেন, এই বিরোধের একটি ন্যায়সঙ্গত মীমাংসার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাসস জানায়, সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এডমিরাল খান বলেন, গঙ্গার পানিসংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত মীমাংসার একটি ন্যায়সঙ্গত পথ বের করার উদ্দেশ্যে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী প্রস্তাবিত ভারত-বাংলাদেশ মন্ত্রী পর্যালোচনা বৈঠক খুব শিগগিরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, বৈঠকের তারিখ ঢাকা ও নয়াদিল্লি থেকে একই সাথে ঘোষণা করা হবে। তিনি আরো বলেন, এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তারা বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সব জোটনিরপেক্ষ দেশ ও ইসলামী দেশ এই ঘোষণার অগ্রগতি বিশেষ আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো বিশেষ ফর্মুলা রয়েছে কি-না সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে’। তিনি আরো বলেন, সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বর্তমানে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এডমিরাল খান বলেন, ফারাক্কা সমস্যাটি জাতিসঙ্ঘে রয়েছে এবং যেকোনো পক্ষ কর্তৃক সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশনে প্রশ্নটি উত্থাপন করার পথ উন্মুক্ত রয়েছে।
এসব খবরে প্রতীয়মান হতে থাকে, ভারত ফারাক্কা ইস্যু জাতিসঙ্ঘে উত্থাপনে বেজায় মনোক্ষুণ্ন হয় এবং ভারতের প্রতি নমনীয় কিছু দেশ বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের আলোচনার টেবিলে উত্থাপনে গড়িমসি ভাব দেখাতে থাকে। তারা বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের দিকে বাংলাদেশকে নানাভাবে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। বাংলাদেশও শেষ পর্যন্ত বিষয়টি মেনে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়।
এ প্রসঙ্গে বি এম আব্বাস জানান, কমিটি এ বিষয়ে বিতর্ক পরবর্তী সপ্তাহের জন্যে মুলতবি করে। প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল বিতর্ক খুবই সীমাবদ্ধ হবে। কারণ অধিকাংশ দেশই বিষয়টির সাথে পরিচিত নয় এবং জাতিসঙ্ঘে বিষয়টি একেবারেই নতুন। আরো একটি কারণ হলো, কিছু দেশ বাংলাদেশ বা ভারত কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে চায় না। সিরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন বিতর্কে যোগ দিতে রাজি ছিল, তবে সবাই প্রথমেই কথা বলতে ইতস্তত করছিল। যাই হোক, শেষে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন হলো না। কারণ, কমিটি ২০ নভেম্বর অধিবেশনে বসার আগেই কয়েকটি জোটনিরপেক্ষ দেশের উদ্যোগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা বিবৃতি তৈরি হলো এবং কমিটি সেই বিবৃতি গ্রহণ করল। কমিটির সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদে ২৬ নভেম্বর এই সমঝোতা বিবৃতি অনুমোদিত হলো।

দ্বিপক্ষীয় আলোচনার যাত্রা
অতঃপর ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা ঢাকায় ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে বলে ঢাকা ও নয়াদিল্লি থেকে যুগপৎভাবে ঘোষণা করা হয়। গণমাধ্যমের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সর্বসম্মতক্রিমে গৃহীত বিবৃতিতে মন্ত্রী পর্যায়ে জরুরি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কথা বলা হয়েছে। পরে বিবৃতিটি জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অনুমোদন লাভ করে। এ বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, পরিস্থিতির জরুরি সমাধান প্রয়োজন এবং এই উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষ একটি ন্যায়সঙ্গত ও দ্রুত সমাধানে পৌঁছার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বৈঠকের তারিখ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের জন্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে।

ফারাক্কা প্রশ্নে প্রথম দফায় বৈঠক হয় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭৬। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। ভারতের সেচ ও কৃষিমন্ত্রী জগজীবন রাম আলোচনা বৈঠকের পর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা খোলা মন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি এবং আমরা একে অপরের অসুবিধা অনুধাবনের চেষ্টা করছি।’ এর আগে ঢাকা বিমান বন্দরে মি. রাম বলেন, ‘দুদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো একটি সমাধানে পৌঁছার ঐকান্তিক ইচ্ছা নিয়ে আমরা বাংলাদেশে এসেছি।’
আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এডমিরাল এম এইচ খান এবং ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করেন ভারতের কৃষি ও সেচমন্ত্রী মি. জগজীবন রাম। ফারাক্কা সমস্যার একটি দ্রুত ও সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য জাতিসঙ্ঘ বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই আলোচনা হয়। তিন দিনব্যাপী মন্ত্রী পর্যায়ের এ আলোচনা ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।
পদ্মার ‘গঙ্গাপ্রাপ্তি’!

অতঃপর দুই দেশের মধ্যে ‘জয়েন্ট রিভার কমিশন’ গঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে কখনো ঢাকায় আর কখনো দিল্লিতে দুই পক্ষের বৈঠক হয়। চুক্তিও হয় মাঝে মধ্যে। কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকির কবলে পড়ে পানি বঞ্চিতই থেকে যায় বাংলাদেশ। প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিক্রমের পর প্রাপ্ত হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে পদ্মা নদীর ‘গঙ্গাপ্রাপ্তি’ ঘটে চলেছে।
বাংলাদেশে গঙ্গা তথা পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে নানান গবেষণা ও জরিপ হয়েছে। যেমন- পদ্মায় মাছ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এতে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক অংশ নেন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭.৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬.২ শতাংশ। আর মিঠাপানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। গবেষক দল দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা পরিচালনা করেছে। ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ নামে নেদারল্যান্ডস থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী গত বছর জানুয়ারি সংখ্যায় তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯.২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।

বিগত অর্ধশতাব্দীকাল যাবত বাংলাদেশ নিরন্তর লড়াই করে চলেছে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এই অসম লড়াই থেকে বাংলাদেশ কেবল ফাঁকি আর প্রতারণার শিকার হয়ে এসেছে। পদ্মা-গঙ্গার উপর কেবল ফারাক্কা ব্যারাজই নয়, উজানে ভারত অসংখ্য বাঁধ ও খাল তৈরির মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। ফলে ফারাক্কার মুখে জমা হওয়ার মতো পানি আসছে না। যেটুকু জমা হতে পারছে সেটুকুই বানরের পিঠা ভাগের মতো সামান্য কিছু পানি বাংলাদেশ পেয়ে থাকে। বাঁধ আর ক্যানেল তৈরি করে ভারত উজানে যে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফোরামে আবারো ফিরে যাওয়া ছাড়া বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement