বাংলায় কুরআনের প্রথম অনুবাদক কে
- শাহ্জাহান আলী খাঁন
- ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১১:৪১
বর্তমানে আমাদের দেশে বাংলায় কুরআন শরিফ সহজে সবখানেই পাওয়া যায়। এক সময় এমন ছিল না। যারা কুরআন পড়তে জানতেন, তারা তিলাওয়াত করেই ক্ষান্ত দিতেন। আর যারা কুরআন নিয়ে গবেষণা ব্যাখ্যা, তরজমা বা আলোচনা করতেন তারা সবাই উর্দু-ফারসিতে পারদর্শী ছিলেন। তাই তারা সে ভাষাতেই পড়তেন, পড়াতেন ও গবেষণা করতেন।
প্রাচীন আমল থেকে আমরা যদি বিভিন্ন মিউজিয়াম, জাদুঘর, মসজিদ খানকাসহ যেখানে যেখানে শিলাপিলি পাওয়া গেছে সেসব অনুসন্ধান করে দেখতে পাই, কুরআনের আয়াত রয়েছে বটে, কিন্তু কোনো বাংলায় অনুবাদ ছিল না। সবাই জানে কুরআন বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেছে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৮০-৮৬ সালে বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদ সম্পন্ন করেন। তখনকার সময়ে আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা একজন অমুসলমানের পক্ষে সত্যিই কঠিন ছিল।
যেখানে বড় বড় আলেমরা সাহস পাননি, প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি সেখানে একজন হিন্দু লোক এমন একটি কাজ করতে পারেন তা সত্যিই অবাক করার মতো। গিরিশচন্দ্র এই অনুবাদের জন্য আরবি ভাষা শিখেছেন, অনুবাদ করতে গিয়ে ফার্সি-উর্দু ভাষা শিখেছেন। গিরিশ চন্দ্রের এই অবাক করা কাজটিকে মাসিক মোহাম্মাদির সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে আরো একটি তথ্য যোগ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি যে, ভাই গিরিশচন্দ্র ১৮৮৫-৮৭ সালে মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর জীবনীও বাংলায় প্রথম রচনা বা সঙ্কলন করেন। সেই বইয়ের নাম ছিল ‘মহাপুরুষ চরিত’। এটিও কম আশ্চর্যের কথা নয়। কেননা ওই সময়ের আগে অন্য কেউ নবীজীর জীবনী লিখেছেন বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন থেকে প্রায় দুই শত বছর আগে ১৮০৮ খিষ্টাব্দে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলা চিলখাল মটুকপুর গ্রাম নিবাসী মৌলভী আমির উদ্দীন বসুনিয়া আমপারার কাব্যানুবাদ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের তিনিই পথিকৃৎ, যদিও তা আংশিক ছিল। জানা যায়, এই আমপারা সে কালের লিথো প্রেসে মুদ্রিত হয়েছিল। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৬৮।
মুদ্রণের সঠিক তারিখ জানা না গেলেও মুদ্রণরীতির বৈশিষ্ট্যে ভাষার শব্দগত ব্যবহারে গ্রন্থখানি প্রাচীনত্বের দাবি করতে পারে। এর একটি কপি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে অদ্যাবধি রক্ষিত আছে। আমির উদ্দিন বসুনিয়াকৃত কাব্যানুবাদের প্রকাশকাল আনুমানিক ১৮০৮ অথবা ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ ধরা হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত লেখক ও প্রাচীন পুঁথিসংগ্রাহক অতি পরিচিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) তার সঙ্কলিত ‘বাংলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ গ্রন্থেও এক স্থানে আমির উদ্দিন বসুনিয়ার বাংলা আমপারার কথা লিখেছেন বেশ গুরুত্বসহকারে। আবার অনেকে মনে করে থাকেন আমির উদ্দিন বসুনিয়ার এই সরল বাংলা কাব্যানুবাদখানি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে।
রংপুরের কুণ্ডি পরগণার সেই সময়ের বিখ্যাত জমিদার কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থানুকূল্যে সর্বপ্রথম গোপালপুরের কাছে শ্যামপুর রেলস্টেশনের কাছে যে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে পূর্ববঙ্গের সর্বপ্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ’ প্রকাশ করেছিলেন সে সময়টা ছিল ১৮৪৭ সাল। খুবসম্ভব এই প্রেসেই ছাপা হয়েছিল বসুনিয়ার এই কুরআনের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থটি। কবি আমির উদ্দিন বসুনিয়ার পবিত্র কুরআনের আমপারার বঙ্গানুবাদ ১৮৬৬ সালে ছাপার অক্ষরে আসে বলে অনেকেই মনে করেন। সেই হিসেবে ভাই গিরিশচন্দ্রের প্রায় বিশ বছর আগে রংপুরের আমির উদ্দিন বসুনিয়াই কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী। যদিও তা আংশিক ছিল, তা সত্ত্বেও তিনিই কুরআনের প্রথম অনুবাদকারী হিসেবে বাংলার মুসলমানসমাজে অমর হয়ে আছেন।
এরপরে উল্লেখ করা যেতে পারে টাঙ্গাইলের করটিয়ার মৌলভী মুহম্মদ নইমুদ্দীন (১৮৩২-১৯১৬) সাহেবের কথা। তিনি আখবার ইসলামিয়া পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনিও পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদে সফল হননি। এদের ছাড়াও কুরআন তরজমায় আরো কিছু কিছু ব্যক্তি হাত দেন, তবে এদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরিফের অনুবাদে কৃতিত্ব অর্জন করেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার চণ্ডিপুর গ্রামের অধিবাসী মৌলভী আব্বাস আলী (১৮৪৬-২২)। মৌলভী আব্বাস আলী পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদ করেন এবং প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে। তাই বলা চলে, মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআনের বঙ্গানুবাদের গৌরবের দাবিদার মৌলভী আব্বাস আলী (১৮৪৬-২২)। এরপর পূর্ণাঙ্গ কুরআন যিনি অনুবাদ করেন, তিনি হলেন- রংপুরের খান বাহাদুর তসলিম উদ্দীন আহম্মদ (১৮৫২-১৯২৭)।
তিনি রংপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট (১৮৭৭) কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। খান বাহাদুর তসলিম উদ্দীনকৃত এই মহাগ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ তরজমা ১৮৯১ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২২ বছরব্যাপী তার অকান্ত পরিশ্রমের ফসল। এরপর যার নাম করা যেতে পারে, তিনি হলেনÑ টাঙ্গাইল জেলার মৌলভী আবুল ফজল আবদুল করিম। তিনিও সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন। তার অনুবাদের বৈশিষ্ট্য হলো- সেই অনুবাদের সাথে আরবিও রয়েছে। তিনি প্রথম জীবনে একটি হাইস্কুলের হেড মৌলভী ছিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ফার্সি ছাপার প্রুফ রিডার হিসেবে চাকরি নিয়ে চলে যান। এর পর থেকে নাম না জানা অনেক অনুবাদকই আংশিক কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন।
এ ছাড়া কুরআনের উৎকৃষ্ট অথবা বিশেষ বিশেষ আয়াতগুলোর তরজমা এবং কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তা ছাড়া কুরআন নিয়ে কাব্যানুবাদও করেছেন, বাংলা সঙ্কলন বের করেছেন। তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় এবং তারা হলেন- আবদুল মজিদ, মোহম্মদ আবদুুল হাকিম, আলী হাসান, কিরোন গোপাল সিংহ, মাওলানা রুহুল আমীন, মুহম্মদ আকরম খাঁ, এয়ার আহম্মদ, কুদরাত-ই-খুদা, কাজী নজরুল ইসলাম, মীর ফজলে আলী, মুহম্মদ আযহার উদ্দীন, ফজলুর রহীম, আবুল ফজল, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, মুহম্মদ তৈমূর ও খন্দকার সাইদুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।
লেখক : প্রবন্ধকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা