০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

মানবজীবন : মূল্য ও বৈশিষ্ট্য

মানবজীবন : মূল্য ও বৈশিষ্ট্য -


সদিচ্ছা, নৈতিক ইচ্ছা, নৈতিক যুক্তি, কর্তব্যের শর্তাধীন ও শর্তহীন অনুজ্ঞা, ঔচিত্যবোধ, নৈতিক স্বাধীনতা, বিশুদ্ধ তত্ত্বগত যুক্তি, বিশুদ্ধ ব্যবহারিক যুক্তি প্রভৃতি কম-বেশি ভারী ও জটিল পরিভাষা ও ধারণা প্রফেসর কান্ট উপস্থাপন করেছেন। তার লক্ষ্য ছিল নির্ভরযোগ্য গুণসম্পন্ন সেরা মানুষ খুঁজে পাওয়ার মানদণ্ড উপস্থাপন।
‘মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপের তারেক ফজল সূচক ২০২২’ বৃহত্তরো লক্ষ্যসম্পন্ন তেমন একটি উদ্যোগ-ধারণা-প্রচেষ্টা


মানব উন্নয়ন সূচক (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-এইচডিআই) জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৯৬ সালে। এর প্রবক্তা ড. মাহবুব উল হক (জন্ম ১৯৩৪, গুরুদাসপুর, ভারত-মৃত্যু ১৯৯৮, নিউ ইয়র্ক)। পাকিস্তানি এই অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক Reflections on Human Development (১৯৯৫) শীর্ষক গ্রন্থে মানুষের ‘লাইফ এক্সপেক্টেন্সি এট বার্থ, এডুকেশন, ইনকাম’- এই তিনটি প্রশ্নের ভিত্তিতে চার স্তরের (ভেরি হাই, হাই, মিডিয়াম এবং লো) রাষ্ট্রভিত্তিক সামষ্টিক বিবেচনায় মানব উন্নয়নের একটি মানদণ্ড তুলে ধরেন। অর্থাৎ জীবনকাল, শিক্ষা ও আয়-এর ভিত্তিতে তিনি সামষ্টিক তথা জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক মানব উন্নয়ন পরিমাপের পন্থা দেখিয়েছেন। এটি সামষ্টিক (ম্যাক্রো) হওয়ায় ব্যষ্টিক/ব্যক্তিক (মাইক্রো) মানব উন্নয়ন পরিমাপের ব্যবস্থা নেই।

ডক্টর আব্রাহাম হ্যারল্ড মাসলো (জন্ম ১৯০৮ নিউ ইয়র্ক-মৃত্যু ১৯৭০ ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ)-র ‘থিওরি অব হায়ারার্কি অব নীড্স’ হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বটি শেষাবধি ব্যক্তির নিজের আকাক্সক্ষার চূড়ান্ত বাস্তবায়নসহ তার সহজাত প্রয়োজন পূরণের পাঁচ (১৯৪১)/আট (১৯৭০) স্তরের অগ্রাধিকারের বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়। অর্থাৎ, যে জিনিসগুলোকে মানুষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূরণের চেষ্টা করে, সেগুলোর ক্রমভিত্তিক তালিকা এটি। এগুলো হলো:
১. শরীরবৃত্তীয় (ফিজিওলজিক্যাল) চাহিদা,
২. নিরাপত্তা (সেইফটি) চাহিদা,
৩. সঙ্গ-ঘনিষ্ঠতা (বিলঙ্গিংনেস) চাহিদা,
৪. সুনাম (এস্টিম) চাহিদা ও
৫. আকাক্সক্ষাপূর্তি (সেল্ফ একচুয়ালাইজেশন) চাহিদা।
এই পাঁচটি নিচের দিক থেকে উপরের দিকে উঠা চাহিদার ধারণা দিয়ে ১৯৪১ সালে তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন ডক্টর আব্রাহাম হ্যারল্ড মাসলো। ১৯৭০ সাল নাগাদ এই তত্ত্বে ডক্টর মাসলো আরো যুক্ত করেন তিনটি বিষয়। যথা : জ্ঞান (কগনিটিভ) চাহিদা, সৌন্দর্য (এইস্থেটিক) চাহিদা এবং (সর্বোচ্চে) আধ্যাত্ম্য (ট্রান্সেন্ডেন্স) চাহিদা।

ডক্টর মাসলোর সহগবেষকদের কেউ তত্ত্বটির জন্য একটি পিরামিড আকৃতির কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করেন এবং ড. মাসলো তা গ্রহণ করেন। পরে সেই পিরামিড কাঠামোটি গবেষক-পাঠকদের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ডক্টর মাহবুব উল হক-এর সূচকটি কার্যত জাতিরাষ্ট্র (নেশন স্টেইট)-এর প্রেক্ষাপটে করা। সেখানে ব্যক্তি মানুষকে বিবেচ্য হিসেবে ধরা হয় না। মানে এটি পুরো জাতির জন্য প্রযোজ্য হলেও একজন মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একজন মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন হবে তার তত্ত্ব এখনো উপস্থাপিত হয়নি।
অনেক ব্যক্তি বা মানুষের মিলিত এক আধুনিক সত্তার নাম জাতিরাষ্ট্র। বর্তমানে আমরা একে শুধু রাষ্ট্র বলে জানি। জাতিসঙ্ঘের সদস্য সব জাতিরাষ্ট্রের মানুষদের বা নাগরিকদের তিনটি তথ্যের গড় প্রতিফলিত হয় নন্দিত ও জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ঐ ‘মানব উন্নয়ন সূচক-এইচডিআই’-এ। এগুলো হলো:
১. আয়ু
২. শিক্ষা ও
৩. আয়।
ডক্টর মাহবুব উল হকের এই ইনডেক্স একটি পুরো জাতির বা জাতিরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে, মানবজাতির সব ব্যক্তি সদস্যকে আলাদাভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই আমার বিবেচনায় এই সূচকটির যৌক্তিক ও সহজগ্রাহ্য নাম হওয়া উচিত ‘জাতিরাষ্ট্র উন্নয়ন সূচক’ (নেশনস্টেইট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স- এনডিআই)।
ডক্টর মাসলো-র তত্ত্বে মানুষের চাহিদার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদানের উল্লেখ আছে। তবে মানবচাহিদার সবগুলো উপাদান এতে নেই।
আবার মানুষের চাহিদার শুরু কখন থেকে হয়, তা এ তত্ত্ব থেকে বোঝা সহজ নয়। ডক্টর মাসলো শুরুতে (১৯৪১) কেবল পাঁচটি বস্তুগত চাহিদার ধারণা দিয়েছিলেন। পরে তিনটি অবস্তুগত চাহিদার ধারণা তিনি যোগ করেছেন। তা থেকেও চাহিদাগুলোর অবস্থান ও সেগুলোর তুলনামূলক গুরুত্ব বোঝা কঠিন।
এই অসুবিধাগুলো বিবেচনায় রেখে আমি মানবজাতির নির্বিশেষে সব ব্যক্তি সদস্যের মূল্য ও গুণ পরিমাপের একটি মডেল দাঁড় করিয়েছি। এটি জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মডেল থেকে স্পষ্টতই আলাদা। কিঞ্চিৎ অগ্রসরও কেউ ভাবতে পারেন। নিচের চার্ট ও তথ্যগুলো বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

এই মডেলটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:
- এই ভাবনাতে ব্যক্তি প্রধান বিবেচ্য। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত ‘এইচডিআই’-এ জাতিরাষ্ট্র প্রধান আলোচ্য বিষয়।
- মানুষের মূল্য ও গুণ পরিমাপের উদ্যোগ এটি।
- এটি মাপামাপি বা মাপজোকের একটি চেষ্টা।
- এতে ব্যক্তির মূল্য ও গুণকে মাপ-এর একক হিসেবে ১০০ নম্বরের ক্রেডিট পয়েন্ট দিয়ে মূল্যায়নের চেষ্টা হবে (উপমহাদেশের চেনাজানা ‘পাল্লা-বাটখারা’ দিয়ে!)
- মানব মূল্য ও গুণ পরিমাপের জন্য এখানে ১১টি উপাদানকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
- নির্বিশেষে সব মানুষ এর আওতায় আসছে। মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-দল-মত-আদর্শ-বিত্ত-বিদ্যা-বয়স-দৈহিক কাঠামো-সক্ষমতা-প্রতিবন্ধকতা-লিঙ্গ-পেশা-পদ-পদবী-দক্ষতা নির্বিশেষে সব মানুষ এই সূচকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
- মানুষের মূল্য ও গুণ বাড়ায় এবং তার পক্ষে অর্জন সম্ভব, সার্বজনীন-সর্বকালীন বিবেচনায়, এমন সম্ভাব্য সবগুলো উপাদানের বিবেচনা এখানে থাকছে।
- মানুষের উপযোগী মূল্য ও গুণের বৃহত্তর, ঊর্ধ্বতর ও মহত্তর জীবনে ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা এর লক্ষ্য।
- এ সূচকে মানব মূল্য ও গুণকে চার স্তরে দেখানো হয়েছে (সাধারণ, ভালো, বেশ ভালো ও চমৎকার)। এ চার স্তরের প্রতিটিকে, মূল টেবিলে, পঁচিশ ভাগে/ঘরে দেখানো হয়েছে এবং প্রতিটি ভাগ-এর জন্য একটি ক্রেডিট পয়েন্ট দেয়া হয়েছে। চার স্তরের প্রতিটির জন্য অর্থপূর্ণ পৃথক রঙ বরাদ্দ করা হয়েছে। পঁচিশটি ঘরে সেই রঙ ক্রম গভীরতায় বিকশিত হয়েছে।

- এ সূচকে মানব মূল্য ও গুণের মোট মান ১০০ ক্রেডিট পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এই ১১টি উপাদানে/খাতে তা বরাদ্দ করা হয়েছে।
- সংশ্লিষ্ট ১১টি উপাদানের জন্য বরাদ্দ করা মানের স্তর চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তা ব্যক্তির অর্জিত মূল্য ও গুণের ভারত্ব-তুলনামূলক গুরুত্ব (ওয়েটেজ) সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট স্তর(সমূহ)-এ বণ্টনে নমনীয়তার সুযোগ রাখা হয়েছে।
- জীবন যাপন-ধারণ ‘সংগ্রামের বিষয়’ নয়, এমন সবাই এ বিবেচনায় অংশীদার হতে পারেন।
- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৩০% মানুষকে এমন অবস্থানের বিবেচনা করা হলে তাদের দায়িত্ব হবে অবশিষ্ট ৭০% বাংলাদেশির উন্নততর জীবন নিশ্চিতে সচেষ্ট হওয়া।
- ৯০% বা তার কাছাকাছিসংখ্যক বাসিন্দার উন্নততর জীবনের অধিকারী দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব হবে পিছিয়ে থাকা বিশ্ববাসীর উন্নততর জীবন নিশ্চিতে সক্রিয় হওয়া।
- এখনো এটি একটি ভাব-ধারণার পর্যায়ে আছে।
- এর তত্ত্বায়নের জন্য কিছু ভাব বিনিময় দরকার হবে।
- তাতে অবদানের অনুরোধ করছি।

ধারণার উপস্থাপন

মানব-জীবনের মূল্য-গুণ বিচার ও পরিমাপ
মানুষ এই আর্থ বা পৃথিবীতে জন্মায়। কিছু সময় অবস্থান করে বা জীবন যাপন করে। এবং মৃত্যুবরণের মাধ্যমে তার এ জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র একক, মানুষের দেয়া নামের, সৌরজগত।
এ সৌরজগতের একটি গ্রহ নামের একক এ পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন আর্থ। তারা এগুলোর সময়কাল-অস্তিত্বকালেরও ধারণা দিয়েছেন। তা লক্ষ-কোটি বছরের। মানুষ নামীয় প্রজাতির (হোমোসাপিয়েন্স) আমরা খুবই অল্প কয়েক হাজার বছর এই গ্রহে-আর্থে বাস করছি।
খুবই অল্প সময়ের এ জীবনকালে মানুষ ভালো-মন্দ মিলিয়ে একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। মানুষের এ জীবন যাপনের একটি মূল্যমান উপস্থাপন বিষয়ে ভাবছি কিছু দিন। দ্বিধা আছে অন্যদের বিবেচনা বিষয়ে। অন্যদের ভাবনা-মূল্যায়ন থেকে সমৃদ্ধ হওয়ার আশা নিয়ে কথা শুরু করি।

আব্রাহাম মাসলো-র ‘হায়ারার্কি অব নীড্স’
আব্রাহাম মাসলো (১৯০৮-১৯৭০) নামের এক মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক-শিক্ষক ‘হায়ারার্কি অব নীড্স’ নামের তত্ত্ব দেন। কয়েক দফায় সেই তত্ত্ব তিনি সংশোধন করেন। এ তত্ত্বে তিনি মানুষের চাহিদার কথা বলেন, তার অগ্রাধিকার দেখান, তৃপ্তি-তুষ্টির কথা জানান।
ডক্টর মাসলো প্রথমে (১৯৪৩, ১৯৫৪) মানুষের পাঁচ ধাপের চাহিদার ধারণা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মানুষ প্রথমে তার ‘দৈহিক’ (ফিজিওলজিক্যাল) চাহিদা পূরণ করে। বাতাস, পানি, খাবার, ঘুম, ঘর, যৌনতা, মলত্যাগ প্রভৃতিকে এ চাহিদার অংশ বলা হয়। এ চাহিদা পূরণ হলে মানুষ ‘নিরাপত্তা’-র (সেইফটি) চাহিদার কথা ভাবে। দেহ, জীবিকা, সম্পদ, নৈতিকতা, পরিবার, স্বাস্থ্য প্রভৃতির নিরাপত্তা মানুষ নিশ্চিত করতে চায়। মানুষের এর পরের চাওয়া ভালোবাসা-ঘনিষ্ঠতা। বন্ধুত্ব, পরিবার, যৌন ঘনিষ্ঠতার চাহিদা মানুষ পূরণ করতে মনোযোগী হয়।
এই তিন চাহিদা পূরণের পর মানুষ ‘মর্যাদা’-র (এস্টীম) চাহিদা নিয়ে ভাবে। আত্ম-সম্মান, আস্থা, অর্জন, অন্যকে সমীহ করা ও অন্যের সমীহ পাওয়া নিয়ে মানুষ এ সময়ে উদ্যোগী হয়।

এ চার স্তরের চাহিদাকে ‘ডেফিসিয়েন্সি নীডস্’ বা ঘাটতি চাহিদা (ডি-নীডস) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
১৯৪৩ সালের প্রাথমিক উপস্থাপনায় ডক্টর মাসলো এরপর পাঁচ নম্বর চাহিদার কথা বলেন। নাম দেন ‘একচুয়ালাইজেশন’ বা বাস্তবায়ন। এ পর্যায়ে মানুষ নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা, গ্রহণযোগ্যতার বাস্তবায়ন করতে চায়। এটিকে ‘বীইং নীডস্’ (বি-নীডস) বা হতে চাওয়ার চাহিদা বলে চিহ্নিত করা হয়।
ডক্টর মাসলো তার এ তত্ত্ব ১৯৫৪ সালে কিছুটা সংশোধিত আকারে প্রকাশ করেন।
১৯৬২ সালে আরেক দফা সংশোধন করেন।
১৯৭০ সালে এ তত্ত্বে তিনি প্রথমে নতুন দুটি ধাপ যোগ করেন। কিছু পরে, একই বছরে, ১৯৭০ সালে, তিনি আরো একটি স্তর যোগ করেন। ১৯৭০ সালেই তিনি মারা যান।

১৯৭০ সালে দুই দফায় যোগ করা নতুন তিনটি স্তর হলো :
৫ম স্তর : ‘কগনিটিভ’ বা জ্ঞানের চাহিদা।
৬ষ্ঠ স্তর : ‘এইস্থ্যাটিক’ বা সৌন্দর্যের চাহিদা।
৮ম স্তর : ‘ট্রান্সেন্ডেন্স’ বা উৎকর্ষ-আধ্যাত্মিকতার চাহিদা।
ডক্টর মাসলো-র প্রাথমিক উপস্থাপনায় মানুষের বস্তুগত চাহিদার কথা জানা যায়। প্রকাশ্য হওয়ার কারণে এগুলো বুঝতে অসুবিধা কম বটে। তার বিবেচনা এবং প্রজ্ঞার পরিপক্কতা-অগ্রসরতার ছাপ দেখা যায় ১৯৭০ সালের সংযোজনায়। ডক্টর মাসলো এ পর্যায়ে মানুষের অবস্তুগত-আধ্যাত্মিক চাহিদার তাৎপর্য ও গভীরতা অনুধাবন করেন বলে অনুমিত হয়। মানুষের চাহিদার তালিকায় তিনি জ্ঞান, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার মতো অবস্তুগত স্তর যুক্ত করেন। এ বছরই তিনি মারা যান।
ডক্টর মাসলো-র এই গবেষণাজাত উপস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদান।
ডক্টর মাসলো শেষ জীবনে বাহ্যত অবস্তুগত অস্তিত্বের অর্থ ও মূল্য বুঝেছেন বলে মনে হয়। তার উপস্থাপিত আট ধাপের মানবীয় চাহিদার বিকাশের ভিত্তিতে মানবজীবনের মূল্য হিসাবের একটি সূত্র খোঁজা যায়।
আমি ডক্টর মাসলোর এ উপস্থাপনার প্রশংসা করি। তবে এটিকে কম পর্যাপ্ত মনে করি। এ বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা ভাগাভাগি করতে চাই। এ কাজটি যে জটিল, সূক্ষ্ম এবং অংশত ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ সচেতনতা আছে।
মানব-জীবনের মূল্য বিচারকাজে প্রয়োগের জন্য শুরুতেই পরিমাপ-বিবেচনার একটা খসড়া প্রস্তাব শুনাই।
সম্ভাব্য সেরা-সফল মানব-জীবনের জন্য ১০০ নম্বর-ক্রেডিট পয়েন্ট বরাদ্দ করা যাক।

কয়েকটি ভাগে/খাতে সেই ১০০ নম্বর দেয়া যায় :
১. জীবন উপভোগ বা জীবিকা নির্বাহ ও পরিবার গঠন - ২০,
২. জ্ঞানার্জন - ১০,
৩. স্বেচ্ছাকৃত জ্ঞান বিতরণ - ০৫,
৪. জ্ঞান সৃষ্টি - ১৫,
৫. জনকল্যাণ -১৫,
৬. মানবীয় সুষমা - ১০,
৭. নৈতিকতা - ০৫,
৮. প্রাণ ও প্রকৃতি কল্যাণ - ০৫,
৯. স্বাধীনতা প্রশ্ন - ০৫,
১০. অনুসারী - ০৫,
১১. অপেশাদার-অবাণিজ্যিক দক্ষতা ও বিনোদন - ০৫।

প্রস্তাবিত এ ১১টি বৃহত্তর ভাগের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার আগে আরেকটি কথা বলে রাখি : ইসলাম ‘নিশ্চিত সেরা মানুষের’ বৈশিষ্ট্য-সংজ্ঞা শুরুতেই, কুরআনে বলে রেখেছে। বলেছে, সর্বোচ্চ ‘তাকওয়ার অধিকারিই’ সেরা মানুষ। বস্তুভিত্তিক, বাহ্যত, মানুষের পক্ষে এ সংজ্ঞা এ জীবনে মিলিয়ে বোঝা-ভাবা-অনুধাবন দুঃসাধ্য, প্রায় অসম্ভব।
‘বস্তু ও নীতির মিশেলে চালিত’ মানুষের সম্ভাব্য বোধগম্যতার আওতায় কিছু সূচকের (ভেরিয়েবল) সাহায্যে মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপের জন্য এই অক্ষম উদ্যোগ।
একে আপনি ‘মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপের তারেক ফজল সূচক’ (বা ইনডেক্স) (Tareque Fazal Index to Measure Human-Value and Quality) নাম দিতে পারেন।

‘জীবিকা নির্বাহ ও পরিবার গঠন’কে জীবন উপভোগ হিসেবে দেখা যায়। নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা, পরিবার গঠন, নানান জটিলতা কাটিয়ে জীবনে এগিয়ে চলা, বাহ্যত একটি সচ্ছল ও সুখী পরিবার-স্বজনের উপস্থিতিকে বিবেচনাযোগ্য জীবন উপভোগ হিসেবে দেখা যায়। কম বয়সে জীবন শেষ হলে (এতে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই), চেয়েও পরিবার গঠনে সফল না হলে, ‘ন্যূনতম জীবিকা’র সংস্থান করা না গেলে এই সূচকের নম্বর কমবে।
‘জীবনের দৈর্ঘ্য’ ছাড়া অন্য প্রসঙ্গগুলো যে যত নিজ সাধনা-যোগ্যতায় অর্জন করবেন, তত ইতিবাচক নম্বর পাবেন।
পৈতৃক-পারিবারিক সূত্রে এসব প্রাপ্তি নেতিবাচক বিবেচনায় থাকবে।
একক সূচক হিসেবে এটি সর্বোচ্চ ২০ নম্বর ধারণ করবে।
বিশ্বে বহু মানুষের জন্য এর নাম জীবন যুদ্ধ/জীবন সংগ্রাম। দেখা যায়, বহু মানুষ এই ‘জীবন উপভোগ’ বিষয়ক তৎপরতার বাইরে এ জীবনে আর কিছু করেন না। তাদের জীবন-মূল্য ২০ নম্বর বা তার চেয়ে কম নম্বর হয়ে থাকে। ন্যূনতম বস্তু-সুখ ভোগকারী আর অঢেল উপার্জনসূত্রে সীমাহীন/বিপুল বস্তু-সুখ ভোক্তা প্রায় একই মূল্যায়ন পাবেন।
‘জ্ঞানার্জন’ সূচকে ১০ নম্বর বরাদ্দ হবে।
বিভিন্ন স্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক/ব্যক্তি-গুরুভিত্তিক শিক্ষা এ সূচকে গণ্য হবে।
অর্জিত জ্ঞানের গুণ ও মানের ভিন্নতায় এর নম্বরে তারতম্য হবে।
‘জ্ঞান’ বিষয়ক তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা ব্যাপক আলোচনা ও বিবেচনাসাপেক্ষ। এখানে সাধারণ ও প্রচলিত অর্থে জ্ঞান বিবেচনায় নেয়া হবে।
‘জ্ঞানার্জন’কে ‘জ্ঞান অন্বেষণ’ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হবে।
‘স্বেচ্ছাকৃত জ্ঞান বিতরণ’ সূচকে ০৫ নম্বর বরাদ্দ হবে। শিক্ষক নামে পরিচিত ব্যক্তিরা সাধারণত জ্ঞান বিতরণ করেন বলে স্বীকার/দাবি করা হয়। ‘স্বেচ্ছাকৃত’ শর্তারোপ এখানে তাৎপর্যপূর্ণ।

জীবিকার্জনের আর কোনো উপায় না পেয়ে বা অনিচ্ছায় বা শুধুই জীবিকার্জনের জন্য শিক্ষকতায়
থাকা ব্যক্তিরা এ সূচকের নম্বর পাবেন না। বাস্তবে তখন শিক্ষকতা কেবলই জীবিকার্জনের এক তাৎপর্যপূর্ণ মাধ্যম।
জ্ঞান বিতরণে প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বই লেখা-বিতরণ ইত্যাদি মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারের কাজে মনোযোগী ব্যক্তিগণও এ সূচকে গণ্য হবেন।
‘জ্ঞান সৃষ্টি’ সূচকে ১৫ নম্বর বরাদ্দ হবে।
জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের চাইতে জ্ঞান সৃষ্টিকে সব ধর্ম এবং বিবেচনাতেই উচ্চস্থান দেয়া হয়। এটি
প্রথম দু’টির (জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ) জন্ম, অস্তিত্ব ও বিকাশ নিশ্চিত করে। এটি সর্বদাই একটি কঠিন ও নিষ্ঠাসাধ্য কাজ।
জ্ঞানের সঙ্কলন-পুনরুৎপাদন, পুনর্পাঠ ও নতুন পাঠ বা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বলে পৃথক ধারণা ও অস্তিত্ব রয়েছে।
জ্ঞান সৃষ্টি সূচকে এর উপযোগিতা, কল্যাণমুখিতা প্রভৃতি বিবেচনায় রাখা হবে।
‘জনকল্যাণ’ সূচকে উল্লেখযোগ্য ১৫ নম্বর থাকবে।
অন্য মানুষদের কল্যাণ সাধনই মানুষের মূল কাজ বা দায়িত্ব। সব ধর্ম এবং মতাদর্শে একে সর্বোচ্চ
গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামে ঈমানের পরই একে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে। পরজীবনে পুরষ্কারযোগ্য হবার জন্য ঈমানের পর ভালো কাজ (আমলে ছালেহ) তথা জনকল্যাণের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। রবের খলিফা হিসেবে প্রতিজন ব্যক্তি-মানুষের মূল কাজ সাধ্যমতো জনকল্যাণে নিষ্ঠাবান থাকা।
এ কাজের গুণ-মান-নিষ্ঠার ভিত্তিতে এর নম্বর প্রাপ্য হবে।

‘মানবীয় সুষমা’ সূচকে ১০ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।
সুষমা মানে সূক্ষ্ম সৌন্দর্য (ইংলিশ exquisite beauty/subtle beauty)। নিরাপদ, কল্যাণকামী, নির্ভরযোগ্য ও ‘মানবসুলভ’ বৈশিষ্ট্যগুলোর মিলিত রূপকে এখানে মানবীয় সুষমা বলা হয়েছে। এমন চরিত্র-আচরণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তির জন্য এ সূচকের নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।
‘নৈতিকতা’ সূচকে ৫ নম্বর বরাদ্দ করা হবে। জীবনের নানান ঝুঁকি-হুমকি-জটিলতার মুখেও যিনি ঘোষিত-স্বীকৃত-কাক্সিক্ষত নৈতিকতা রক্ষা করে চলেন, চলতে পারেন, তার এ মানবজীবন ধন্য ও সার্থক।
নৈতিকতার এমন মেরুদণ্ডম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এমন মূল্য দেয়া অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়াই সঙ্গত।
‘প্রাণ ও প্রকৃতি কল্যাণ’ সূচকের জন্য ৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।
কেবল মানুষ নিয়ে এ পৃথিবী নয়। অন্য প্রাণ-বন-প্রকৃতি সহজ-স্বাভাবিক না থাকলে এ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে। তাই পরিবেশ কল্যাণমূলক কাজের জন্য এই নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।

‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ মানব-মূল্য মাপার তাৎপর্যপূর্ণ সূচক। এ জন্য ৫ নম্বর বরাদ্দ করা যায়। স্বাধীন থাকা ও রাখার বিষয়ে ব্যক্তির ইচ্ছা, চেষ্টা, উদ্যোগভেদে এ নম্বর প্রাপ্য হবে। স্বাধীন মানুষ আর অধীন মানুষ যে মূল্য নির্দেশ করে, তার স্বীকৃতির জন্য এ বরাদ্দ জরুরি।
‘অনুসারী’ সূচকের জন্য ০৫ নম্বর বরাদ্দ করা হবে। স্বতঃস্ফূর্ত ও নিঃশর্ত-নিঃস্বার্থ অনুসারী পাওয়া-অর্জন করা মানব জীবনের মূল্যবান সম্পদ। অনুসারীর গুণ-মান-বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এ নম্বর বণ্টিত হবে।
অপেশাদার-অবাণিজ্যিক বিনোদন-দক্ষতার জন্য এ সূচকে ৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। সঙ্গীত, ক্রীড়া, শরীর চর্চা, অভিনয়, উদ্বুদ্ধকরণ যোগ্যতার অপেশাদার ও অবাণিজ্যিক চর্চা-প্রয়োগ মানবসমাজের জন্য বিশেষ কল্যাণকর ও উপযোগী হয়ে থাকে। এ জন্য এ যোগ্যতাও মানবজীবনের মান-মূল্য নির্ধারণে সূচক হবার দাবি রাখে।
ডক্টর মাসলো তার ‘হায়ারার্কি অব নীডস্’ থিওরির সংযোজন-সংশোধন-উন্নয়ন করেছেন জীবনের শেষ বছরেও।
প্রস্তাবিত মানবজীবন মূল্যায়নের এ সূচকের বিস্তারিত উপস্থাপনের জন্য সময় চাই, সমর্থন চাই, পরামর্শ চাই।
উভজাগতিক বিবেচনায় একটি কাক্সিক্ষত সেরা গুণসম্পন্ন মানবজীবনের গ্রহণযোগ্য সূচক পরিচিত ও জনপ্রিয় করার জন্য আগ্রহী সবার শর্তহীন-স্বার্থহীন অংশগ্রহণ আশা করি।
একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল বিষয়ের উদ্যোগ ছিল এটি।
ডক্টর আব্রাহাম মাসলোর হায়ারার্কি অব নীডস্ তত্ত্বটি বেশ আগেই পড়েছিলাম। এ তত্ত্ব জেনে আনন্দিত ছিলাম, তুষ্ট ছিলাম না। উপযুক্ত বিকল্প ভাবনায় ছিল।
২০২১-এর জুনে ফেইসবুকে লিখতে শুরুর বেশ আগে থেকেই মানব-মূল্য পরিমাপ বিষয়ক ভাবনা মাথায় কাজ করছিল। কিভাবে এ ভাবের প্রকাশ ঘটাবো, তা নিয়ে ভাবনা-দ্বিধা-উৎকণ্ঠা-শঙ্কা ছিল।

আলহামদুলিল্লাহ, কাজটা শুরু করতে পেরেছি।
এক ভাই, বিশিষ্ট উদ্বুদ্ধকারী-মোটিভেশনাল বক্তা, শিশু বন্ধু, জনাব মারুফ খান, সম্ভবত কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে, লিখলেন, ‘প্রথমত ১০০-তে ৫১ নম্বর ধর্মপালন, ধর্মজ্ঞান ও ধর্মবোধে দিয়ে শিশুর প্রতি দায়িত্ব, বৃদ্ধের প্রতি দায়িত্ব, মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব, শিক্ষকের প্রতি দায়িত্ব এবং আয় ও খরচকে দূষণমুক্ত করাকে বিশেষ খাত হিসেবে সংযুক্ত করে তাতেও নম্বর বিন্যাস করুন। এরপর আপনি যা যা বলেছেন সেগুলো আরও ভিজিবল করে বুঝতে সাহায্য করুন।... আপনার চিন্তা ভালো। কিন্তু কেন কোনটা ইন্ডিকেটর হিসেবে নিলেন এবং কেন কোনটা বাদ দিলেন সেসব পরিষ্কার করাটা জরুরি! যেমন- বিনোদন এখন অবৈধ যৌনতার দিকে টার্ণ করেছে। ফলে বিনোদন বলতে কী বুঝতে হবে, সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। যেমন- স্বাধীনতাবোধও এখন যাচ্ছেতাই করতে পারাকে বোঝাতে শুরু করেছে। যেমন এখন পরিমণির খোলামেলা আচরণ আধুনিক স্বাধীনতা ও শিশুদের নিয়ে পরিমণির ইভেন্ট উদযাপন করা একধরনের সুন্দরের ইন্ডিকেটর হিসেবে ধরা হচ্ছে। সেখানে ড. জাফর ইকবালের মতো মানুষ উপস্থিত হচ্ছন। শ্রদ্ধেয় আ: গাফ্ফার কবিতা লিখছেন পরিমণিকে উৎসাহ দিতে। আর হিরো আলম কুৎসিৎ যৌনতা নির্ভর ভিডিও গান-নাচ দিয়ে ভাইরাল হয়ে মটিভেশনাল বই লেখছেন। ফলে এসব নিয়েও একটা ইন্ডিকেটর সেট করা দরকার আছে কি না, ভাববেন আশা করি।...’
জনাব মারুফ খানের সাথে ইনবক্সে আরো কিছু কথা হলো। সেগুলো এখানে আমি কপি-পেস্ট করতে পারিনি।

আমার আরেক সাংবাদিক-ইতিহাস গবেষক ভাই সরদার আবদুর রহমান লিখলেন : ‘বিষয়বস্তু হজম করাই তো কষ্টকর। মন্তব্য করি কেমনে!’
জবাবে লিখলাম : সালাম প্রিয় সরদার ভাই। ‘সহজ করে বলতে আমায় কহ যে/সহজ করে যায় না বলা সহজে।’ ধীরে ধীরে হবে সহজ আশা করি। আগে ধারণাটা পরিচিত করতে অংশ নিন, শেয়ার করুন - করতে বলুন ডানে-বামে। তার পর জনপ্রিয় হবে।
এর ধারাবাহিকতায় সহজ ভাষায় বলা হয়ে যাবে, আশা করি।
এখন মানা যেতে পারে, ভাবের কিঞ্চিৎ ভাগাভাগি হয়েছে। আরো চাই বটে।
আমি সামান্য আনন্দিত, মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপের একটা সম্ভাব্য দৃশ্যমান কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি।
মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপের সূচক দেখাতে যে কাঠামোটি গত পর্বে দেখিয়েছি, তা তৈরিতে সহায়তা করেছে আমাদের বিভাগের কর্মী মি. মিলন। তার নামটা পাঠককে জানিয়ে রাখবো ভেবে তার ‘ভালো নাম’ জানতে চাইলাম। বলল ‘মো: মিলন আলী’। মিলন বলল, খুশি হয়ে, ‘স্যার আইডিয়া দিলে অনেক জটিল ও চমৎকার কাজ করা যায়। আপনি আইডিয়াটা দেয়াতে কাজটা করতে পারলাম।’ তাকে বললাম, ‘তোমার এই ‘আইডিয়া’ মানে ‘ভাব’ই হলো সব কিছুর আসল বা মূল বা শুরু। সব কিছুতেই। এ কথা লিখেই দুনিয়ায় একজন বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তিনি হলেন হেগেল।’ মি. মিলনকে এর চাইতে বেশি শোনাবার সুযোগ ছিল না।

প্রফেসর হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel, 1770-1831) পরম ভাববাদ (absolute idealism)-এ উন্নীত হওয়ার পথ খুঁজেছেন। এ জন্য তিনি দ্বান্দ্বিক ভাববাদ (Dialectical Idealism)-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।
মানুষের যাবতীয় চিন্তাভাবনা (thoughts and ideas) দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিবর্তনের পথ ধরে এগোয়।
ভাবের জগতে যখনই একটি ‘ধারণা’ (thesis) গড়ে ওঠে, তার সাথে একটি ‘বিপরীত ধারণা’ (antithesis) জন্মায়। কারণ সব ধারণার ভেতরেই কিছু স্ববিরোধিতা থাকে। এ ধারণা ও বিপরীত ধারণা চলতে থেকে একর্যায়ে সংঘর্ষে জড়ায়। তাতে উভয়েরই বিলুপ্তি ঘটে। সেখানে এক সমন্বিত ধারণা বা সংশ্লেষণের (synthesis) জন্ম হয়।
তা আগের ধারণা ও বিপরীত ধারণার থেকে উন্নততর হয়। কল্পিত এই সমন্বিত ধারণা বা সংশ্লেষণটি একপর্যায়ে ধারণায় রূপ নেয়। জন্মায় আরেক বিপরীত ধারণা। তাদের সংঘর্ষ হয়। সংশ্লেষণ তৈরি হয়।

এভাবেই এগোয় মানুষ ও ইতিহাস। এসব তত্ত্বকথা মি. মিলনকে শোনানো কম উপযুক্ত হতে পারতো।
তিনি সে তুলনায় সামান্য পিছিয়ে থাকা মানুষ। অগ্রসর ও মনোযোগী শিক্ষার্থীদের বোঝাতেই
হিমশিম খেতে হয়। কারণ, কবিগুরুর স্মরণীয় উচ্চারণ, ‘সহজ করে যায় না বলা সহজে’। তাই বিরত থাকলাম।
ডক্টর মাসলোর হায়ারার্কি অব নীডস্ তত্ত্ব বললেই একটি পিরামিড আকৃতির কাঠামো শ্রোতা- পাঠকের চোখে ভাসে। এটা এক প্রতীক বা আইকনে পরিণত হয়েছে এবং ডক্টর মাসলোর তত্ত্ব উপস্থাপন সহজ করেছে। আমার ভাবটি প্রকাশের জন্যও তেমন একটি সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় কাঠামোর কথা ‘ভাব’ছিলাম। ‘ভাব’টির একটি আপাতত আকৃতি পাঠককে দিতে পেরে আনন্দিত। হায়ারার্কি অব নীডস্ থিওরির আইকনিক পিরামিড কাঠামোটি ডক্টর মাসলোর অবদান নয়। তার ধারণার সূত্রে পরে কেউ তা বানিয়েছেন।
সূচকের আইটেমগুলো বিষয়ে আরো কিছু ব্যাখ্যা আমি দেবো। তার আগে প্রস্তুাবিত কাঠামোটি আংশিক ব্যাখ্যা করি।
১১টি আইটেমে মানুষকে ‘মূল্য দেয়ার’ প্রস্তাব করেছি। এর কোনোটিতে ২০ নম্বর, কোনোটিতে ১৫, ১০ বা ০৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১০০ নম্বর। সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সেরা মানুষের জন্য ১০০ নম্বর/ক্রেডিট পয়েন্ট থাকছে। তার মানে, আইটেমগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ২০ ও সর্বনিম্ন ৫ বরাদ্দ করা হয়েছে। একজন একটি আইটেমে নম্বর পাবার উপযুক্ত হলেও পুরো ৫ নম্বর (৫ নম্বরের ক্ষেত্রে) পাবার যোগ্য না-ও হতে পারেন।
পেতে পারেন ১, ২, ৩ বা ৪ও।

এই নম্বরের আবার ‘গুণ’ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের জন্য ১০০টি ঘর নিয়ে এই কাঠামো। প্রতি ২৫ ঘরের জন্য একটি ‘রঙ’ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাম থেকে ডানে ঘরগুলোর ‘গুণগত অতিরিক্ত মূল্য’ (ওয়েটেজ) বিবেচনা করা হবে। ২৫ ঘরের প্রতিটির রঙ হালকা থেকে ক্রমেই গাঢ় বা গভীর হয়েছে তার ‘গুণগত বেশি মূল্য’ (ওয়েটেজ) বোঝাতে।
আবার প্রস্তাবিত ১৫, ১০ ও ৫ নম্বরের অবস্থান সেই আইটেমটির ‘তুলনামূলক মূল্য’ (ওয়েটেজ) বোঝাতে প্রস্তাব করা হয়েছে।
১১টি আইটেমের ক্রম দেখানো হয়েছে জীবনে সেই আইটেমের তুলনামূলক মূল্য চিহ্নিত করার জন্য।
বলেছি, বিনোদন ও নানা ক্ষেত্রে নানামাত্রিক দক্ষতা মানুষের জীবনে কল্যাণকর ও আনন্দদায়ক বিবেচনায় কাক্সিক্ষত হয়ে থাকে। সেগুলো যদি পেশাদারী ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্জিত ও উপস্থাপিত হয়, তবে তা এ সূচকের ১ নম্বর খাত বা ‘জীবিকা’-র আওতায় গণ্য হবে। এ জন্য পৃথক ‘মূল্য’ পাওয়া যাবে না। বিনোদন ও দক্ষতা পেশাদারী ও বাণিজ্যিক হলে তা নানামুখী মন্দ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে/দেয়। ‘প্রস্তাবিত মূল্যের’ এ খাতটিকে গুরুত্বের বিবেচনায় ১১ নম্বর বা সব শেষে রাখা হয়েছে।
‘তুলনামূলক গুরুত্বের’ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কাঠামোর দ্বিতীয় বক্সে একে স্থান দেয়া হয়েছে।
‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ বিষয়ে আমার ধারণা : মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তি স্বাধীন না অধীন, স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না যে কোনো মূল্যে সুখ-সুবিধা অর্জন ও ভোগ করে জীবন যাপন কাক্সিক্ষত ভাবেন, তা এ সূচকে মানব-মূল্য নির্ধারণে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচিত হবে। স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা মানে নিজের মতো অন্য সবার স্বাধীন অস্তিত্বকেও সম্মান জানানো ও গুরুত্ব দেয়া।

এ জন্য পৃথক ‘মূল্য’ পাওয়া যাবে না। বিনোদন ও দক্ষতা পেশাদারী ও বাণিজ্যিক হলে তা নানামুখী মন্দ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে/দেয়। ‘প্রস্তাবিত মূল্যের’ এ খাতটিকে গুরুত্বের বিবেচনায় ১১ নম্বর বা সব শেষে রাখা হয়েছে।
‘তুলনামূলক গুরুত্বের’ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কাঠামোর দ্বিতীয় বক্সে একে স্থান দেয়া হয়েছে।
‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ বিষয়ে আমার ধারণা : মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তি স্বাধীন না অধীন, স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না যে কোনো মূল্যে সুখ-সুবিধা অর্জন ও ভোগ করে জীবনযাপন কাক্সিক্ষত ভাবেন, তা এ সূচকে মানব-মূল্য নির্ধারণে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচিত হবে। স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা মানে নিজের মতো অন্য সবার স্বাধীন অস্তিত্বকেও সম্মান জানানো ও গুরুত্ব দেয়া।
নিজে স্বাধীন থেকে অন্যদের অধীন রাখতে চাওয়া বা অন্যের অসহায় ও অনিচ্ছাকৃত অধীনস্থতা বিষয়ে নির্বিকার থাকাও অনৈতিক বিবেচিত হবে। অসংখ্য অধীন ও দাস্য-মনোবৃত্তির ব্যক্তির কাছ থেকে, বাহ্যত, সম্মান, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পাওয়ার চাইতে মাত্র একজন স্বাধীন ব্যক্তির কাছ থেকে সম্মান লাভ অনেক বেশি মূল্যবান, তাৎপর্যপূর্ণ ও তৃপ্তিকর বিষয়। এই বিবেচনাসম্পন্ন মানুষেরাই খাঁটি নৈতিকতার ধারক।

‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’-এর আরো সামান্য ব্যাখ্যা করি। স্বাধীন থাকা এবং থাকতে চাওয়া গুরুতরভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত কঠিন কাজ। এ জন্যই এই স্বাধীনতা প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে মূল্যবান বিষয়। স্বাধীন থেকে জীবিকা নির্বাহ এ ক্ষেত্রে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। একজন অধীন বা চাকরিজীবী কর্মঘণ্টা শেষে দিনের বাকি সময়টায় নিজেকে দায়হীন ভাবতে পারেন এবং মাস শেষে বেতনের, কমবেশি, নিশ্চয়তা পান। একজন উদ্যোক্তা দিন-মাসের কোনোপর্যায়ে নিজেকে দায়হীন ভাবতে পারেন না। ঝুঁকি মাথায় রেখেই তিনি সময় যাপন করেন, কাজ-দায়-ব্যবসা এগিয়ে নেন। সময় বা মাস শেষে মুনাফা পান অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হন। অন্য সব আইটেমে (জ্ঞান-নৈতিকতা- জনকল্যাণ ইত্যাদি) সমযোগ্যতার দু’জন যদি জীবিকার বেলায় স্বাধীন ও অধীন হন, অনেক বেশি উপার্জন-সুখ-সুবিধা ভোগকারী ‘অধীন ব্যক্তি’-র বিপরীতে ন্যূনতম উপার্জন-সুখ-সুবিধাভোগী স্বাধীন ব্যক্তির মূল্য প্রস্তাবিত সূচকে বহু ওপরে থাকবে।
মি. মারুফ নৈতিকতার প্রশ্নে গুরুত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। আমার এ সূচকে মানবমূল্য নির্ধারণে নৈতিকতাকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আইটেম ক্রমের ৬ নম্বরে ‘মানবীয় সুষমা’ ও ৭ নম্বরে ‘নৈতিকতা’ উপশিরোনামে, যথাক্রমে, ১০ ও ৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।
‘মানবীয় সুষমা’কে ‘উচ্চতর মানব যোগ্যতা’ নামও দেয়া যায়।

উচ্চতর মানব যোগ্যতার মধ্যে ভোগবিষয়ক বিবেচনা, ত্যাগবিষয়ক বিবেচনা, বৃহত্তর মানব-সংহতিবিষয়ক বিবেচনা, বৃহত্তর মানব-স্বার্থবিষয়ক বিবেচনা এবং উদারতাবিষয়ক বিবেচনা প্রভৃতি প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিকতা ব্যক্তিকে সর্বদা সততা-শুদ্ধতা রক্ষা, আইন-নীতি-অঙ্গীকার-আমানত রক্ষা, যাবতীয় মিথ্যা, ছলনা, প্রতারণা, হিংসা, অহঙ্কার, ক্রোধ, সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকার উৎসাহ-আদেশ দেয়। এটি সর্বদা মানুষের জন্য ক্ষতিকারকতা থেকে মুক্ত থাকার আদেশ দেয়। বিনয় ও ক্ষমার গুণ নৈতিকতার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
সময় ও বস্তুর, প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ নির্বিশেষে, অপচয় থেকে বিরত থাকার আপসহীন অবস্থান নেয়া নৈতিকতার অনিবার্য দাবি। ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার অপছন্দের, অসম্মানের, কষ্টদায়ক ‘সত্য তথ্য- বিবরণ’ প্রকাশ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে, অনৈতিক বলেছে। ‘হাত ও মুখ অন্যের জন্য অনিরাপদ’ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এ সবই দরদি ও কল্যাণকামী নৈতিক মানুষ গড়ার আয়োজন। বর্তমান প্রস্তাবেও এ নৈতিকতাকে মূল্যায়নের পরিকল্পনা আছে।
প্রাথমিক কয়েকটি ভাবনা জানিয়ে রাখি।

আমার এ সূচকের বিবেচনা ‘নির্বিশেষে সব মানুষের’ জন্য। ‘নির্বিশেষে সব মানুষের’ অর্থ বা ধারণা আমি কয়েকবার এই দেয়ালে লিখেছি। আমার এ সূচক মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য কেবল নয়, সব ধর্মানুসারী মানুষের জন্য। ধর্ম মানেন না, তেমন মানুষের জন্যও।
এ সূচক বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্যই নয়, সব নৃতাত্ত্বিক ও ভাষিক জনগোষ্ঠীর জন্য।
এ সূচক শিক্ষিত-সচ্ছল মানুষের জন্য কেবল নয়, শিক্ষা-বিত্ত নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য।
এ সূচক বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেবল নয়, এ বিশ্বের সব প্রান্তের সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-দলমত-আদর্শ-বিত্ত-বিদ্যা-বয়স-দৈহিক কাঠামো-সক্ষমতা-প্রতিবন্ধকতা-লিঙ্গ-পেশা-পদ-পদবি নির্বিশেষে সব মানুষকে বিবেচনায় রেখে এটি বানানো হয়েছে।
এ সূচকে মানব প্রজাতির সবাইকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। বিবেচনায় রাখা হয়েছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মানুষকেও।

এখন কোনো মুসলিম পাঠক যদি ধর্ম বা জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে এ সূচকের কাঠামোয় স্থাপন করতে বা খাপখাওয়াতে চান, তা তিনি করতে পারেন। তবে মনে রাখা উচিত, ইসলামের যাবতীয় বিবেচনা উভজাগতিক (আমি এ নতুন পরিভাষাটি পরিচিত ও জনপ্রিয় করতে আগ্রহী। আমার উপস্থাপিত এ পরিভাষাটির ইংলিশ প্রতিশব্দ হিসেবে এখনো both-worldly-কে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এর চাইতে আরো যুতসই-লাগসই ইংলিশ প্রতিশব্দ এখনো খুঁজছি। সমর্থন আশা করি) অর্থাৎ ইহজগৎ ও পরজগতের মিলিত রূপ। ইহজগতসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি কমবেশি বোঝা গেলেও পরজগতসংশ্লিষ্ট বহু কিছু আমাদের এই বস্তু-কাঠামোর মানব অস্তিত্বের পক্ষে বোঝা ও উপলব্ধিতে নেয়া প্রায় অসম্ভব। এ জন্য ইসলাম অনুমোদিত একটি মানব-মূল্য পরিমাপের সূচক উপস্থাপন এখানে লক্ষ্য নয়। তবে এখানে উপস্থাপিত প্রায় সবগুলো সূচক প্রশস্ততরো ইসলামী বিবেচনা থেকে কমবেশি গ্রাহ্য হতেও পারে।
ইসলাম অনুমোদিত সেরা মানুষের বৈশিষ্ট্য এ লেখার শুরুর দিকে বলা হয়েছে, পাঠক মনে রেখেছেন আশা করি।
বর্তমান সূচকে ১১টি ভাগ/খাত দেখানো হয়েছে। এগুলোকে ৪টি বৃহত্তর ভাগ বা ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
সূচক-ক্রমের ১ এবং ১১কে একটি বৃহত্তর ভাগে রাখা যায়। মানুষের সাধারণ জীবনযাপন ও অবাণিজ্যিক-অপেশাদার দক্ষতা ও বিনোদনকে একটি ভাগে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর একক নাম দেয়া যাক জীবন দক্ষতা ও বিনোদন। এ দুই খাতের জন্য প্রস্তাবিত মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ২৫ (২০+৫) নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগে জ্ঞানসংশ্লিষ্ট ৩টি সূচককে রাখা যায়। জ্ঞানার্জন, স্বেচ্ছাকৃত জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি খাতের জন্য মোট ৩০ (১০+৫+১৫) নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। মানবজীবনে এই জ্ঞানসংশ্লিষ্ট খাতের মূল্য বিষয়ে প্রায় কোনো ধর্ম, মতবাদ বা বিবেচনাতেই ভিন্নমত বা বিতর্ক নেই। এ ভাগের একক নাম দেয়া যায় জ্ঞান, বিতরণ ও সৃষ্টি।
আমার প্রস্তাবিত সূচকে একটি বৃহত্তরো মানব কল্যাণবিষয়ক খাতের উচ্চতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সূচক ক্রমের ৫ ও ৮ নম্বর তথা মানবকল্যাণ ও পরিবেশ কল্যাণকে এ ভাগে রাখা যায়। এ ভাগের একক নাম দেয়া যায় সাধারণ মানবকল্যাণ। এ ভাগের জন্য ২০ (১৫+৫) নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। মানবজীবনে এ বিষয়ক মূল্যও প্রায় সর্বজন স্বীকৃত।
চতুর্থ বৃহত্তর ভাগে সূচক ক্রমের ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর খাতকে একসাথে ‘মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব’ নাম দেয়া যায়। এই ভাগে দেখা যাচ্ছে রয়েছে মানবীয় সুষমা (১০), নৈতিকতা (৫), স্বাধীনতা প্রশ্ন (৫) ও অনুসারী (৫)।
মানবমূল্য ও গুণ পরিমাপের তারেক ফজল সূচকের ১১টি খাতকে চারটি বৃহত্তর ভাগে দেখানো গেল।
আলহামদুলিল্লাহ, এটি একটি ক্ষুদ্র অগ্রগতি।
স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন নামের এক মার্কিন রাজনীতি বিজ্ঞানীর নাম পাঠক জেনে থাকবেন। সদ্য বিগত এই পণ্ডিত ১৯৯৩ সালে ‘সভ্যতার সংঘাত’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পরে তার সেই ধারণা একটি গ্রন্থে পরিণত হয়। মনে করা হয়, বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিষয়ে ডক্টর হান্টিংটন ১৯৯০ সালের দিকেই তার ভাব-এর প্রকাশ ঘটাতে থাকেন এবং ১৯৯৩ সালে মার্কিন ‘ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’ নামের জার্নালে তা প্রবন্ধের রূপ দেন। পরে তা-ই একটি গ্রন্থের আকার পায়। পাঠক এ ইঙ্গিতটি স্মরণে রাখতে পারেন।

