রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বুঝবেন কিভাবে
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৪ মে ২০২৪, ০০:০৫
মহামতি হজরত আলী রা:-এর একটি অমিয় বাণী দিয়েই আজকের নিবন্ধটি শুরু করতে চাই। হজরত আলী বলেন, এমন একটি জমানা আসবে যখন হত্যাকারী জানবে না বা বলতে পারবে না সে কেন হত্যা করছে। অপর দিকে, নিহত ব্যক্তিও বুঝবেন না, কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে। আজকের সমাজে হত্যাকারী এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হতভাগ্যের হালহকিকত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে মহামতি সক্রেটিসের একটি বাণী উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, এমন একসময় আসবে যখন মূর্খরা তাদের মূর্খতার জন্য গর্ব অনুভব করবে, পণ্ডিতরা তাদের পাণ্ডিত্যের জন্য অনুশোচনা করবে এবং দুর্নীতিবাজরা তাদের দুর্নীতির জন্য উল্লাসনৃত্য করবে।
হজরত আলী রা: অথবা সক্রেটিসের বাণীর সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে এমন দৃশ্য যদি আপনি আপনার চারপাশে দেখতে পান তবে আপনি নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকজনের আয়ুষ্কাল বেশি দিন নেই।
আমাদের দেশের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময় এবং নিকৃষ্ট সময়ের মধ্যে যদি পার্থক্য করার জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে বলা হয় তবে সবার আগে ন্যায়বিচারের কথা আসবে। এখানে ন্যায়বিচার বলতে কেবল অপরাধীর শাস্তি নয়; বরং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তি এমন এক সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে অপরাধ করার চিন্তা মানুষের মস্তিষ্কে আসে না এবং যদি কোনো অপরাধ সঙ্ঘটিত হয় সে ক্ষেত্রে অপরাধী যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন, তার মধ্যে শাস্তির ভয় প্রবল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশ করে না।
উল্লিখিত অবস্থা সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার সব স্তরে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেসব রাজা-বাদশাহ-সম্রাট সফল হয়েছেন তারা সবাই নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনসহ পাত্র-মিত্রদের আইনের আওতায় রেখেছেন। সফল রাষ্ট্রনায়কদের সবার ক্ষেত্রেই এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য মিল রয়েছে। তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিত-দার্শনিক ও সাহসী সৈনিকদের একত্র করতে পেরেছিলেন এবং প্রত্যেক বিভাগ থেকে শ্রেষ্ঠতর মানুষটিকে মানসম্মান, মর্যাদা ও পদ-পদবি দিয়ে রাজদরবারে স্থান দিয়েছিলেন। আরো অবাক করা বিষয় হলো, পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শাসকদের দরবারে ৯ জন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থাকতেন তাদের নররতœ বা নাইন জুয়েলস বলা হতো।
পাক-ভারতের রাজনীতিতে মুঘল সম্রাট আকবরের নবরতেœর সুনাম-সুখ্যাতি সারা দুনিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কিন্তু আকবরের আগে সুলতানি জমানার বাদশাহ ইলতুৎমিসেরও নবরতœ ছিলেন। তার আগে গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এবং সমুদ্রগুপ্তের রাজদরবারে নবরতœ হিসেবে যারা ছিলেন তারা আকবরের দরবারের নবরতেœর চেয়েও উজ্জ্বলতর এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে অধিকতর পারদর্শী ছিলেন। গুপ্ত যুগের আগে মৌর্যযুগে বিশেষত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুমার এবং অশোকের নবরতœদের সাথে তুলনা করা যায় এমন রাজপুরুষ পৃথিবীতে খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। যেমন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চানক্যের মতো দ্বিতীয় কোনো মেধাবী রাজপুরুষ পৃথিবী এখনো পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।
ভালো শাসকদের মতো মন্দ শাসকদেরও একদল সাঙ্গপাঙ্গ থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকেরা মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে। এসব সিন্ডিকেটে সাধারণত দু’টি সংখ্যা ইতিহাসে তাৎপর্য পেয়েছে। মন্দ শাসকদের সিন্ডিকেটে সাধারণত ১০ জন অতি নিচু প্রকৃতির দুর্বৃত্ত থাকে। রাজা যদি দীর্ঘায়ু পান এবং তার রাজ্যসীমা যদি খুব বড় হয় তবে সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা ৪০ হয়ে থাকে। আরব্যরজনীর বিখ্যাত ডাকাত আলী বাবার যেমন ৪০ জন সহযোগী ছিল, তেমনি পাক-ভারতের সবচেয়ে অত্যাচারী জুলুমবাজ রাজা বাদশাহদের ৪০ জন করে সহযোগী ছিল।
ভালো শাসকদের নবরতœরা সবার আগে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থাকে সবার উপরে স্থান দেন। রাষ্ট্রের আইন-কানুন নিয়ম-নীতি স্বয়ং রাজা বা বাদশাহ মানতে বাধ্য হন। সামান্য ভুলের জন্য রাজপরিবারের সদস্যদের কারাগারে যেতে হয়। সম্্রাট আকবরের জমানায় যুবরাজ জাহাঙ্গীর বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। একাধিকবার গৃহবন্দী ছিলেন। প্রকাশ্য রাজদরবারে হাতেপায়ে শৃঙ্খল পরিয়ে যুবরাজকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। আর সেই বিচার এতটাই নির্ভুল নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ ছিল যার কারণে যুবরাজ যখন সিংহাসনে বসলেন, তখন রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থাকে আরো উন্নত এবং আরো জবাবদিহিমূলক করে তুললেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিচারব্যবস্থার যে অনন্য ইতিহাস তা আজও আগ্রার দুর্গে ফতেহপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদে এবং মহাকালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।
শৈশবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের ন্যায়বিচারের ইতিহাস পড়েছি। বড় হওয়ার পর তার রাজ্যের বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক ভিত্তি, সামরিক শক্তি এবং তার মহত্ত্ব সম্পর্কে জানার পর তার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এমন স্তরে পৌঁছাল যে, ভারত ভ্রমণের সময় আমি যখন সম্রাটের প্রাসাদগুলো পরিদর্শন করছিলাম তখন সম্রাটের তাবৎ কর্ম চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো আমার সামনে ভাসতে থাকল। একজন মহান শাসক যার রাজ্যের পরিধি প্রায় অর্ধকোটি বর্গকিলোমিটার যা কি না আধুনিক ভারতের আয়তনের প্রায় দেড়গুণ এবং যার নিয়মিত সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫ লাখেরও বেশি এবং যিনি সারা দুনিয়ার জিপিপির ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন সেই তিনি প্রজাদের প্রতি কতটা দরদি ছিলেন তা তার বিচারব্যবস্থার নমুনা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট নূর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার শয়নকক্ষে একটি ঘণ্টা স্থাপন করেছিলেন এবং সেই ঘণ্টার সাথে যে দড়ি ছিল তা প্রাসাদের বাইরে সিংহদরজার পাশে একটি বিশেষ স্থানে টেনে নেয়া হয়েছিল। যারা আগ্রা অথবা ফতেহপুর সিক্রি গেছেন তারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, সিংহদরজা থেকে সম্রাটের শয়নকক্ষের দূরত্ব কতদূর। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়েছে, আগ্রা দুর্গের ন্যায়বিচারের ঘণ্টার দড়ির দৈর্ঘ্য চার হাজার গজের কম নয়, আর ফতেহপুর সিক্রিতে যেটি হবে অন্তত পাঁচ হাজার গজ।
আজকের জমানার মতো মুঘল যুগেও জেলা জজ, প্রাদেশিক জজ, কেন্দ্রীয় আদালত এবং সবার উপর সুপ্রিম কোর্ট ছিল। যার প্রধানকে বলা হতো কাজী উল-কুজ্জাত। পুরো সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থা এতটাই স্বাধীন; সার্বভৌম ও নীতিনিষ্ঠ ছিল যে, জেলা পর্যায়ের বিচারকরাও সম্রাটের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারতেন। আবার আজকের দিনের রাষ্ট্রপতির মতো স্বয়ং সম্রাট সব বিচারকের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। দ্বিতীয়ত, মুঘল জমানায় কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মচারী বা রাজপুত্র অথবা সম্রাটের কোনো দায়মুক্তি ছিল না। বিচারকরা বিচার করতেন স্বাধীনভাবে, কিন্তু ভুল করলে ঊর্ধ্বতন আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে সেখানে অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল।
সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থা অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীর তার প্রাসাদে বিচারের ঘণ্টা স্থাপন করেছিলেন। কোনো সংক্ষুব্ধ নাগরিক যদি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেন তবে তিনি যেকোনো সময় সেই ঘণ্টা বাজিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। প্রাসাদের সিংহদ্বারে বিচারপ্রার্থী যেন বিনা বাধায় আসতে পারেন এবং নির্ভয়ে যখন তখন ঘণ্টা বাজিয়ে সম্রাটের কাছে নালিশ জানাতে পারেন তা শতভাগ নিশ্চিত করা হয়েছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে কেউ ঘণ্টা বাজিয়েছেন এবং সম্রাটের সাক্ষাৎ পাননি এমন একটি ঘটনাও নেই। অন্যদিকে, বিচারপ্রার্থীরা খুশি হননি, ন্যায়বিচার পাননি এমন ঘটনাও নেই। সুতরাং ২০২৪ সালের বাংলাদেশের গণভবন বঙ্গভবনসহ রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোর সামনে দিয়ে চলাফেরার সময় আপনার মনে যদি সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিচারের ঘণ্টার কথা মনে হয় তবে আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, কেন ভারতবাসী প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর মুঘলদের যেমন মাথার তাজ বানিয়ে রেখেছিল তদ্রƒপ শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে রাখার জন্য অকাতরে হাজার হাজার ভারতবাসী প্রাণ দিয়েছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের ন্যায়বিচারের ঘণ্টার বিপরীতে যুগ যুগে বহু রাজা তার রাজ্যের আনাচে-কানাচে শত শত অবিচার-অনাচার এবং অত্যাচারের ঘণ্টা স্থাপন করেছিল। জনগণ যেন বিচার পেতে না পারে সেজন্য মানুষের বাকশক্তি দৃষ্টিশক্তি এবং চিন্তাচেতনার ওপর আগ্নেয়গিরি স্থাপন করে দিয়েছিল। গল্পের হাল্লা রাজার মতো এমন অনেক রাজা ছিলেন যারা সত্যবাদীদের জিহ্বা কেটে দিত। যারা অন্যায়-অবিচার দেখতে পেতেন তাদের অন্ধ করে দিত। মানুষ যেন কুকর্মের কথা বুঝতে না পারে সেজন্য অনেকের কর্ণকুহরে গরম সিসা ঢেলে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়া হতো। যারা লিখতে পারত তাদের হাত কেটে দেয়া হতো। ফলে বিচার প্রার্থনা তো দূরের কথা- বিচারের আশা মানুষের মধ্য থেকে উধাও হয়ে যেত।
উল্লিখিত পরিস্থিতিতে মানুষ তার মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলত, জাতীয় উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যেত। দুর্ভিক্ষ, অনাহার এবং রাজ্যময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে চুরি-ডাকাতি রাহাজানি, ঠগবাজি হয়ে উঠত সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি। ফলে রাজভাণ্ডার শূন্য হয়ে পড়ত। রাজা করের জন্য জুলুম-অত্যাচার বাড়িয়ে দিত। এমতাবস্থায় মানুষ করের ভয়ে পালাত, কেউ বিদ্রোহ করত, কেউ মরতো এবং একসময় পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। নানান ঐতিহাসিক টানাপড়েনে নতুন রাষ্ট্র কিংবা নতুন রাজার অভিষেক হতো।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা