১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আশার মৃত্যু না হলে গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নেই

-


শেকসপিয়রের অমর এক নাটকে জেলেদের সংলাপ : Third Fisherman : Master, I marvel, how the fishes live in the sea.
First fisherman: Why, as men do a-Land, The great ones eat up the little ones.
সংলাপের সবটুকু এক করে বাংলা ভাষায় বর্ণনা করলে বলা যায়; ডাঙ্গায় যেমন বলবানরা দুর্বলকে গ্রাস করে পানিতেও বড় মাছেরা ছোট মাছদের খেয়ে ফেলে।
রাজা শশাঙ্কের শাসনের অবসানের পর পরবর্তী শতাব্দীকাল বাংলা অঞ্চলের জনগণ এমনই এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিল। সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, হতাশা এবং বিদেশী আক্রমণে বাংলা তখন পর্যুদস্ত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রমতে; দণ্ডধরের অভাবে তখন বলবান দুর্বলকে গ্রাস করছিল। এই অবস্থাকে বাংলার ইতিহাসে মাৎস্যন্যায়-এর যুগ বলে অভিহিত। তখন বাংলা মুলুকে কোনো শাসন ব্যবস্থা ছিল না। গায়ের জোরে খেয়াল খুশিমতো শাসন করাই ছিল রীতি।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য পরে বিশিষ্ট জনগণ ও অমাত্যগণের সহায়তায় এক সমর নেতার পুত্র গোপাল বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের মতে; এই চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য বাঙালি জাতি সেদিন যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেবল দেশের মঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সাধারণে মিলে এমন বৃহৎ কাজের উদাহরণ বাঙালির ইতিহাসে আগে আর দেখা যায়নি। গোপাল অরাজকতার অশুভ শক্তিকে দমন করতে সক্ষম হন। তার প্রতিষ্ঠিত শাসনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী দুই উত্তরাধিকারী পাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধি শিখরে পৌঁছে।
ধর্মপালের আমলে পাটলীপুত্র (বর্তমানের পাটনা) নগরের বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক রাজকবি লেখেন- এখন গঙ্গাবক্ষে অসংখ্য বিশাল রণতরীর সমাবেশ সেতুবন্ধ রামেশ^রের শৈল শ্রেণী বলিয়া মনে হইত। এখনকার অসংখ্য রণহস্তী দিনের শোভা ম্লান করে নিবিড় মেঘের শোভা সৃষ্টি করত। উত্তরাপথের বহু সামন্ত রাজা যে অগণিত অশ্ব উপঢৌকনস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন তাদের ক্ষুরোত্থিত ধূলিজালে এই স্থানের চতুর্দিক ধূসরিত হইয়া থাকিত এবং রাজা রাজেশ^র ধর্মপালের সেবার জন্য সব জম্বুদ্বীপ (ভারত বর্ষ) হইতে যেসব রাজাগণ এখানে উপস্থিত হইতেন তাহাদের অনন্ত পদাতিক সেনার পদভারে বসুন্ধরা অবনত হইয়া থাকিত।

বাংলায় মাৎস্যন্যায় যুগের অবসানের ১১০০ বছরেরও পরে বাঙালি জাতি সর্ব প্রকার নির্যাতন ও শৃঙ্খলাবন্ধন চূড়ান্তভাবে ছিন্ন করে চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার এক গৌরবদীপ্ত কাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি করেছে তাদের মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই প্রিয় মাতৃভূমিতে গণতন্ত্রের যখন নবযাত্রা শুরু হলো তখন প্রথমেই সরকারপদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের জাতীয় কর্তব্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। প্রথমে সংসদীয় পদ্ধতি, পরে রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা, তারপর একদল, তার পরে বহুদল, এরপরে আবার সংসদীয় পদ্ধতি। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির জন্য আন্দোলন, পরে আবার তা বাতিলকরণ- এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে একটি জাতি পার করে দিলো তার ৫৩টি বছর। এখন পর্যন্ত সরকারপদ্ধতির গোলকধাঁধার মধ্যে আমরা আবর্তিত হচ্ছি।

অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্র নামের এক শূন্যগর্ভ মতাদর্শ চালু করতে গিয়ে লাভের ভিতর লাভ হলো একটি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা। এসব দেখে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিছুটা আশাহত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক মরহুম আব্দুর রাজ্জাক বলতেন; ইতিহাস শেখ সাহেবরে একজন statesman হইবার সুযোগ দিছিল- তিনি সেইডারে কাজে লাগাইবার পারলেন না। তবে এতকিছুর পরেও পরবশ্যতার বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিক শেখ মুজিবই স্বাধীনতার পর এমন কিছু কাজ করে গেলেন যার ফলে উপমহাদেশের একপ্রান্তে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তার উজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আজো টিকে আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ও সুশাসন সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন। গণতন্ত্র ও মানুষ সম্পর্কে তারা ছিলেন আশাবাদী। তারা বলতেন; মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কী? প্রধান পার্থক্য হলো এই যে মানুষের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা রয়েছে; পশুর ক্ষেত্রে ব্যক্তি নয় তাদের দলবদ্ধ অস্তিত্বই প্রধান। তাই গণতন্ত্রে মানুষের ব্যক্তিত্বের পবিত্রতাকে সম্মান করা হয়। গণতন্ত্রে প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি সমাজের যে অবস্থানে রয়েছেন সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবেন। তাই বলা হয়, ব্যক্তির মর্যাদাবোধ হচ্ছে গণতন্ত্রের মর্মকথা। ব্যক্তিমাত্রেরই যুক্তিবোধ আছে; তাকে নির্বোধ মনে না করাটাই গণতন্ত্র। আর নির্বোধ মনে করার অর্থই হলো সরকারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা। এ কারণেই হয়তো এ দেশের বিভিন্ন সময়ের শাসকেরা মনে করেছেন, বোকা জনগণ কিছুই বুঝবে না। তাদের সব কীর্তিকলাপ যে জনগণেরও বোধগম্য ছিল এটাও তারা বুঝতেন না।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গণতন্ত্র যে সবচেয়ে কষ্টসাধ্য শাসনব্যবস্থা তা-ই নয়- গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় জ্ঞানের। সংসদীয় গণতন্ত্রে তার প্রয়োজনীয়তা সমধিক। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একজন শাসকের তার জনগণ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তখনকার পরিস্থিতি এবং পারিপাশির্^কতা পর্যবেক্ষণ করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলতেন; যা আশা করেছিলাম তা হয়তো হবে না; তার প্রধান কারণ সরকারের ভিতর চিন্তার অস্পষ্টতা। তারা যখন বক্তব্য রাখছেন তখন তাদের সরকারি দল মনে হয় না- মনে হয় তারা যেন বিরোধী দলে আছেন।
ঠিক বর্তমান সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে কখনো রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি বিভাসিত হয়ে উঠলেও তার মন্ত্রিসভার দু’একজন সদস্য ও দখল লীগের দৌরাত্ম্যে তার সব গৌরব ও অর্জন ধুলায় মিশে গেল। একজন বিদেশী লেখকের ভাষায়, শেখ সাহেব নিহত হলেন, একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির জন্য নয়, একটি জাতি গঠনের জন্য নয়- তিনি নিহত হলেন তার পরামর্শদাতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঔদ্ধ্যতের কারণে। বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য যা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এ জাতির রাজনীতির বৈশিষ্ট্য সেটাই যেন আমাদের জন্য কাল হয়ে দেখা দিলো। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরা এর প্রতি স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে আসছেন।

তারা বলতেন, প্লেটো রাষ্ট্রীয় ঐক্য, জ্ঞান, বিশেষজ্ঞতার কথা বলে তার রিপাবলিকের মধ্যে চেঁচামেচি করছিলেন কেন?