দু’টি ফিগারে ‘মানবমূল্য ও গুণ পরিমাপের তারেক ফজল সূচক ২০২২’ উপস্থাপন করা হয়েছে। একটিতে টেবিল কাঠামোয় সূচকটি উপস্থাপিত হয়েছে। কাঠামোটিতে বামপাশে সূচকের ১১টি খাতে ১০০ নম্বর বণ্টন করা হয়েছে। প্রতিটি খাতের জন্য বরাদ্দ করা নম্বর ডানপাশে চারটি কলামে দেখানো হয়েছে। প্রতিটি কলামে পঁিচশটি ঘর বা খোপ-বাক্স আছে। প্রতিটি কলামের সেই পঁিচশ ঘরের বাছাই করা ঘরগুলোতে বরাদ্দকৃত নম্বর দেখানো হয়েছে।
চারটি কলামে ভিন্ন রঙ দেয়া হয়েছে। রঙগুলো নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রথম কলামে লাল রঙ ‘ন্যূনতম মূল্য বা গুরুত্ব’ বোঝাতে নেয়া হয়েছে। অনেকটা ‘রেড লাইন’ অর্থে।
দ্বিতীয় কলামে নীল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে ‘লাল-এর চাইতে ভালো’ অর্থে।
তৃতীয় কলামে বেগুনি রঙের ব্যবহার করা হয়েছে তুলনামূলক সেরা বোঝাতে।
চতুর্থ কলামে সবার সেরা বোঝাতে সবুজ রঙ দেয়া হয়েছে।

১১টি খাতের ৬টিই পেয়েছে ৫ নম্বর করে। কিন্তু সেই ‘৫ নম্বরের’ গুরুত্ব ভিন্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে ‘নির্দিষ্ট রঙ বিশিষ্ট ভিন্ন কলামের বাছাই করা স্থানে স্থাপনের’ মাধ্যমে।
স্বেচ্ছাকৃত জ্ঞান বিতরণ, পরিবেশ কল্যাণ ও অপেশাদারি-অবাণিজ্যিক দক্ষতা-বিনোদন- এই তিনটি উপখাতের জন্য ৫ নম্বর করে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং সেগুলোর জন্য দ্বিতীয় বা নীল রঙের কলামটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
অনুসারী নামের খাতের জন্য ৫ নম্বর বরাদ্দ করা হলেও তার ‘স্থান হয়েছে’ তুলনামূলক সেরা তৃতীয় বা বেগুনী কলামে।
নৈতিকতা ও ‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ শীর্ষক দু’টি উপখাতের জন্যও ৫ নম্বর করে বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর ‘স্থান হয়েছে’ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের চতুর্থ বা সবুজ রঙের কলামে।
জ্ঞানার্জনের জন্য ১০ নম্বর এবং মানবীয় সুষমার জন্যও ১০ নম্বর করে বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু প্রথমটির জন্য মধ্যবর্তী দুই কলাম এবং দ্বিতীয়টি বা মানবীয় সুষমার জন্য সেরা বা শেষ ২ কলাম বরাদ্দ করা হয়েছে।
জ্ঞান সৃষ্টি এবং জনকল্যাণ শীর্ষক দুটো উপখাতের জন্যই ১৫ নম্বর করে বরাদ্দ করা হয় এবং সেই দুটোকেই গুরুত্ব বিবেচনায় সেরা বা শেষ তিন কলামে স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জীবন উপভোগ শীর্ষক উপখাতের জন্য ২০ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে এবং প্রথম কলামেই তা দেখানো হয়েছে।
প্রতিটি কলামের রঙ নির্দিষ্ট পঁচিশটি ঘরে ক্রমগভীরতায় দেখানো হয়েছে।
১১টি খাতকে গুরুত্ব বিবেচনায় ১ থেকে ১১ ক্রমিকে সাজানো হয়েছে। আবার এই ১১টি খাতকে চারটি বৃহত্তর ভাগে দেখানো হয়েছে।
পাই চার্টেও সেই চারটি বৃহত্তর ভাগ দেখানো হয়েছে।
প্রথম পাই চার্ট দেখে পাঠকেরা তা পছন্দ করেছেন, সেটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ-শুভেছা জানাই। কিন্তু ইতোমধ্যেই আমি প্রিয় পাঠক ফুয়াদ খানের মন্তব্যের জবাবে লিখেছি, বাহারি রঙের হওয়ায় পাই চার্টটি ‘দৃষ্টি সুখ’ দিলেও তাতে এখনো সূচকের খাতগুলোকে ‘তাৎপর্য প্রকাশক গুরুত্ব ও চিহ্নসহ উপস্থাপন’ করা সম্ভব হয়নি। সূচকটির খাত বিষয়ে উপযুক্ত (সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন-প্রতিস্থাপন) পরামর্শ হবে সেরা অবদান। এ কাজে পাঠকের সেরা অবদান আশা করি।

মানব-মূল্য ও গুণ পরিমাপ সূচকের খাতগুলোকে ১১টি ভাগ থেকে ৪টি বৃহত্তর ভাগে দেখানো হয়েছে। তাতে দেখা যায়, মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে জীবনদক্ষতা ও বিনোদন ভাগে ২৫ নম্বর, জ্ঞান বিতরণ ও সৃষ্টি ভাগে ৩০ নম্বর, সাধারণ মানবকল্যাণ ভাগে ২০ নম্বর ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব ভাগে ২৫ নম্বর বরাদ্দ হয়েছে।
প্রথম দুই বৃহত্তর ভাগের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য বিষয়ে প্রশ্ন বা অস্পষ্টতা তেমন নেই।
সাধারণ মানব কল্যাণ বিষয়ক বৃহত্তর ভাগের গুরুত্ব-তাৎপর্য কেউ কেউ কম দিতে চান। খাঁটি অর্থে প্রাণ-জীব-প্রকৃতির কল্যাণের কাজই মহান ও সেরা মানুষের কাজ। ইসলামের মহান নবী মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষার সূত্রেই কবি লেখেন ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সবিছে ঈশ্বর’। ‘আর রব্ব (আল রব্ব)’ হিসেবে (রব্বুল আলামীন) আল্লাহ এ বিশ্বসহ বিশ্বসমূহের সব প্রাণ-জীবপ্রকৃতির বেঁচে থাকার অনিবার্য সব উপাদান নির্বিশেষে সবার জন্য অবারিত করেছেন ও রেখেছেন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রাণ-জীব-প্রকৃতির কল্যাণকর্ম হলো সেরা ভালো কাজ (আমালুন ছালিহুন)। সব ধর্ম এবং মতাদর্শই এ কাজের উচ্চ মর্যাদা দেয়। তাই এ কাজে নিবেদিতজনেরা সেরা ও মূল্যবান মানুষ।

মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব শীর্ষক একটি বৃহত্তর ভাগে চারটি খাতে ২৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। নীতিনিষ্ঠা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা, শান্তিনিষ্ঠা, সদালাপিতা, মিষ্টভাষিতা, মিতভাষিতা, মিতচারিতা, মিতভোগিতা, কোমলতা, দয়াশীলতা, দানশীলতা, স্নেহশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদারতা, অন্যের অগ্রাধিকার রক্ষা, অন্যের সম্মান রক্ষা, ‘গীবত-তোহমত’ পরিহার, নিরহঙ্কারিতা-দম্ভহীনতা, অনাড়ম্বরতা, মধ্যপন্থামুখিতা প্রভৃতি ‘মানবীয় সুষমা’র কিছু দিক। মানবীয় গুণপনার এসব দিক উচ্চকিত রাখার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ সেরা ও মূল্যবান মানুষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ন্যায্য দাবিদার।
নৈতিকতা মানবসমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সৎ-অসৎ, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রভৃতি বিষয়ে সাবধানতা রক্ষা করে ইতিবাচক অবস্থান ও পন্থা অবলম্বন করা নৈতিকতার অনিবার্য দাবি। যারা তা করেন, তারা মূল্যবান মানুষ হিসেবে স্বীকৃত।
‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ মানে স্বাধীনতা বিষয়ে ব্যক্তির বিবেচনা ও দৃষ্টিভঙ্গী। ‘স্বাধীনতা প্রীতি’ গুরুত্বপূর্ণ উচ্চতর মানব বৈশিষ্ট্য। নিজের স্বাধীনতাই শেষ কথা নয়, অন্যের স্বাধীনতাকে মূল্যবান ভাবা ও তা রক্ষায় নিষ্ঠা এখানে তাৎপর্যপূর্ণ শর্ত। এটি যিনি করবেন, তিনি সে জন্য মূল্যায়িত হবেন।
‘অনুসারী’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। যিনি নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ অনুসারী অর্জন করেন, তা তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এমন অনুসারির সংখ্যা ও গুণ অনুযায়ী ব্যক্তি মূল্যায়িত হওয়ার দাবি রাখেন।
মানবীয় সুষমা (১০), নৈতিকতা (৫), স্বাধীনতা প্রশ্ন (৫) ও অনুসারী (৫) মিলিয়ে ‘মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব’ শীর্ষক এই বৃহত্তরো ভাগের জন্য ২৫ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে।

মার্কিন মনস্তত্ত্ব-ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ডক্টর আব্রাহাম মাসলোর হায়ারার্কি অব নিডস তত্ত্ব বিষয়ে ইতোমধ্যে কিছু ধারণা দেয়া হয়েছে। তার আইকনিক পিরামিড কাঠামোটিতে আটটি ধাপের মানবীয় চাহিদার কথা বলা হয়েছে। এতে প্রধানত মানুষের ‘বিভিন্ন চাহিদার পর্যায়’ সম্পর্কে জানানো হয়েছে।
এর বিপরীতে আমি বিশ্বের সব বৈশিষ্ট্যের মানুষকে বিবেচনায় নিয়ে একটি ‘মূল্য ও গুণ সূচক’ দেখাতে চেয়েছি। এর ভেতরগত উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে সেরা মানুষ বিষয়ে নির্দিষ্ট ধারণা দিয়ে তাদেরকে সেরা মানুষ হওয়ার প্রতি সচেতনভাবে আগ্রহী করে তোলা।
সচেতন মানুষ এই মূল্য ও গুণসূচক বিষয়ে আগ্রহী হলে ও নিজেকে ‘মূল্যবান মানুষে পরিণত করার’ প্রচেষ্টায় নিবেদিত করলে আমার এ শ্রম সার্থক হবে।
ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant, German, ১৭২৪-১৮০৪) নৈতিকতা এবং নৈতিক স্বাধীনতা বিষয়ে চিন্তা করেছেন, ‘নৈতিকভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’ (morally liberated) মানুষ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন।
বলেছেন, যারা ‘কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা’ (categorical imperative of duties) দ্বারা চালিত হন, কাজ করেন, সিদ্ধান্ত নেন, তারাই নৈতিকভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মানুষ।

কান্টের মতে, মানুষ যে বিভিন্ন কাজ বা দায়িত্ব পালনের তাড়া বোধ করেন, প্রয়োজন অনুভব করেন, চাপ বোধ করেন, তা-ই হলো কর্তব্যের অনুজ্ঞা (imperative of duties)। কর্তব্যের এই অনুজ্ঞা দুই প্রকার: কর্তব্যের শর্তাধীন অনুজ্ঞা (hypothetical imperative of duties) এবং কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা (categorical imperative of duties)।
কোনো না কোনো বাস্তব বা বস্তুগত প্রয়োজন-চাপ-লোভ-আশার কারণে মানুষ যে কাজ করেন, দায়িত্ব পালন করেন, সাড়া দেন, তাকে বলে কর্তব্যের শর্তাধীন অনুজ্ঞা। আর কোনো বাস্তব বা বস্তুগত প্রয়োজন-চাপ-লোভ-আশার ঊর্ধ্বে উঠে কেবল নীতিগত কারণে বা নৈতিক সদিচ্ছা দ্বারা পরিচালিত-প্রভাবিত হয়ে মানুষ যে কাজ-দায়িত্ব পালন করেন, তাকে বলে কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা।

কিছু মানুষ কেন কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা দ্বারা চালিত হন, হতে পারেন? কান্টের মতে, মানুষ নৈতিক ইচ্ছার (moral will) দ্বারা জ্ঞান অর্জন করে ‘বিশুদ্ধ তত্ত্বগত যুক্তি (pure theoretical reason) ও ‘বিশুদ্ধ ব্যবহারিক যুক্তি’(pure practical reason)-র অধিকারী হয়। এ দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষ বোঝে ও মানে, এমন কিছু কাজ-দায়িত্ব-বিষয় আছে যা ‘মানুষ বলেই বা মানুষ হওয়ার কারণেই’ তার করা উচিত (ought to do)। এই ঔচিত্যবোধ (sense of oughtness) মানুষকে একই সাথে দৃশ্যমান জগৎ (phenomenal world) ও অদৃশ্য-আদর্শ জগৎ (noumenal world)-এর অংশ বানায়। এই ঔচিত্যবোধই তাকে কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা দ্বারা চালিত করে। এবং এই ঔচিত্যবোধই তাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বা নৈতিক স্বাধীনতা (moral liberty)-র যোগ্য বা অধিকারী করে তোলে।

প্রফেসর ইমানুয়েল কান্টের এসব ধারণার পূর্ববর্তী ইতিবাচক, নেতিবাচক ও সূচনামূলক (introducing) ধারণাগুলোর সাথে, ক্রমপূর্বে, প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন স্কটিশ চিন্তাবিদ ডেভিড হিউম (David Hume, 1711-1776, empirical theory knowledge), ইংলিশ চিন্তাবিদ জন লক (John Locke, 1632-1704, empiricist), ফ্রেঞ্চ চিন্তাবিদ রেনে ডেকার্টে (John Locke, 1632-1704, empiricist) ও ইংলিশ চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon, 1561-1626, empiricist)।
অভিজ্ঞতাবাদী (empiricist) ধারার চিন্তাবিদগণ বলেন, মানুষ জ্ঞান অর্জন করে তার পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে। এই জ্ঞান দিয়ে কেবল বস্তুর বাহ্যিক অবস্থা জানা যায়, নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। আর তাই তার পক্ষে নিশ্চিত সত্যে উপনীত হওয়াও সম্ভব নয়।
যুক্তিবাদী (rationalist) ধারার উত্তরাধিকারী কান্ট বলেন, মানুষ সদিচ্ছা (goodwill) ও নৈতিক ইচ্ছা (moral will)-র অধিকারী হওয়ায় তার পক্ষে বস্তুর ‘বাহ্যরূপ সম্পর্কিত জ্ঞান’ (knowledge of things as they appear to be) লাভের পাশাপাশি বস্তুর ‘প্রকৃত ও নিরপেক্ষ অবস্থা সম্পর্কিত জ্ঞান’ (knowledge of things- in-themselves) অর্জন করা সম্ভব। ডেকার্টের যুক্তিবাদের সাথে ডেভিড হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব বলে কান্ট দাবি করেন।
কান্টের মতে, নিরাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক ‘সদিচ্ছা’ ‘কর্তব্যের শর্তহীন অনুজ্ঞা’র ভিত্তি। আর ‘শর্তহীন অনুজ্ঞা’ মানুষের নৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।
কান্ট বলেন, ‘যুক্তির আইন’ দ্বারা ‘সদিচ্ছা’ নিয়ন্ত্রিত। আর যুক্তির আইন ‘ব্যবহারিক যুক্তি’ থেকে আসে। তাই সদিচ্ছা সর্বদাই ভালো। নৈতিক যুক্তি দ্বারা স্থিরীকৃত কর্তব্য পালনের মধ্যেই মানুষের যথার্থ নৈতিক স্বাধীনতা নিহিত।

সদিচ্ছা, নৈতিক ইচ্ছা, নৈতিক যুক্তি, কর্তব্যের শর্তাধীন ও শর্তহীন অনুজ্ঞা, ঔচিত্যবোধ, নৈতিক স্বাধীনতা, বিশুদ্ধ তত্ত্বগত যুক্তি, বিশুদ্ধ ব্যবহারিক যুক্তি প্রভৃতি কমবেশি ভারী ও জটিল পরিভাষা ও ধারণা প্রফেসর কান্ট উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নির্ভরযোগ্য গুণসম্পন্ন সেরা মানুষ খুঁজে পাওয়ার মানদণ্ড উপস্থাপন। ‘মানবমূল্য ও গুণ পরিমাপের তারেক ফজল সূচক ২০২২’ বৃহত্তর লক্ষ্যসম্পন্ন তেমন একটি উদ্যোগ-ধারণা-প্রচেষ্টা।
বর্তমান প্রস্তাবিত সূচকে ‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’ শীর্ষক একটি খাতের কথা বলা হয়েছে। প্রফেসর কান্টের চিন্তায় ছিল ঔচিত্য বোধসম্পন্ন ও নৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির খোঁজ করা।
বর্তমান উদ্যোগে মানুষের মূল্য ও গুণ পরিমাপের বিভিন্ন উপাদানের একটি হিসেবে ‘স্বাধীনতা প্রশ্ন’কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
লেখক : রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
tareqfazal@gmail.com

 

 


আরো সংবাদ



premium cement