দিনে দিনে ঘুরে আসি
- মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
- ২২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
দুই দোস্ত মোটরবাইকে ছুটলাম সাভারের জাহাঙ্গীরনগর সোসাইটি লাগোয়া বালুর মাঠে। ধারেকাছে ঘোরাঘুরির জন্য আমার অ্যাডভেঞ্জারই হলো প্রিয় যানবাহন। বাইক চলছে। চলতে চলতে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। ওয়াও! চারদিকে কাশফুল আর কাশফুল। এ যেন কাশফুলেরই রাজ্য। কাশফুলের মাঝ দিয়ে যাওয়া পথে, মোটরবাইক এগিয়ে যায়। একটা সময় হারিয়ে যাই কাশফুলের ভিড়ে। বাতাসের দোলে কাশফুল নড়েচড়ে। বেশি বাতাসে কাশফুলে ঢেউ খেলে। এ এক অন্য জগৎ। যে জগতে শুধু প্রকৃতিই সব। ঘুরতে ঘুরতে দেখি, তেজোদীপ্ত সূর্যটা সেদিনের মতো তার আপন পথ খোঁজে। সূর্যরশ্মি কমার সাথে সাথে কাশফুলের রাজ্যেও যেন এবার মায়াবী ছন্দের ভালোলাগা ভর করে। প্রকৃতির সেই ছন্দের তালে তালে হেঁটে বেড়াই। জমিনের সাদা সাদা কাশফুল আরো নতুনরূপে চোখে ধরা দেয়। বেড়ে যায় ভালো লাগার মাত্রা। কাশফুলের জগৎ যেন সাদা চাদরে ঢাকা। চার পাশে সাদা আর সাদা। মাথার ওপর শুভ্র মেঘের ভেলা। দেখতে দেখতে ভর সন্ধ্যা। বাইক স্টার্ট। কাশফুলের রাজ্য পেছনে ফেলে, বাইক ছুটে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দৃষ্টিনন্দন পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বটতলায় দুপুরের আহার ভাত-ভর্তা দিয়ে উদর পূর্তি করে ছুটি, সিঅ্যান্ডবি সড়ক ধরে শ্যামপুর গোলাপ গ্রামে। হাজার হাজার গোলাপের মাঝে নিজেকে কিছুটা সময় বিলিয়ে দিয়ে, সবুজে বারোভাজা খেতে খেতে চলে যাই এবার বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি।
বিরুলিয়া যাওয়ার সময় পথের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে একাকী গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করবে, পাগলা হাওয়ার তরে। গাইতে গাইতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের বাড়িতে। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় নিরাশ হবেন না। কিংবা কারো বারণ শুনে চলেও আসবেন না। চলে যাবেন বাড়ির ভেতরে। এবার দাঁড়ান কিছুক্ষণ উঠোনে। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার মাথায় কিছু একটা ভর করছে। কি ভয় পেলেন? আরে নাহ, তেমন কিছু না। জাস্ট অন্দরমহল দেখার নেশা জাগবে, এই যা। নেশার পারদ যখন চরমে তখন ভেতরে ঢোকা আর ঠেকায় কে। স্থানীয় কিশোর মঞ্জুকে সঙ্গী করে প্রথমে অন্দরমহলে ঢুকি। এরপর একেবারে চিলেকোঠা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখি। জমিদার বাড়িটিতে মোট ১১টি স্থাপনা রয়েছে। লোকমুখে জানতে পারি, বর্তমানে দুটো হিন্দু পরিবারের বসবাস রয়েছে। তারা নাকি জমিদারের বংশধর। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। আমরা যে স্থাপনাটিতে ঢুকেছি তা পুরোই ফাঁকা। ঘরের মেঝে, সিলিং, দরজা, জানালায় এখনো তৎকালীন আভিজাত্য দৃশ্যমান। নেই শুধু পাইক-পেয়াদাদের হাঁকডাক। কিংবা বাঈজীর নূপুরের আওয়াজ। দেখতে দেখতে দোতলা পেরিয়ে ছাদ। এরপর চিলেকোঠায়। বাহ্ আজ আর নেই কোনো জমিদারের নিরাপত্তারক্ষীদের হুঙ্কার। নেইকো কোনো বাধা। ইচ্ছেমতো ছাদ থেকে পুরো বাড়ি ও তার আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখি। বাড়িটি এক সময়কার প্রমত্তা তুরাগ নদের তীরে। বর্ষায় যার রূপ-যৌবন অনেকটাই ফিরে আসে। আসে না শুধু জমিদার রজনীকান্তের শৌর্যবীর্য। এই বাড়ির পূর্ব মালিক ছিল জমিদার নলিনী মোহন সাহা। তার কাছ থেকে ৮৯৬০ টাকা ৪ আনা দিয়ে জমিদার রজনীকান্ত ক্রয় করেছিলেন। বাড়িটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটা মন্দির, সদর ঘর, বিচার ঘর, সাজঘর, বিশ্রামাগার, পেয়াদা ঘর, ঘোড়াশালসহ আরো কিছু ঘর। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় রজনীকান্ত ঘোষের স্মৃতিসহ মূল্যবান অনেক কিছুই লুট হয়ে যায়। শুধু লুট হতে পারেনি জমিদার রজনীকান্তের নাম। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে ঘুরতে গেলে, মনের ভেতর একপ্রকার নস্টালজিয়া কাজ করে।
পুরো বাড়িটি ঘুরে, এবার গিয়ে উঠলাম কোষা নৌকায়। তুরাগের পানিতে প্লাবিত বিলে নৌকা ভাসে। চার পাশের অনেক গ্রাম মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। যা আপনাকে হাওর ভ্রমণের আনন্দ অনেকটা বিরুলিয়াতেই দেবে। ভাসতে ভাসতে বিচ্ছিন্ন এক বটবৃক্ষের ছায়ায় নৌকা ভিড়াই। সেখান থেকে বিরুলিয়ার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখে বোঝানো সম্ভব না। শুধু এতটুকুনই লিখব, ঢাকার আশপাশ থেকেও যারা এখনো বিরুলিয়া দেখেননি, তারা যেন সুখময় জীবনানন্দ সূত্রটার খোঁজ পাননি।
চলেন যাই : মোটরবাইক বা সাইকেলে বেস্ট। আর যাদের দুটোর কোনোটাই নেই তারা যেতে পারেন গুলিস্তান বা গাবতলীসহ ঢাকার অনেক বাসস্টপিজ থেকেই সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকশা/অটোতে জাহাঙ্গীরনগর সোসাইটির বালুর মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, গোলাপ বাগান ও বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি দেখার জন্য লেগুনা/অটোতে চড়ে যাওয়া যাবে।
ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