তার যথার্থ উত্তর হলো, এই জিনিসগুলোর অভাবে তখনকার গ্রিসের রাজনীতি দূষিত হচ্ছিল। নগর ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। প্লেটো মনে করতেন তার আদর্শ কায়েম হোক বা না হোক তার কাছাকাছি কিছু একটা করার জন্য লোকে চেষ্টা করুক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জ্ঞান চর্চার অপ্রতুলতা ও রাজনীতিকদের মধ্যে এ বিষয়ে উদাসীনতা এসব দেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ছিলেন বেশ চিন্তিত। তারা মনে করতেন, আন্দোলনের নেতা হওয়া এক কথা আর শক্ত হাতে সর্বপ্রকার মোহমুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনা করা আর এক কথা। এদের মতের সাথে একজন বিদেশী লেখক একমত হয়ে বলেছেন; বাংলাদেশের যুবসমাজ অধ্যয়ন ও আত্মোপলব্ধি ছাড়াই জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে এবং তারা জানে না কেন তাদের লড়াই, কার বিরুদ্ধে লড়াই এবং কেন?
দুনিয়াব্যাপী একটা কথা প্রচলিত আছে যে ক্ষমতা মানুষকে দূষিত করে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা মানুষকে নীতিহীনতায় পর্যবসিত করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ কথা বিশ^াস করতেন না। তাদের প্রশ্ন ছিল কাদের দূষিত করে? প্রথমত যারা ক্ষমতায় আছে তাদের দূষিত করে। কিন্তু যাদের চরিত্র প্রকৃতই মহৎ ও মহান ক্ষমতা তাদের দূষিত করতে পারে না। তারা বলতেন, ক্ষমতার অপব্যবহার নির্ভর করে শাসকের স্বভাব, প্রবৃত্তি ও উদ্দেশ্যের ওপর। আজ পর্যন্ত মানবসভ্যতা যে টিকে আছে তা সৎ-প্রবৃত্তির কারণেই। এখানে নৈরাশ্যবাদী হওয়ার অর্থ জীবনকে অস্বীকার করা।
মহানবী মুহাম্মদ সা: যিশুখ্রিষ্ট, গৌতমবুদ্ধ বা সেন্ট পলসহ অনেকে অপরিসীম ক্ষমতার মালিক হয়েও পৃথিবীর অগণিত মানুষকে পরাধীনতা, কুসংস্কার, রোগ, শোক জরা থেকে মুক্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলতেন; বিজ্ঞানের যুগে মানুষ অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে বটে, তবে সব আবিষ্কারের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর আবিষ্কার। রাষ্ট্রের মাধ্যমে সরকারের স্বরূপ প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা তাদের আচরণে প্রতিফলিত হয়। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাস্টিস বা ন্যায়পরায়ণতা। শত বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, বিভ্রাট ও বিরোধের মধ্যে মানুষের এক অদম্য আকাক্সক্ষা থাকে তার সব কর্মকাণ্ড অন্যরা ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচনা করুক। চরম পাপিষ্ঠ ও নিকৃষ্টতম দুর্বৃত্তও ন্যায়নীতির পর্দার অন্তরালে নিজেকে ঢেকে রাখতে চায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষের চরিত্রের সংগ্রামের রূপ বা ধরন যাই হোক না কেন পার্থিব বস্তু আবিষ্কার, আত্মরক্ষা, আইন প্রণয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বিবাদ সর্বত্রই মানুষ ন্যায়সঙ্গত হওয়ার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষের সব কর্মকাণ্ড সবসময়ে সঠিক হয় না। ফলে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির ভীতি তাকে করে তোলে সন্ত্রস্ত। সবসময়েই গুপ্ত অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হতে হয় তাকে। এমন পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় ঈর্ষা-বিদ্বেষ, হিংসা এবং উন্নাসিকতা। সেই সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিভিন্ন গুজব, সন্দেহ। সমাজের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের অবিশ্বাস আতঙ্ক, ভয় ও অনিশ্চয়তা। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ন্যায়পরায়ণতা ছাড়া ক্ষমতা নৃশংস এবং ক্ষমতা ছাড়া ন্যায়পরায়ণতা নিরর্থক।
