নাম বিকৃতির মনস্তত্ত্ব
- আমীর হামযা
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, নামে কিবা আসে যায়। কিন্তু না, আমরা এ কথার সাথে একমত পোষণ করতে পারছি না বলে সত্যিই দুঃখিত। এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, নামে অবশ্যই কিছু আসে যায়। যেকোনো মানব শিশুর জন্মের পরপরই বাবা-মায়ের দায়িত্ব সন্তানের সুন্দর একটি নাম রাখা। যে নামের তাৎপর্য থাকা চাই-ই চাই। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ইসলামী বিধান মতে, সন্তানের সুন্দর অর্থপূর্ণ নাম রাখা বাবা-মায়ের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। শরিয়াহ অনুযায়ী, পিতা-মাতা বা স্বজনের কাছে মানব শিশুর সর্বপ্রথম হক একটি সুন্দর নাম পাওয়া। আর ইসলামে যে কারো হক বা অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বান্দার প্রতি আল্লাহর যে হক, তা সুচারুভাবে পালন করা হলো প্রথম অগ্রাধিকার। এখানে কোনো আলস্য বা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
আরবি হক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ অধিকার। যেহেতু মানুষের হক আদায়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানে একটি সুন্দর নাম থেকে সন্তানকে মাহরুম করা তার প্রতি সাংস্কৃতিক অবিচার বৈকি। প্রকৃত বাস্তবতায় এটি রীতিমতো জুলুম। অসুন্দর নাম রাখার অর্থ দাঁড়ায় মা-বাবার কাছ থেকে সন্তান জন্মের পরপরই জুলুমের শিকার হওয়া। যে সন্তানের অসুন্দর নাম রাখা হলো সে দুনিয়ায় মা-বাবার কাছে প্রথমেই জুলুমের শিকার হয়ে মজলুম হলো। অর্থহীন নাম রাখলে কেন আমরা একে অবিচার বলছি- এ প্রশ্ন পাঠকের মনে জাগা স্বাভাবিক। এর কার্যকারণই বা কী তা-ও জানার অধিকার পাঠকের রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে প্রথমে আমাদের জানা দরকার নাম আসলে কী? এর তাৎপর্যই বা কী?
যেকোনো বস্তু বা ব্যক্তির নাম হলো এর পরিচয় বা চিহ্ন। যাতে করে আমরা ওই বস্তুকে শনাক্ত করতে পারি। নাম বললে আমরা বুঝে নিই বস্তুর গুণাগুণ সম্পর্কে। তাই নামের আরেক অর্থ বস্তুর আত্মপরিচয়। আর আত্মপরিচয় জানার অর্থ বস্তুটি দুনিয়ার জিন্দেগিতে কী কী কাজে লাগবে। এ প্রসঙ্গে ঐশী বাণী উদ্ধৃত করা যেতে পারে। পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে : ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি বস্তুজগতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ তখন তারা বলল, ‘আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও খুনখারাবি করবে? আমরা তো আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় নিমগ্ন।’ আল্লাহ জবাবে বললেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’ আর তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন (অর্থাৎ সব বিষয়ের জ্ঞান দান করলেন)। এরপর এক এক করে সব কিছু ফেরেশতাদের সামনে হাজির করে বললেন, ‘তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ তারা বলল, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমরা কিছুই জানি না। আপনি প্রজ্ঞাময়। মহাজ্ঞানী।’ (সূরা বাকারা : ৩০-৩২) পবিত্র কুরআনের আলোকে এটি স্পষ্ট, নামই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান বা বস্তুর স্বরূপ।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এ লেখার প্রারম্ভে বলার চেষ্টা করেছি, একটি তাৎপর্যপূর্ণ নাম জন্মের পরপর আদম সন্তানের জন্মগত অধিকার। এ হক খর্ব করার অধিকার বাবা-মা অর্থাৎ পরিবার পরিজনের কারো নেই। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশে অনেকে বাবা-মায়ের দেয়া অর্থহীন নামের বোঝা বহন করে বেড়াচ্ছে এবং সাংস্কৃতিকভাবে হচ্ছে জুলুমের শিকার। যেমন- আরবি শব্দের অর্থ না জেনে সন্তানের নাম রাখা হচ্ছে সাকলাইন। যার বাংলা মানে হলো ভার বা বোঝা। না জানার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানের এমন নাম হরহামেশাই রাখছেন। তাই তো আমাদের চেনাজানা চারপাশে দেখা যায়, অনেকের নামের কোনো অর্থ নেই। তাৎপর্যহীন। এমন নামের বোঝা সারা জীবন তাদের বয়ে বেড়াতে হয়।
নামের ব্যাপারে এটি তো গেল এক দিক। অন্য যে দিকটি লক্ষণীয় তা হলো, সুন্দর নাম বাবা-মা আত্মীয়স্বজন রাখলেও অনেকে নাম বিকৃতির শিকার হন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমানেও ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম বিকৃত করে ভুলভাল লেখা বা উচ্চারণে ডাকা হয়। এর মধ্যে একটি হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কুৎসিত অভিসন্ধি বা খায়েস রয়েছে।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের প্রান্তিক বা হেয় প্রতিপন্ন করতে ঊনবিংশ শতকে বাঙালি হিন্দু কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনের নাম সচেতনভাবে বিকৃত করতেন। তাদের রচিত সাহিত্যে সৃষ্ট মুসলিম চরিত্রের নামও বিকৃত করে উপস্থাপন করা হতো। এ অপকর্ম চাতুর্যের সাথে প্রয়োগ করেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যয়। তিনি তার লেখনির মাধ্যমে নাম বিকৃতির এই অপসংস্কৃতির প্রচলন সুচতুরভাবে সম্পাদন করেছেন; সাহিত্যের ভাষায় বললে, আমরা একে বলতে পারি, তিনি এই সুকর্ম (পড়তে হবে কুকর্ম) মুন্সিয়ানার সাথে করেছেন। অবশ্য আমাদের এটিও মনে রাখা দরকার, পূর্ববাংলার হিন্দু জমিদাররা তাদের জমিদারিতে মুসলিম প্রজাদের সন্তানের অর্থহীন নাম রাখতেন। যেমন- হাবু, পোকা, বকা ইত্যাদি। সামাজিকভাবে হীনম্মন্য করে রাখার অপকর্ম ছিল এটি।
প্রশ্ন হলো, ব্রিটিশ ভারত থেকে হাল আমলেও ভারতে কেন মুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম বিকৃত করার প্রবণতা কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। এই কুকর্মের মনস্তত্ত্ব আর কিছু নয়, ভারতে মুসলিম সম্প্র্রদায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করার রাজনৈতিক অপচেষ্টা মাত্র। ভারতীয় সমাজে-রাষ্ট্রে মুসলমানদের উপস্থিতি ‘নাই’ করে দেয়া। অর্থাৎ, ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা। এর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় বর্তমান শাসকদের মুসলিম সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুগত রাখার একটি হাতিয়ারে পরিণত করা।
এ কথা বলা অন্যায্য হবে না, নাম বিকৃতির সরল মানে, যার নাম বিকৃতি করা হচ্ছে, তাকে সামাজিকভাবে মূলধারা থেকে বাদ দেয়ার অপপ্রয়াস। এটি বিকৃত মানসিকতা। অবাক করা বিষয় হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে এই সময়ে এসেও সেকুলারপন্থী কিছু রাজনীতিবিদ ইসলামপন্থী জনপ্রিয় নেতা ও ওয়াইয়েজিনের নাম বিকৃত করে তার বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এটি যেমন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় দেখা গেছে, ঠিক ফ্যাসিবাদ-উত্তর সময়ে এখনো নাম বিকৃতির সংস্কৃতি একইভাবে হাজির বা উপস্থিত রয়েছে। কখনো এর তীব্রতা উৎকটভাবে জনপরিসরে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
ঔপনিবেসিক ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সাহিত্যিকদের হাত ধরে মুসলমানদের নাম বিকৃতির যে অপতৎপরতা ও অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা আজকের বাংলাদেশে হাজির থাকা সত্যিই আমাদের জন্য এক জাতীয় সংস্কৃতির দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা নিজেদের সাচ্চা মুসলমান দাবি করে থাকি। অথচ পবিত্র কুরআনের বাণী প্রতিপালন না করে কী অবলীলায় তা অগ্রাহ্য করছি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাস আনার পর তোমরা একে অপরের নাম বিকৃত করো না’। (সূরা হুজুরাত-১১) যেখানে আল্লার এই অমোঘ বাণী প্রতিপালন করাই ছিল মুসলিম হিসেবে আমাদের অবশ্য করণীয়, সেখানে আমরা আজো নাম বিকৃতির মতো জঘন্য অপকর্ম অবলীলায় করে বেড়াচ্ছি। তা-ও আবার রাজনৈতিক জনসভায় উচ্চকণ্ঠে গলা চড়িয়ে। পরিণামে সমাজে-রাষ্ট্রে বাড়ছে একে-অপরের প্রতি অসম্মানবোধ, হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানি। দেখেশুনে মনে হয়, আত্মবিস্মৃত জাতি আর কাকে বলে!
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা