রাজনীতির ভাষা
- জয়নুল আবেদীন
- ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
২০১৯ সালের ৪ জুলাই এ কলামে ‘আইনজীবীর ভাষা’ শিরোনামে লিখেছিলাম। তাতে বলেছিলাম, আইনজীবীদের অনেকে নিজের ব্যবসায় বাড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে সহজ ভাষা কঠিন করে তোলেন, যা করেন অনেক ধর্মীয় নেতাও। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলাম, একসময় ভারতবর্ষের বর্ণদ্বিজরাই বর্ণবৈষম্য ঠিক রাখতে ভাষাবৈষম্যের প্রচলন করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষাভাষী কোনো জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে না থাকলেও তাদের ধর্মচর্চার ভাষা সংস্কৃত। সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের মতোই ধর্মসম্পর্কিত আনুষ্ঠানিকতানির্ভর জীবিকা বেছে নেয়া কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে কঠিন ভাষার আবরণে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেদের এবং ধর্মকে আড়াল করে রাখেন। একই মানসিকতা কাজ করে আদালতপাড়ায়ও। কিছু আইনজীবী অহেতুক বেশি ইংরেজির ব্যবহার করেন মক্কেলের কাছে নিজেকে দুর্গম এবং আইনের ভাষা দুর্বোধ্য করার প্রয়াসে।
উল্লিখিত শ্রেণীর আইনজীবী ও ধর্মীয় নেতাদের মতো রাজনীতিকদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। হাজার চেষ্টা করেও রাজনীতির ভাষা রপ্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যে কারণে বারবার ধিকৃত হওয়ার পর নিজেকে স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছি।
আমাদের কুমিল্লাকে বলা চলে রাজনীতিবিদের জন্য রতœগর্ভা। যখনই যে দল ক্ষমতায় আসে তখনই দেখি মন্ত্রী-মিনিস্টারের সংখ্যা কুমিল্লায় বেশি। বিএনপির আমলে মেঘনা এলাকাটি ছিল দুই রাজনৈতিক দিকপালের অধীনে। একসময় মনে করতাম মন্ত্রী-মিনিস্টাররা সাধারণ মানুষ নন। এম কে আনোয়ার সে ভুলটি ভেঙে দিয়েছিলেন। এম কে আনোয়ার যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তার অফিসে মাঝে মধ্যে যেতাম। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে গুছিয়ে-বুঝিয়ে কথা বলতে পারি বলে পরিচিতি বাড়তে থাকে। এম কে আনোয়ার যেখানে বসতেন সেখানে তার সামনে দু’টি খালি চেয়ার দেখতাম। পাশের রুমে থাকতেন দর্শনার্থী। যখন যার কথা বলবেন তখন তাকে ডেকে সামনের চেয়ারে বসতে দিতেন। কেউ তেল দিতে গেলে বিরক্ত হতেন। পাল্টা প্রশ্ন করে ঘাম বের করে ছাড়তেন তৈলদাতার। নানা কারণে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। যে সময় ঘনিষ্ঠতা হয় সে সময় থানা কমিটির কোনো এক সভাপতির সাথে মন্ত্রীর মতবিরোধ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, তখন কুমিল্লা উত্তর জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। এম কে আনোয়ারের কাছের ও বিশ্বস্ত লোক ছিলেন তিনি। তার পরামর্শে আমরা বিএনপির নেতারা সভাপতির বাসায় যাই।
মতবিরোধ দূর করতে সভাপতিকে মন্ত্রীর বাসায় আসার অনেক অনুরোধ করি। সভাপতি কিছুতেই মন্ত্রীর বাসায় আসবেন না। তার একরোখা ভাব দেখে বলেছিলাম, একজন উপজেলা সভাপতি আর একজন মন্ত্রীর ওজনের তুলনা ‘একটা নদী’ আর ‘এক ঘটি পানি’র মতো। পানির প্রয়োজন হলে নদী ঘটির কাছে যায় না, ঘটি নিয়ে নদীর কাছে যেতে হয়। শুধু তাই নয়, আপনি যদি পূর্ণিমার চাঁদ হন, মন্ত্রী সূর্য। আমরা আপনাকে সম্মানের সাথে কাঁখে করে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে এসেছি। তিনি আপনার অপেক্ষায় আছেন। এরপর তিনি আমাদের সাথে যেতে সম্মত হন।
পাশাপাশি দুই মন্ত্রী দু’জনই দলের অন্যতম নেতা। পদ্মা মেঘনার মতো দুই নদী দুই বর্ণের পানি ধারণ করে সাগরের দিকে গড়াতেন। দৃশ্যত একজন অন্যজনের ছায়াও মাড়াতেন না। মনে পড়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একসাথে আমার চারটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব ছিল। উভয় মন্ত্রী দাওয়াত নিয়েছিলেন। উপস্থিত থাকবেন বলে সম্মতিও দিয়েছিলেন। একজন উপস্থিত হওয়ার পর শত চেষ্টা করেও অন্যজনকে উপস্থিত করতে পারলাম না।
বিএনপির যে ক’জন মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের কোপানলে পড়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম এম কে আনোয়ার। তিনি সচিবদের মধ্যেও ছিলেন সিনিয়র সচিব। অন্য মন্ত্রী-এমপিরা মুণ্ডপাত করে যা আদায় করতে না পারতেন এম কে আনোয়ার একটা ফোন কলে তা আদায় করতে পারতেন। এই মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৫ সালের আগস্টে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমা হামলার আসামি করা হয় তাকে। উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে জামিনে উল্লিখিত শর্ত মোতাবেক নিম্ন আদালতে হাজির হলে নিম্ন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে হাজতে পাঠান। ছয় মাস কারাভোগের পর অসুস্থতার কারণে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান। কারাগার থেকে ছাড়া পেলেও গোটা বিশেক মামলায় আদালতে হাজিরাসহ চিকিৎসার জন্য টানাহেঁচড়ায় একেবারে নেতিয়ে পড়েন বিছানায়। ইহজাগতিক পাট চুকিয়ে ২০ অক্টোবর ২০১৭ রাতে শেষ খেয়া পার হয়ে গেলেন তিনি। প্রাতঃভ্রমণের সময় লোকমুখে জানতে পারি, এম কে আনোয়ার আর নেই। পথে-ঘাটে মানুষ বলাবলি করছে, ‘দেশ ও জাতি একজন অবিচল ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হারালো। সকালে বিটিভি খুলে দেখি নাটক চলছে। স্ক্রলের নিউজে চোখ রাখি। সেখানে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙার খবরও আছে, কিন্তু ১৯৫৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় চার দশক যিনি ছিলেন সরকারের উচ্চপদে আসীন, ১৯৯০ সাল থেকে দু’বার মন্ত্রিত্ব ছাড়াও পাঁচবার জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন, সেই এম কে আনোয়ারের মৃত্যুর খবর স্ক্রলেও প্রচার করেনি বিটিভি।
আমার জানা মতে, বিশ্বের কোনো আইনে মৃত ব্যক্তিকে বিচারে পক্ষ করা হয় না। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে প্রচলিত আইন হলো, দেহ থেকে প্রাণ বের হওয়ার সাথে সাথে জাগতিক সব বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে যান। তাই ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে নামিয়ে লাশ পাঠিয়ে দেয় কারাগারের বাইরে। জীবদ্দশায় নিযুক্ত আইনজীবী ওকালতনামাসহ মামলার যাবতীয় কাগজপত্র থেকে অপসারণ করে নেয় মৃত ব্যক্তির নাম পরিচয়। আসামি মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে বিচারকও মামলা থেকে কেটে দেন আসামির নাম।
এম কে আনোয়ার পরলোকগমনের পর, ‘বোবার শত্রু নেই’ শিরোনামে সচিত্র উপসম্পাদকীয়টি দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ২৯ অক্টোবর ২০১৭ প্রকাশিত হয়েছিল। চিত্রে ছিল দু’জন পুলিশের কাঁধে ভর করে আদালতে হাজির হওয়ার দৃশ্যটিও। তার মৃত্যুর খবর শোনার পরপর ছুটে গিয়েছিলাম। তার বাসার পাশের মসজিদে জানাজা হয়েছিল। সম্ভবত প্রথম জানাজা।
এম কে আনোয়ারের পরলোকগমনের পর রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাই। আমাদের এলাকায় এম কে আনোয়ারের স্থলাভিষিক্ত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এম কে আনোয়ার হাড়ে-মজ্জায় রাজনীতিবিদ না হলেও খন্দকার মোশাররফ হোসেন পুরোপুরি রাজনীতিবিদ। রাজনীতির বাইরে তিনি একজন ভালো লেখকও। নিজে লেখক হলেও তার জীবনী লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে। যা ড. মোশাররফ ফাউন্ডেশনের ১ মার্চ ২০১৩ সালের স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়। তিনিও আনোয়ারের মতো তার পাশে বসার সুযোগ দিতেন। কোনো সভা-সমাবেশে আমার বক্তব্য রাখতেন সবার পরে। যে বছর দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার (চেয়ারম্যান) নির্বাচনের নিয়ম চালু হয় সে বছর (সম্ভবত ২০১৬ সালে) খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার অফিসে স্থানীয় নেতাদের ডেকেছিলেন। সবার শেষে ছিল আমার বক্তব্য দেয়ার পালা। আমি দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর, ‘¯্রােতের বিপরীতে সাঁতার কাটার জন্য যতটুকু শক্তি দরকার এই মুহূর্তে ততটুকু শক্তি আমাদের...’ বাক্যটি সমাপ্ত করার আগেই হইচই শুরু হয়ে গেল। কারণ, আমার বক্তব্য ছিল প্রথাবিরোধী। অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী স্তুতি প্রশংসাসহ দলীয় নেতার গুণকীর্তন করতে হবে। আমি তা না করে দলের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়ি। নিজের অযোগ্যতা টের পেয়ে সেদিন থেকে রাজনীতি ছেড়ে দিই।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ছিল কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনের আগের দিন জানতে পারি উপদেষ্টা পরিষদে এখনো আমার নাম আছে। শুধু নাম থাকা নয় নতুন কমিটি নির্বাচনে আমি একজন ভোটারও। ভোট দিতে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে। সম্মেলনে প্রধান অতিথি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। বেলা ১টায় সম্মেলনে যাই। আমি যাওয়ার আগে রিজভী বক্তব্য শেষ করে চলে গেছেন। যারা আছেন তাদের বেশির ভাগের বক্তব্যে দলের স্তুতি আর নেতার গুণকীর্তন। যার গুণকীর্তন করছিলেন তার সাথে আমার পরিচয় কয়েক ঘণ্টার। তার বিষয়ে কিছু বলতে আমাকে সুযোগ দিলে কী বলব আমি! মনে পড়ে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ছিল মেঘনা ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কলামিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলাম আমিও। আজকের মতো সবাই নেতার গুণকীর্তন করছিল। আমাকে কিছু বলার অনুরোধ করায় দাঁড়িয়ে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের প্যাট্রিয়ট কবিতার কয়টি লাইনসহ সারমর্ম তুলে ধরেছিলাম। সেদিনও আমার কথা নেতার মনঃপূত হয়নি। তাই সভা শেষ হওয়ার আগে সভাস্থল ত্যাগ করি। আজকের সভায়ও দেখছি একই অবস্থা। আজও কিছু বলতে গেলে একই অবস্থা হতে পারে। সীমার বাইরে গিয়ে দলের স্তুতিবন্দনাসহ গুণকীর্তন কোনোটা কাম্য নয়। এ সব রাজনীতির ভাষা। সীমাহীন স্তুতিবন্দনায় একজন মানুষ নিজের প্রকৃত অবস্থা ভুলে যান। কেউ নিজেকে প্রভু মনে করতে থাকেন। আর তখনই তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। নেতাকে খুশি করতে যে যাই বলুন, তাকে সর্বদা মনে রাখতে হবে সবই রাজনীতির ভাষা।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা