পরিবার থেকেই শুরু হোক শিশুর প্রথম শিক্ষা
- মো: জাভেদ হাকিম
- ১২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
যাপিত জীবনে প্রত্যেক মানুষের সব চেয়েত বেশি, যা প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। আর এগুলো রপ্ত করতে বা করাতে হলে সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই হতে হবে। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্বা-স্নেহ ও পরোপকারী এবং উদার মানসিকতা এগুলো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব একটা অর্জন করা যায় না। একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যাবে, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশেও তার নাম ছড়াবে কিন্তু পরিবার হতে সুশিক্ষা না থাকলে এক সময় সব ম্লান হবে এবং এটা অবধারিত সত্য। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক, কিভাবে পরিবার থেকে শিক্ষা নেয়া ও শিক্ষা দেয়া যায়Ñ গ্রাম্য ভাষায় একটা প্রবাদ চালু আছে, থলি যদি ভালো হয় তা হলে সেখানে ভালো কিছু থাকবে। আম যদি মিষ্টি হয় তা হলে তার আঁটিও মিষ্টি হবে। অর্থাৎ একজন আদর্শ পরিবারের সন্তান সুসন্তান হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। শিশু যখন নিজ থেকেই হাত-পা নাড়তে শিখে, তখন থেকেই মূলত সে পরিবারের বড়দের কাছ থেকে শিখতে শুরু করে। আর তখন থেকেই তার সামনে বাবা-মা ও বড়দের কথাবার্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাড়ন্ত শিশুকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভালো-মন্দ বিষয়ে অবহিত করতে হবে। তার সাথে নরম সুরে, মার্জিত আচরণে বিভিন্ন বিষয়ে শেয়ার করতে হবে। শিশুদের মনমানসিকতা থাকে খুবই কোমল, তাই খুব সহজেই যেকোনো বিষয়ে তারা শিখে নিতে পারে। অনেক শিশুরাই দুষ্টমির ছলে মিথ্যা বলতে পছন্দ করে, বড়রা যখন বুঝতে পারবেন তখন তাদের কর্তব্য, আদর-স্নেহের মাধ্যমে বুঝিয়ে তার এই বদ-অভ্যাস থেকে বিরত রাখতে হবে। কোনো অবস্থাই শিশুকে গাল-মন্দ করা যাবে না, এতে সে আরো বেশি উৎসাহি হয়ে উঠবে। বড়দের দেখলে সালাম, তার চাইতে ছোটদের প্রতি স্নেহ, সমবয়সীদের প্রতি সুসম্পর্ক, অন্যকে তাচ্ছিল্য না করা এগুলো শিখাতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের খেয়াল করতে হবে তার সন্তান অন্যদের প্রতি কতটুকু উদার। ছোট্ট বয়স থেকেই মুক্ত মন-মানসিকতা গড়ে না উঠলে তা আর পরবর্তী জীবনে আয়ত্ত করা খুবই দূরূহ ব্যাপার। তাই একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য পিতামাতা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মাঝে মধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও উদার করা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে পরিবারের দু’জনই থাকেন নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত ফেলে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য তা থেকে সে হয় বঞ্চিত। যৌথ পরিবারের অভাবে, গৃহকর্মীর সান্নিধ্যে, ভার্চুয়াল জগতে মেতে থেকে শিশু হারায় তার সুশিক্ষা পাওয়ার মতো সোনালি সময়। বড়দের কিনে দেয়া খেলনা অস্ত্র দিয়ে ফ্লিমের ডন সাজা, মনিটরে কার্টুন দেখা আর অ্যাডভাঞ্চার গেম খেলে-শিশুর মস্তিষ্কে ধারণ করে যত সব উদ্ভট চিন্তা। ধারণ করা সেই কুচিন্তা-চেতনা থেকেই শিশু চায় তার বাস্তবায়ন।
ছোট থেকেই যেন শিশু পেতে পারে পারিবারিক শিক্ষা, সেই লক্ষ্যে কর্মব্যস্ত ও প্রত্যেক পরিবারের সন্তানের বাবা-মা এবং বয়োজৈষ্ঠদের কর্তব্য প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সন্তানকে জিজ্ঞাসা করাÑ তার সন্তান ধর্মীয় কর্ম পালন করেছে কি না। শুধু জিজ্ঞাসার মধ্যেই দায় সারলেই হবে না, রীতিমতো তাদেরকে বাধ্য করাতে হবে; যেমনি করে আমরা অফিসে থেকেও বাড়িতে ফোন দিয়ে খোঁজ নেই, সন্তান স্কুলের হোমওয়ার্ক ঠিকমতো করেছে কি না। প্রত্যেক ধর্মের অনুশাসনেই আদর্শ-সভ্যতা-নৈতিকতার শিক্ষা রয়েছে। আর ইসলামের আসমানি কিতাব কুরআন তো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সুতরাং একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন মেনে চলার মাঝেই, সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অভিভাবকদের কর্তব্য তার আদরের সন্তানকে সেগুলোর চর্চা করানো। সংসারের দু’জনকেই আজকাল চাকরি বা ব্যবসা করতে হয়। বাবা-মায়ের এই পরিশ্রম আদরের সন্তানদের নিষ্কণ্টক ভবিষ্যতের জন্য, তাদের বায়না মিটানোর জন্য।তাই তাদের ব্যক্তিজীবনও আলোকিত করার লক্ষ্যে শত ব্যস্ততার মাঝে কঠোর পরিশ্রমের ফাঁকেও সন্তানকে, সকালে স্কুলে পাঠানোর আগে বলে দিন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বড়দের দেখলে সালাম এবং তাদের সাথে নম্রতার সাথে শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে কথা বলার জন্য। সহপাঠীদের সাথে বিনয়ী আচরণ ও সবার সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। যদি কোনো ভুল করেও ফেলে তার পরেও যেন সে মিথ্যার আশ্রয় না নেয়, সেই বিষয়ে তাকে অভয় দেয়া। সে যদি কোনো বিষয়ে তার বন্ধুদের সহযোগিতা পায়, তা হলে যেন সে তার বা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বর্তমান সমাজে কৃতজ্ঞতা জানানোর মধ্যে রয়েছে যত কৃপণতা। আর এই কৃপণতা থেকেই সৃষ্টি হয়Ñ যত সব অনৈতিকতার সূত্র। একজন অকৃতজ্ঞ সমাজে সবচেয়ে ধিকৃত। সুতরাং নিশ্চই আপনি চাইবেন না, আপনার আদরের সন্তানের পরিণতি তেমন হোক। তাই আমাদের উচিত সন্তান যখন স্কুল বা কোচিং বা বাইর থেকে ফিরবে কিংবা আমরা যখন বাসায় ফিরব তখন আদর-স্নেহের সাথে জিজ্ঞাসা করা, সে যা সকালে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তার কতটুকু বাস্তবায়ন হলো। রক্তচক্ষুর বদলে পরম সোহাগের সাথে সন্তানের ভুলত্রুটি শুধরিয়ে দিলে অনেক বেশি কাজে আসে। তাই পিতামাতাকে সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করতে হবে, তা হলে দেখবেন সন্তান সব কিছুই আপনার সাথে শেয়ার করবে। যে সন্তান শেয়ার করতে শিখবে সেই সন্তান কখনো আদর্শহীন হবে না। পিতামাতাকে মনে রাখতে হবে, ঘরের পরিবেশ ভালো বলেই যে সন্তান সভ্য-ভদ্র ও আদর্শবান হবে এরকম আত্মতৃপ্তিতে ভোগা ঠিক হবে না।কারণ সবসময় গ্রাম্য সেই প্রবাদ কাজে নাও আসতে পারে। তাই সন্তান কাদের সাথে মিশল বা বন্ধুত্ব করল সে দিকেও অনুসন্ধানী খোঁজ রাখতে হবে। তবে খোঁজ রাখতে গিয়ে যেন আবার সন্তানের সম্মানে আঘাত না হানে। এতে করে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মনে রাখবেন মোটামুটি পাঁচ বা ছয় বছর বয়স হতেই আপনার ছোট্ট সোনামণির নিজস্ব সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়। অবশ্যই ছোট থেকেই সন্তানকে বা সন্তানের সামনে সুশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা ও তার মাঝে চর্চার প্রচলন ঘটাতে হবে। শিক্ষিত হওয়ার জন্য যেমন একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি সন্তানকে, সুস্থ মানসিকতার ধারক ও বাহক হওয়ার জন্য সভ্যতা-ভদ্রতা-নৈতিকতা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো মননের অধিকারী যেন হয় সেই বিষয়ে পিতামাতাকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রসঙ্গ লেখনীর মধ্যে একাধিক বার আসার কারণ হল, যিনি তার পালন বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সক্ষমÑ তিনি যেন জগতের সব কর্মে সফল। মোদ্দা কথা বিচক্ষণ পিতামাতা বা অভিভাবকদের সন্তানরাই সমাজে আদার্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত। তাই শত কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকেও বেশ কিছুটা সময় সন্তানের জন্য তথা অন্তত অবসর সময় টুকুন কাটান সন্তানের সাথে। পিতামাতাদের আরো একটা ব্যাপার খেযাল রাখা চাই, সেটা হলো শিশুদের জন্য ভ্রমণও অন্যতম শিক্ষার মাধ্যম।
ছবি : মোরশেদ নাসের টিটু