তারা বলতেন, দেশ ও জাতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হতে সহায়তা করাই রাষ্ট্রের আসল কাজ। তাই ন্যায়পরায়ণতাকে অবলম্বন করে ইসলামের বিজয়ডঙ্কা পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। আমাদের ইতিহাসে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতাকে অবলম্বন করে একজন সাধারণ মেজরও হয়ে উঠেছিলেন মহান পুরুষ। সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে ন্যায়পরায়ণতা প্রাধান্য পেলে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের দ্বার হয় উন্মুক্ত। এদেশেই দেখা গেছে এর ফলে সৃজনশীল জনতা এগিয়ে এসে প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাসে অবস্থান নেয় সৎ শাসকের পাশে। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান বলতেন: জনতার পরম আকাক্সিক্ষত সততা, কর্তব্যপরায়ণতা ও ন্যায়পরায়ণতার পথ থেকে যদি কোনো শাসক সরে আসে তাকে শাসক হিসেবে মেনে না নেয়ার অধিকার জনগণের জন্য সৃষ্টি হয়ে যায়।

তৃতীয় বিশে^র রাজনীতির ট্র্যাজেডি হলো, ব্যক্তি স্বার্থে ও উদ্দেশ্য এখানে গণতন্ত্র ও জনগণের নামে একটা ধুয়া তোলা হয় যার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকে না। কতিপয়ের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে যে অর্থহীন করে দিতে পারে বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পিছনে আকাক্সক্ষা থাকে আকাশছোঁয়া কিন্তু তার পরিসমাপ্তি ঘটে আশা ভঙ্গের বেদনায়। একজন বিদেশী লেখকের মতে, মানবতার এই অসহায়ত্বের মুহূর্তে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের করুণ দশা দেখে বাংলাদেশের কোনো ধর্মপ্রাণ কৃষক এমন অবস্থায় আমাদের নেতা-নেত্রীদেরকে নিশ্চয় বলতে পারে, আমরা আর আপনাদের গণতন্ত্রের ভেলকিবাজির খেলার শিকার হতে চাই না। আমরা মানুষ হিসেবে জন্মেছি- আমাদের মানুষ হিসেবে মরতে দিন। বেদনায় জর্জরিত নিরপরাধ মানুষগুলোর এমন প্রশ্নের উত্তর আমাদের নেতা-নেত্রীদের জানা নেই। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে দক্ষ কিন্তু সমষ্টির স্বার্থ বিসর্জনে পারঙ্গম এমন ব্যক্তিদের হাতে রুদ্ধ হয়ে আছে এদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
আজ বাংলাদেশ আছে- মুজিব নেই, রাজপথ আছে ভাসানী নেই, আইন আছে- বিচার নেই, ভোট আছে- ভোটার নেই, মেধা ও সঙ্কল্পে মরিয়া হয়ে ওঠারও কোনো লক্ষণ নেই। এসব দেখে জনগণের অবসাদ এমন স্থানে এসে পৌঁছে যে ঘৃণা প্রকাশের শক্তিটুকুও নেই। তাই গণতন্ত্রের অবিমিশ্র গুণাবলির সন্ধানে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠারও সীমা নেই। কিন্তু একটা জাতি বিক্ষোভ, অস্থিরতা আর আন্দোলনের জন্য সবসময় ব্যয় করতে পারে না। তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন, সজ্ঞাত সচেতন, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের আজ বড় প্রয়োজন। বিশ^াস ব্যতীত কোনো কিছুই অর্জিত হতে পারে না এবং আশা হচ্ছে বিশ্বাসের উৎস। ইতিহাস পরিক্রমায় হতাশার শীতের পরে এসেছে আশার বসন্ত। আশাও নিরাশায় ডুবছে। তবুও গণতন্ত্রের তরীকে আশার বুকে নোঙর বেঁধেই তার জীবনের সর্বশেষ এই ঝঞ্ঝা অতিক্রম করতে হবে। যেমনভাবে সে অতীতে করে এসেছে।
পরিশেষে বলতে হবে, বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। জনগণের আশার যদি মৃত্যু না হয়ে থাকে তাহলে গণতন্ত্রেরও মৃত্যু নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement