বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন ভাবনা
- ড. মো: এরশাদ হালিম
- ১০ জুলাই ২০২৪, ০০:০৫
শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশে উৎসাহ দেয়া হয়। তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যেসব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। মূলত শিক্ষা মানুষকে ভালো আর মন্দের পার্থক্য করতে শেখায়। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। গড়ে তোলে বিকশিত মানুষরূপে। তাই শিক্ষা অমূল্য এক সম্পদ, জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষকরা হচ্ছেন সেই শিক্ষার ধারক-বাহক, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা জাতির প্রকৃত স্থপতি।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় মূলত চারটি ধাপ : ১. প্রাথমিক; ২. মাধ্যমিক; ৩. উচ্চ মাধ্যমিক ও ৪. উচ্চ শিক্ষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ দু’টি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। কারণ শিক্ষার্থীরা যখন এ পর্যায়ে থাকে তখন তাদের নিজস্ব বোধবুদ্ধি থাকে না। যে পথে চালানো হয় সে পথেই তারা চলে। তাই তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে প্রয়োজন হয় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক যারা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে শ্রেণিকক্ষে বন্ধুত্বসুলভ পরিবেশে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন।
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো উচ্চ শিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষার চারণভূমি। বিশ্ববিদ্যালয় মূলত উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান, যেখানে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় একাডেমিক ডিগ্রি দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন শিক্ষার্থীদের জীবনের বাঁকবদলের সূচক। এখান থেকে একজন শিক্ষার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি অর্জন করে কর্মদক্ষতা ও আত্মনির্ভরশীলতা। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে নেই কোনো প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের ব্যবস্থা। না বুঝে অন্ধের মতো অর্জিত মুখস্থ বিদ্যা এখানে তেমন কাজে আসে না। এখানকার লেখাপড়া অনেকটা অনুশীলন ও উদ্ভাবন-নির্ভর।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেশাগত কাজ দু’টি : ১. শিক্ষাদান ও ২. গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার মতো নয়। এখানে শিক্ষকরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে কারিকুলাম পরিবর্তন করেন, যা একাডেমিক কাউন্সিল অনুমোদিত এবং এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের যুগোপযোগী শিক্ষাদানের জন্য তৈরি করে তোলেন। তাদের সর্বদা পড়াশোনার চর্চা করতে হয়। রাত-দিন গবেষণা করে নিত্যনতুন তথ্য উদ্ভাবন করতে হয়, যা প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিকে আরো বেগবান করে। এ কাজে শিক্ষকদের দিতে হয় প্রচুর সময় ও শ্রম। ফলে ব্যক্তিগত জীবনযাপনে এখানকার বেতনভাতা ছাড়া তাদের প্রায়শ থাকে না বিকল্প আয়ের উৎস। কাজেই শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতনভাতা নিশ্চিত করে তাদের সামাজিক মর্যাদার সুরক্ষা দেয়া দরকার।
পেটে ক্ষুধা থাকলে কোনো কাজ ঠিকভাবে করা যায় না। সংসারে অভাব-অনটন লেগে থাকলে দৈন্যদশাসংবলিত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সুষ্ঠু পাঠদান কোনোভাবে সম্ভব নয়। গবেষণার মতো কর্মকাণ্ড তো বহুদূর! একই সাথে ভবিষ্যৎ জীবন বা অবসরকালে যাতে কোনো টেনশন করতে না হয়, সে জন্য চাকরি শেষে থাকতে হবে পর্যাপ্ত আনুতোষিক ও পেনশনের নিশ্চয়তা। সেটি যদি না থাকে তবে তাদের বৃদ্ধ বয়সে পরিবার-পরিজন নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে দুই মুঠো ভাতের জন্য। এমন ভাবনা নিয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়া অলীক স্বপ্নমাত্র।
একজন সরকারি চাকরিজীবী চাকরি শেষে যে মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন মূলত সেটিই আমরা পেনশন বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে- ১. মাসিক পেনশন ভাতা ও ২. আনুতোষিক- এ দুটোর সমন্বয়কে পেনশন বলা হয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশন পাওয়ার প্রথম শর্ত হলো সরকারি নিয়মকানুন অনুসারে একজন চাকরিজীবীকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকাল পর্যন্ত চাকরি করতে হয়। শর্ত পূরণ (২৫ বছর চাকরিকাল) ছাড়া শতভাগ পেনশন পাওয়া যায় না। তবে চাকরির মেয়াদ ২৫ বছরের কম হলে শতাংশ হারেও পেনশন পাওয়া যায়। এ ব্যবস্থায় একজন সরকারি চাকরিজীবীকে তার সর্বশেষ মূল বেতনের ৯০ শতাংশের অর্ধাংশের ২৩০ গুণ পরিমাণ টাকা আনুতোষিক বা গ্র্যাচুইটি হিসেবে দেয়া হয়। পাশাপাশি মূল বেতনের ৯০ শতাংশের অর্ধাংশ মাসিক মাসিক-ভাতা হিসেবে তিনি পান যেটিকে মূলত আমরা পেনশন বলে থাকি। অধিকন্তু পিআরএলে থাকাকালে ১২ মাসের ছুটিতে গিয়েও মূল বেতন পেয়ে থাকেন। এর বাইরে পান সামান্য পরিমাণ চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা। এভাবে পেনশন অবসর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা দেয়। পাশাপাশি প্রদান করে মানসিক প্রশান্তি এবং নিশ্চিত করে অবসর জীবনযাপনকালীন জীবনমান।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সব সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের আনুতোষিক অর্থ দিয়ে শেষ জীবনে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। মাসিক যে ভাতা পান তা নিয়ে দু’বেলা খেয়েপরে থাকেন। এর পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে যদি কোনো সঞ্চয় থাকে সেটি সঞ্চয়পত্র অথবা অন্য কোথাও লগ্নি করে স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু জমা থাকলে সেটি ছেলে-মেয়েদের বিয়েশাদি বা পড়াশোনায় ব্যয় করতে হয়। এরপরে স্বামী-স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় প্রতিনিয়ত লাগে। সব কিছু মেটাতে পেনশনটুকুই একমাত্র সম্বল। যদি এতটুকু নিশ্চয়তা না থাকে তবে মেধাবীরা এখানে কেন আসবেন?
মনে রাখা দরকার, এ বাণিজ্যিক ও বৈষয়িক ধ্যান-ধারণার যুগে অন্যান্য চাকরির সব সুযোগ উপেক্ষা করে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা যাদের পেশা হিসেবে প্রথম পছন্দ তারা সত্যিকার অর্থে নির্মোহ জীবনযাপন মেনে নিয়ে এখনে আসেন। পড়াশোনা ও গবেষণার পর সৃষ্টিশীল কিছু করা তাদের লক্ষ্য। এর পরও যদি আর্থিক টানাপড়েনের পাশাপাশি অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ভাবতে হয় তবে পড়াশোনা ও গবেষণা দুটো একসময় মুখথুবড়ে পড়বে। কারণ দুটো মানসিক শান্তি ও মস্তিষ্কের কর্মতৎপরতার সাথে গভীরভাবে জড়িত। উপরন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সততা মানবজীবনের প্রকৃত শিক্ষা। বাকিগুলো সব দক্ষতা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা দুই প্রকার : ১. চারিত্রিক শিক্ষা ও ২. কারিগরি বা সৃজনশীল শিক্ষা। এ দুটো একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এদের পরস্পর থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। যে ব্যক্তি চরিত্রবান হন; তিনি কোনো একটি বিষয়ে অবশ্যই দক্ষ হন। আবার দক্ষতা অর্জন করলে তিনি চরিত্রবান নাও হতে পারেন। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সততা ও নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পর্যাপ্ত বেতনভাতা, জীবন মান ও পেনশনের নিশ্চয়তা না থাকলে তারা পরিণত হবেন সততা ও নৈতিকতাবর্জিত একটি সম্প্রদায়ে। পড়াশোনা ও গবেষণায় ফাঁকি দিয়ে নিজেদের আরো বেশি নিয়োজিত করবেন বিভিন্ন নন-একাডেমিক কাজে। এতে একসময় খুবই দুর্বল হয়ে যাবে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা। জাতি ও রাষ্ট্র হারিয়ে যাবে উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে পশ্চাৎপদতার দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। অতএব, প্রত্যয় পেনশন স্কিম তো দূরের কথা; বরং বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ও বেতনকাঠামো আরো উন্নত করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে। মূলত শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজের উন্নয়ন মানে জাতির উন্নয়ন। অতএব, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা