বিশাল জলরাশির মহেশখালী
- সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
- ০১ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
কেউ মহেশখালী যাক আর না যাক, মহেশখালীর পানের খিলি খাক আর না খাক কিন্তু শেফালী ঘোষের গাওয়া এই বিখ্যাত গানটি সবারই শোনা আছে। শেফালী ঘোষের এই গানের মাধ্যমেই নাকি মহেশখালীর নাম সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তখনো নাকি কক্সবাজারের মতো মহেশখালী তেমন পরিচিত ছিল না। মহেশখালীর প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্যের কথা দেশের বেশির ভাগ মানুষ জানত না। আর বর্তমানের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, এখন মহেশখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। যে কেউ কক্সবাজারে ঘুরতে গেলে, মহেশখালী ঘুরে দেখার জন্য একদিন হাতে রাখেই যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি তো দু-এক বছরের মধ্যে অন্তত একবার হলেও কক্সবাজারে যাই কিন্তু সাত বছর ধরে মহেশখালী যাওয়া হয়নি। এবার কক্সবাজার গিয়ে সমুদ্রসৈকতে এক ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠে শেফালী ঘোষের এই বিখ্যাত গানটি শুনতেই সিদ্ধান্ত নিলাম মহেশখালী ঘুরতে যাবো। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরের দিন সকালে আমরা বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার থেকে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা দিলাম।
কক্সবাজারের বিআইডব্লিউটিএ-এর ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে দেখি বঙ্গোপসাগর চ্যানেলটি বেশ উত্তাল হয়ে আছে। এই অবস্থা দেখে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। দু’জন বলল, যেতে হবে না কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। একজন প্রস্তাব রাখে সড়কপথে চকরিয়া থেকে বদরখালী হয়ে মহেশখালী যেতে কিন্তু এতে অনেক সময় লাগবে। তাই বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে স্পিডবোটে করেই রওনা দিলাম। স্পিডবোটে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের পথ কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই আমাদের সবার চোখে পানি এসে গেল। অবস্থা ছিল এমন, ঢেউয়ের আঘাতে স্পিডবোট যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। প্রাণভয়ে আমাদের একজন হাউমাউ করে কান্না করছিল। যা হোক, বিশাল এক দুঃসাহসিক অভিযান সেরে আমরা পৌঁছে গেলাম মহেশখালীর জেটির ঘাটে। এই জেটি ঘাটটি ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করে। ঝাউবনের মধ্য দিয়ে ১৮২টি পিলারের ওপর জেটি দণ্ডায়মান।
জেটি স্থাপন হওয়ার আগে মহেশখালীর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নাজুক। স্পিডবোট থেকে নেমে ঝাউবনের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সরু জেটি ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দুই পাশে ঝাউবন, সুনসান নীরবতা, সাঁইসাঁই বাতাস সময়টাকে আরো রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। ইতোমধ্যেই আমাদের সব ভয় কেটে যেন একটা আলাদা প্রশান্তি অনুভব করছি। জেটির শেষ প্রান্তে এসে মিলল রিকশা এবং টমটম। সারা দিনের জন্য আমরা একটা টমটম ভাড়া করে নিলাম।
টমটমে প্রথমে গেলাম রাখাইন পাড়ায়। সেখানে বেশ কিছু সময় ঘুরে দেখলাম তাদের জনজীবন, হস্ত ও বস্ত্রশিল্পের কারুকাজ। কারো কারো সাথে গল্প করেছি এবং তাদের ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। এদের বাংলায় কথা বলার প্রণটা আমার শুনতে বেশ মজা লাগে। তবে শুধু গল্পই করিনি, পছন্দমতো আমরা কিছু হস্ত ও বস্ত্রশিল্প কিনে নিলাম। তারপর এদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। মুগ্ধ হয়ে অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন, দৃষ্টিনন্দন, কারুকার্যখচিত স্বর্ণমন্দির দেখতে দেখতে একসময় প্রচণ্ড রকম ক্ষুধা অনুভব করলাম। তখন কাছেই একটা খাবার হোটেলে ঢুকে সামুদ্রিক কোরাল মাছ ও বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম মৈনাক পাহাড়ে। সেখানেই অবস্থিত আছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো আদিনাথ মন্দির। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছেই চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে আদিনাথ মন্দিরের চারপাশ দেখলাম।
প্রতি বছর মার্চের ৪ তারিখ চতুর্দশী মেলা বসে এখানে, লাখ লাখ মানুষের মিলনমেলা হয়। তখন এ স্থানটি হয়ে ওঠে বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। ইচ্ছে ছিল সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে দেখার কিন্তু সবারই ছিল ফিরে যাওয়ার তাগিদ। তাই পরে সোনাদিয়া দ্বীপ দেখার ইচ্ছে রেখে আবারো ফিরে গেলাম কক্সবাজার। আর হ্যাঁ, ফেরার পথে মহেশখালীর কিছু পানের খিলি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।
যেভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বা প্লেনে করে কক্সবাজার যাওয়া যায়। ট্রেনে করে যেতে হলে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে কক্সবাজারের বাস ধরতে হবে। কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী বিচ থেকে রিকশা বা টমটম করে বিআইডব্লিউটিএর ৬ নম্বর ঘাটে যেতে হবে। সেখান থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে করে মহেশখালী যেতে হবে।
স্পিডবোটে মাথাপিছু ৭৫ টাকা ও ট্রলারে ৩০ টাকা খরচ পড়বে।