৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসকনের শুরু যেভাবে, বিতর্কিত যে কারণে

ইসকনের শুরু যেভাবে, বিতর্কিত যে কারণে - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করার পরেই তার সাথে যে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের যোগ ছিল, সেই ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ- ইসকনকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

ইসকন উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে বলেও অভিযোগ তুলছেন অনেকে। আবার এর আগে ইসকনকে যেসব দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সব তথ্যও তুলে ধরে বাংলাদেশেও সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। যদিও বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হাইকোর্ট ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন আমলে নেয়নি।

আবার ইসকন আসলেই হিন্দু ধর্ম প্রচার করে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক নজরে আসে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই।

এই প্রতিবেদনে ইসকন আসলে কী কাজ করে, তার ওপরেই আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে।

ইসকনের জন্ম
দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে জন্ম নেয়া অভয়াচরন দে পরবর্তী জীবনে অভয়া চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী 'প্রভুপাদ' বা এসি ভক্তিবেদান্ত ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা। তাকেই ধর্মগুরু বলে মানেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইসকনের লাখো ভক্ত।

কলকাতায় ইসকনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র রাধারমণ দাস বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশ নিয়েছেন। অনেক বেশি বয়সে তিনি এই কলকাতাতেই তার গুরু মহারাজের দেখা পান। তিনিই এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদকে আদেশ দেন যে পাশ্চাত্য দেশগুলাতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের প্রচার চালাতে। তার যখন প্রায় ৭০ বছর বয়স, সেই সময়ে তিনি একটি মালবাহী জাহাজে চেপে কলকাতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে পৌঁছান। সেটা ছিল ১৯৬৫ সালের ১৬ জুলাই।’

ইসকনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার সময়ে এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামীর সাথে মাত্র কয়েক ট্রাঙ্ক ভর্তি বই এবং মাত্র সাত মার্কিন ডলার ছিল।

ইসকনের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৬ সালে আর এসি ভক্তিবেদান্তের মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বের বহু দেশে গেছেন। ৪০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

বর্তমানে পাঁচ শ’টিরও বেশি বৃহৎ কেন্দ্র। এর বাইরেও বহু মন্দির, স্কুল, কয়েক হাজার স্থানীয় গোষ্ঠী, প্রায় এক শ’ নিরামিষ রেস্তোরাঁ পরিচালনা করে থাকে ইসকন। এছাড়াও নানা সমাজকল্যামূলক কাজ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ বিলি করে থাকে তারা।

এই সংঘের প্রধান কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মায়াপুরে।
সংঘটি দাবি করে এই মায়াপুরেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী চৈতন্যদেব।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ প্রচার
ইসকন দাবি করে যে তাদের আধ্যাত্মিক মতাদর্শের ভিত্তি হলো সংস্কৃতে রচিত ভগবৎ গীতা এবং ভগবৎ পুরাণ।

রাধারমণ দাস বলেন, ‘আমরা গৌড়ীয় ব্রহ্ম মাধব সম্প্রদায়। ইসকনের ভাবাদর্শ হলো এই বাংলার যে বৈষ্ণব মতবাদ, অর্থাৎ গৌড় অঞ্চলের বৈষ্ণব ধারা, সেটাই আমরা বিশ্বে ছড়িয়ে দিই’।

ইসকন সদস্যরা নিজস্ব মন্দিরগুলোতে পূজার বাইরেও নানাভাবে নিজেদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। রাস্তায় খোল-করতাল নিয়ে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ মন্ত্র পাঠ করে নেচে অথবা সেমিনারসহ নানাভাবে তারা ইসকনের মতবাদ প্রচার করেন বিশ্বজুড়ে।

‘হিন্দু ধর্মেরই অঙ্গ ইসকন’
ইসকন যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ প্রচার করে তা আদৌ হিন্দু ধর্ম কি না, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।

পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির প্রধান নবকুমার ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা করছিলেন যে হিন্দু ধর্মে যে পাঁচটি সম্প্রদায় রয়েছে, তারই অন্যতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়। অন্য সম্প্রদায়গুলো হলো- শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য।

তার কথায়, ‘হিন্দু ধর্ম হচ্ছে দর্শনের সমন্বয়ে একটা পরম্পরা। একেকটি সম্প্রদায়ের একেকটি দর্শন রয়েছে। এই যে শাক্ত সম্প্রদায়ের একেবারে বিপরীতে রয়েছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়। আবার সবাই যে বেদের পক্ষে তা নয়। এই দর্শনে চার্বাকের মতো স্বীকৃত দর্শন আছে, যেখানে নাস্তিকতার কথা বলা হয়েছে।’

‘মূল হচ্ছে ব্রহ্মের ভাবনা। কেউ সাকার, কেউ নিরাকার-ভাবে ব্রহ্মের ভাবনায় যুক্ত থাকেন। ইসকন যে ভাবাদর্শ মেনে চলে, সেটা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দর্শন, তার সাথে সময়ের সাথে কিছু নতুন ভাবনা যুক্ত হয়েছে। তাই ইসকনের ভাবধারা নিশ্চিতভাবেই হিন্দু ধর্মেরই অঙ্গ। তাদের সেই স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে সবসময়ে। যারা হিন্দু ধর্মবিরোধী, তারাই এসব প্রশ্ন তুলে থাকে,’ বলছিলেন হিন্দু ধর্মের পণ্ডিত নবকুমার ভট্টাচার্য।

ইসকনকে নিয়ে যেসব বিতর্ক
পাশ্চাত্যের দেশসহ বিশ্বের নানাদেশে ইসকনের লাখো ভক্ত ছড়িয়ে আছে। এদের মূল নাম ছাড়াও ইসকনের ভক্ত হিসেবে পৃথক একটি নাম দেয়া হয়ে থাকে।

ইসকনের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে ব্রহ্মচারীর জীবন বেছে নিয়েছেন। ইসকনের বিখ্যাত ও ‘কোটিপতি’ সদস্যদের মধ্যে আছেন ফোর্ড মোটর্সের মালিক হেনরি ফোর্ডের প্রপৌত্র অ্যালফ্রেড ফোর্ড, দ্য বিটলসের অন্যতম মুখ জর্জ হ্যারিসন, কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এবং অ্যাপেলের সাবেক সিইও স্টিভ জবস।

বিখ্যাত মানুষদের সমাবেশ যেমন হয়েছে ইসকনে, তেমনই নানা সময়ে বিতর্কেও জড়িয়েছে ইসকন।

যেমন সংঘ-প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিক থেকেই সিঙ্গাপুরে ইসকন নিষিদ্ধ থেকেছে দীর্ঘকাল। সংঘটির রেজিস্ট্রেশন আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে পরে অন্য নাম নিয়ে সেদেশে শুরু হয় ইসকনের কর্মকাণ্ড। এখন সেখানে একটি মন্দির আছে এবং ইসকনের ভক্তরা খোলাখুলিই কাজ করেন।

এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখনো ইসকন তার কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। চীনেও তাদের গোপনে কাজ করতে হয় বলে ইসকনের ওয়েবসাইটে একটি পুরানো নিবন্ধে লেখা হয়েছে। তবে পাকিস্তানে ইসকনের অন্তত ১২টি মন্দির রয়েছে বলে সংঘটি দাবি করে। রাশিয়াসহ অনেক দেশে ইসকনের ধর্মীয় প্রচারণার পদ্ধতি নিয়ে মামলা হয়েছে নানা সময়ে।

এই বিতর্কিত বিষয়গুলো সম্বন্ধে প্রশ্ন করতেই কলকাতায় ইসকন কেন্দ্রের মুখপাত্র রাধারমণ দাস ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে বলেন অন্য সময়ে কথা বলবেন।

তবে হিন্দুত্ববাদের গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘ইসকন নানা দেশে বিতর্কে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসবগুলোর কারণ একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম। ইসকনের বিভিন্ন সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ উঠেছে যে তারা আর্যতত্ত্বে বিশ্বাসী, বর্ণবাদী ইত্যাদি। শিশু হেনস্থার অভিযোগ এসেছে।

বাংলাদেশে ইসকন কী কাজ করে?
সাম্প্রতিক ইসকনের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে নানা আলোচনা তৈরি হয়। তাদের ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ইসকনের আন্দোলনে দেশী-বিদেশী ইন্ধন রয়েছে।

সেদিন রাতে এক বিবৃতিতে ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সনাতনী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্যদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষায় কাজ করেন তারা।

ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা প্রসাদ দাস বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমরা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সেবামূলক কাজ করি।’

ইসকনকে ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে বলা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের


আরো সংবাদ



premium cement