স্মৃতিতে ভাস্বর সাংবাদিক শামছুর রহমান
- অধ্যাপক মো: মসিউল আযম
- ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০৫
আজ ১৬ জুলাই ২০২১। যশোরবাসীর জন্য, বিশেষ করে যশোরের সাংবাদিকদের কাছে, একটি শোকের দিন। ২০০০ সালের এ দিনেই আমরা হারিয়েছি, সাংবাদিক জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সাংবাদিক শামছুর রহমানকে।
সাংবাদিক শামছুর রহমান ছিলেন দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানিসহ ভয়ঙ্কর অপরাধী ও তাদের গডফাদারদের আতঙ্ক। তার বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও জনকণ্ঠ পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন অপরাধ ও অপরাধীদের ওপর সচিত্র প্রতিবেদন এবং তাদের কুকীর্তির কথা তুলে ধরেন। বারবার টেলিফোনে হুমকি আসতে থাকে তার এই লেখনী থামানোর জন্য। কিন্তু এই সাহসী সাংবাদিক আরো দুর্বার গতিতে চালাতে থাকেন লেখনী। এতে স্বার্থান্বেষী মহল লিপ্ত হয় গভীর ষড়যন্ত্রে। অবশেষে তারা পথের কাঁটা চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পথ বেছে নেয়। হায়েনাদের তপ্ত বুলেটের আঘাতে, তিনি চিরতরে হারিয়ে যান আমাদের মাঝ থেকে।
১৯৮০ সাল। যশোর প্রেস ক্লাবের পুরাতন ভবন থেকে আবুল হোসেন মীরের সম্পাদনায় দৈনিক ঠিকানা পত্রিকা বের হতো। যশোরে আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, তাদের অনেকেরই হাতেখড়ি এই পত্রিকায়। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার যশোর সংবাদদাতা। অধ্যাপনার পাশাপাশি ছিল সাংবাদিকতার নেশা। দৈনিক ঠিকানায় খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করতাম ফিচার এডিটর হিসেবে।
একদিন দুপুরে এই পত্রিকা অফিসের ডেস্কে বসে আছি। ২০-২২ বছর বয়সী এক তরুণ যার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, এসে খুবই বিনয়ের সাথে আমার সামনে বসার অনুমতি চাইল। জানাল, সে যশোর এমএম কলেজের ছাত্র। বলল, ‘আপনাদের পত্রিকায় শার্শা এলাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা ছাপাতে চাই।’ সানন্দে তার প্রস্তাবে সাড়া দিলাম। এরপর সে নিয়মিত সংবাদ পাঠাতে থাকে। মাস খানেক পর একদিন আমাকে আবদার জানাল, আমাদের এলাকার একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আপনাকে যেতে হবে।
নির্ধারিত দিন ও সময়ে হাজির হলাম শার্শা বাসস্ট্যান্ডে। হেঁটে হেঁটে বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম। পরদিন দৈনিক ঠিকানার লিড নিউজ ছাপা হলো। শিরোনাম ছিল ‘দাদখালি বামনার বিল প্রকল্পটি আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে।’ খবরটি খুবই সাড়া জাগিয়েছিল।
এভাবে সাংবাদিকতা ও সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যমেই শামছুর রহমান কেবলের সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তার মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ছাইচাপা আগুনের জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। তাকে শার্শা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিই।
আশির দশকে যশোরে ছিল সাংবাদিক সঙ্কট। আমার একটি কাজ ছিল ঢাকার পত্রিকার জন্য নতুন নতুন সাংবাদিক সৃষ্টি করা। শামছুর রহমান কেবলকে নিয়ে আমার স্বপ্ন, তাকে কিভাবে জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে আমাদের সাথী করা যায়। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর যশোর প্রতিনিধি। ওই সময় ঢাকায় দৈনিক বাংলার মফস্বল সম্পাদক ছিলেন শামছুল আলম। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও দৈনিক বাংলার মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। আমি ছিলাম সাংবাদিক সমিতির যশোর জেলা সম্পাদক। সফি ভাইয়ের সাথে দৈনিক বাংলা অফিসে যাতায়াতের মাধ্যমে মফম্বল সম্পাদক শামসুল আলমের সাথে আমার পরিচয় ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সময় যশোর সেনানিবাসের বিশেষ শাখার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল মাসুদ। এ ছাড়াও ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর; তারা শামসুল আলমের নিকটাত্মীয়। তাদের সাথেও ছিল আমার ঘনিষ্ঠতা।
ওই সময় দেবব্রত সিংহ ছিলেন দৈনিক বাংলার যশোর সংবাদদাতা। আইন পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করতেন। পেশাগত কাজে খুবই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সাংবাদিকতা পেশায় সময় বেশি দিতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় শামসুল আলম ভাইকে একান্তভাবে বললাম, কেবলকে আপনার পত্রিকায় স্থান করে দিতে হবে। তিনি বললেন, নড়াইলে আমাদের প্রতিনিধি নেই। যশোরে বসে নড়াইল কভার করা সম্ভব নয়। তার বদলে প্রস্তাব করলাম তাকে নওয়াপাড়া সংবাদদাতা করতে। নওয়াপাড়া প্রতিনিধি আবশ্যক মর্মে একটি বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করা হলো। নওয়াপাড়া ডেটলাইনে ১০-১২টি সংবাদ দৈনিক বাংলার পাতায় ছাপা হওয়ার পর কেবলকে পেপার কাটিংসহ আবেদন করতে বলি। ইতোমধ্যে দেবব্রত সিংহ স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
পরবর্তীকালে কেবল তার নিজ প্রতিভা ও নিষ্ঠার সাথে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় দায়িত্ব পালন করেছে। নিজ পেশার প্রতি ছিল খুবই যতœবান ও আন্তরিক। ফলে দ্রুত দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বিশেষ স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন তাকে খুব ¯েœহ করতেন। দৈনিক বাংলায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
সাংবাদিক হিসাবে ভারত ও চীন সফরের সুযোগ হয়েছে তার। ভারতের মতো একটি বিরাট দেশে নির্বাচনী খবর সংগ্রহে দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় তাকে। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তিনি যখন দস্যু ফুলন দেবীর নির্বাচনী এলাকায়, ফুলন জানতে পারেন, বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক তার নির্বাচনী এলাকার খবর সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। মাইকে ঘোষণা করা হলো, সভা শেষে তার সাথে দেখা করার জন্য। রাতে তার বাসভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানো হলো এই সাংবাদিককে। ফুলন দেবী তাকে যে সম্মান দেখিয়েছে তা ছিল অনন্য।
নিজ এলাকার মানুষের প্রতি তার ছিল খুবই দরদ। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার অফিসে কেউ দেখা করলে খুবই আন্তরিকতার সাথে তাদের সহায়তা করত। কেবল আজ আমাদের মধ্যে নেই। এখন তার অসমাপ্ত কাজ, স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সমাজ উন্নয়নকর্মী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা