০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ৮ শাবান ১৪৪৬
`

ধর্ম ও রাজনীতি : পরিপ্রেক্ষিত বিএনপি

-


সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের নাম উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ধর্মের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি মৌলবাদের উত্থানের প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার মন্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি আল কুরআন, ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে সীমিত অধ্যয়ন করেছেন। তার মন্তব্যে উগ্র সেক্যুলারদের পরিভাষারই প্রতিফলন ঘটেছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেখানে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ‘আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ^াস’ সংযুক্ত করেছিলেন, সেখানে তার দলের বর্তমান মহাসচিব মূলত নিজ দলের রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধেই কথা বলছেন। যাই হোক, অন্যান্য ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব না। আজ শুধু ইসলামের সাথে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব।

যে পরিবেশে ইউরোপের জনগণ চার্চের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র থেকে তাকে আলাদা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল মুসলিম বিশ্বে তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব কখনো ঘটেনি। বিজ্ঞানের কোনো তথ্য ও তত্ত্বের সাথে ইসলামের কখনো সঙ্ঘাত দেখা দেয়নি। (মরিস বুকাইলি) ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতাও দেখা দেয়নি। মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামের কোনো নীতি বা অনুশাসন তাদের জন্য শোষণ, নিপীড়ন ও বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে দেখা দেয়নি। কোনো কোনো শাসকের বা শাসকগোষ্ঠীর উচ্চাভিলাষ, কৌশল বা সিদ্ধান্ত নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলেও ধর্ম হিসেবে ইসলামের বা ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি কোনো ক্ষোভবিদ্বেষ জনমনে সৃষ্টি হয়নি। আজ পর্যন্ত ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কখনো যুদ্ধ বাধেনি; অথবা কোনো মুসলিম শাসক বা ধর্মীয় নেতা কোনো বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মারেনি বা অত্যাচার করেনি।

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, মুসলিম এবং চীন একই সময়ে প্রাচ্যে যখন শুধু সামরিক দিক থেকেই প্রাধান্য নয়- বিজ্ঞান, দর্শন, কাব্য, কলা প্রভৃতির ক্ষেত্রে চরম বিকাশ লাভ করেছিল; ঠিক তখন ইউরোপ বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল। ইউরোপীয়রা এ যুগকে ‘অন্ধকারময় যুগ’ বলে অভিহিত করত। কিন্তু এটা শুধু খ্রিষ্টানপ্রধান ইউরোপীয় অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কারণ, এ সময়ে আরব বিশ্ব ও স্পেনে মুসলিম সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।

ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নাম নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রব্যবস্থারও প্রতীক। ইসলাম ধর্মীয়-রাজনৈতিক Religio-political আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল এবং তাতে ধর্ম ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান ও রাজনীতির উৎস হচ্ছে ঐশীগ্রন্থ আল কুরআন এবং মহানবী সা:-এর সুন্নাহ। আল্লামা ইকবালের মতে, ধর্ম ও রাষ্ট্র দেহ ও আত্মার সমতুল্য- এদের পারস্পরিক নিবিড় সংযোগ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য, আর এদের পারস্পারিক বিরোধের নিশ্চিত পরিণতি ধ্বংস। তিনি বলেন, Islam, as a polity, is only a practical means of making this principle (Tawhid), a living factor in the intellectual and emotional life of mankind. It demands loyalty to God and not to thrones. And since God is the ultimate spiritual basis of all life, loyalty to God actually amounts to man's loyalty to his own ideal nature.

অর্থাৎ ‘এই নীতিকে (আল্লাহর একত্ব বা তাওহিদ) মানুষের চিন্তা ও ভাবজগতে জীবন্ত রূপ দেয়াই কার্যত ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কাজ। ইসলাম দাবি করে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য; কোনো সিংহাসনের প্রতি আনুগত্য নয়। আর যেহেতু আল্লাহই সমগ্র জীবজগতের আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির মূল ভিত্তি, তাই আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বস্তুত মানুষের আপন আদর্শ প্রকৃতির প্রতি আনুগত্যের নামান্তর।’
ইবনে খালদুন সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি রাষ্ট্রকে ভাগ করেছেন দু’ভাগে- ধর্মীয় ও যুক্তিবাদী। তিনি ধর্মীয় রাষ্ট্রকে ‘খাঁটি রাষ্ট্র’ (Perfect State) বলে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, এরূপ রাষ্ট্র শুধু মানুষের পার্থিব চাহিদাই পূরণ করে না; আধ্যাত্মিক উন্নয়নেরও ব্যবস্থা করে। খালদুন মনে করেন, রাষ্ট্রমাত্রই ন্যায়বিচার করবে এটিই কাম্য। তবে ইসলামী আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই কেবল সঠিক রাষ্ট্র এবং এরূপ রাষ্ট্র যুক্তিবাদী রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি মাত্রায় ন্যায়বিচার করতে সক্ষম। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জিনস ব্রিজ ইসলামের প্রশংসা করে বলেছেন, জৈবিক ও আত্মিক জীবনে চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে ইসলাম এক বাস্তব জীবনদর্শন দান করেছে।
ইসলাম এমন একটি রাজনৈতিক শক্তির কথা বলে যেখানে কেবলমাত্র এক ও অবিভাজ্য সত্তার ইবাদতের কথা বলা হয় এবং তা ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কর্মকাণ্ড পর্যন্ত ব্যাপৃত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উইলফ্রেড সি. স্মিথ এ প্রসঙ্গে বলেন :

In fact, Islam is characterized among the religions by the particular emphasis which it has from the beginning given it the social order. The Prophet Muhammad not only preached ethics, he organized a state.....That state was organized in accordance with God`s revelation; it prospered and expanded and Islam as a process in human history was launched on its career. That career has continued until today.
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো সাদৃশ্য নেই। ইসলামে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। ইসলামী রাষ্ট্র একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র; তবে তা আধুনিক সংবিধানের মতো নয়, যার ব্যাখ্যা পার্লামেন্ট বা জনপ্রতিনিধিরা দিয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের মূলনীতি কুরআন ও সুন্নাহতে বিধৃত যার কোনো পরিবর্তন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক আইন প্রণয়নের মালিক মহান স্রষ্টা। আধুনিক রাষ্ট্রের পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠরা আইন পাস করে এবং তা নানাবিধ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে সরকার। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে জনগণ ধর্মীয় চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন মান্য করে। রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার জন্য মুসলিম পার্লামেন্ট বিশেষ কোনো আইন পাস করলে তা কুরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয় না।

ইসলামী রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি যা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয় এবং তাতে ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক জীবনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিচার্ড এন ফ্রাই বলেন, Islam is the totality of a culture in both its social and individual aspects, it is also a way of life. পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু এ উদ্দেশ্যে যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সূরা জারিয়াত-১৫) এর মাধ্যমে মানবজীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ড তথা স্রষ্টার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য পরিবেশ তথা সেরূপ রাষ্ট্র সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। রাষ্ট্র এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা আল্লাহর ইবাদতের পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামী আইন ও অনুশাসন কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন : ‘জনগণের যাবতীয় বিষয় নিষ্পন্ন করার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ধর্মের (দ্বীনের) সর্বপ্রধান কর্তব্য। বরং রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠাই হতে পারে না। আল্লাহ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং নিপীড়িতদের সাহায্য করা ওয়াজিব করেছেন। এভাবে তিনি জিহাদ, ইনসাফ ও আইনের শাসন প্রভৃতি যেসব কাজ ওয়াজিব করেছেন তা রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ব্যতীত কিছুতেই সম্পন্ন হতে পারে না।’ (সিয়াসাতে শরিয়াহ) পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘বস্তুত আমি পাঠিয়েছি আমার নবী-রাসূলগণকে এবং তাদের সাথে নাজিল করেছি কিতাব ও মানদণ্ড যেন লোকেরা ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আরো নাজিল করেছি লৌহ। এর মধ্যে রয়েছে বিযুক্ত অনমনীয় শক্তি এবং জনগণের জন্য অশেষ কল্যাণ।’ (সূরা হাদিদ-১৫) এখানে লৌহ-কে তাফসিরকারগণ রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হজরত উসমান রা: বলেছেন : ‘যারা কুরআন থেকে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয় না আল্লাহ তাদেরকে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা হেদায়েত করেন।’

বস্তুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী শরিয়তের স্বাভাবিক দাবি ও প্রবণতা। ইতিহাস প্রমাণ করে, হজরত মুহাম্মদ সা: এমনি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মক্কা শরিফে থাকা অবস্থায়ই বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। মদিনার মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল (৭৩ জন পুরুষ ও নারী) মক্কা শরিফে গোপনে মহানবী সা:-এর এক সভায় মিলিত হয়ে এক সুস্পষ্ট চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন যা আকাবার দ্বিতীয় শপথ নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে তারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার রাসূল সা:-এর ওপর অর্পণ করে তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা রাসূল সা:-কে সাহায্য করা ও প্রতিরক্ষায় পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এটাই ছিল রাসূল সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বুনিয়াদ। আর রাসূল সা: ছিলেন এ রাষ্ট্রের নেতা। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি ইহুদিদের সাথে সন্ধি/চুক্তি করেন এবং তাতে ধর্ম ও ধন-সম্পদের ওপর তাদের অধিকার স্বীকার করে নেন।
আল্লাহ এক ও অবিভাজ্য সত্তা। একইভাবে জীবন ও মানব ব্যক্তিত্ব অবিভাজ্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পরস্পরসংযুক্ত। ধর্মীয় ও সেক্যুলার বা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বলে মুসলমানের জীবনে আলাদা কিছু থাকতে পারে না। এর পরিচয় পাওয়া যায় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনে, যিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধান। আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের এরূপ অপূর্ব সমন্বয় পাশ্চাত্য জগতে দেখা যায় না। পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে রাজনৈতিক জীবনকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে যে, বহুলোক মনে করে এরূপ সমন্বয় আদৌ সম্ভব নয়। পশ্চিমের খ্রিষ্টান জগতের ‘সিজারের কাজ সিজারকে দাও’ এবং ‘ঈশ্বরের কাজ ঈশ্বরকে’- ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথককারী এই ‘দুই তরবারি তত্ত্বের’ (Two-Sword Policy) সাথে ইসলামের তুলনা হতে পারে না।

অস্ট্রিয়ার নওমুসলিম বিশিষ্ট পণ্ডিত মুহাম্মদ আসাদ ইসলামী আইনের মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ গবেষণা করে মন্তব্য করেছিলেন, ইসলাম কেবল মানুষের সাথে আল্লাহর স¤পর্কের সীমারেখা টেনে দেয়নি; বরং ওই সম্পর্কের ফলে প্রয়োগযোগ্য সামাজিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাও প্রণয়ন করে দিয়েছে। এখন যেটা প্রয়োজন তা হলো মানবজীবনের সবক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত তথা আধ্যাত্মিক, ভৌত, ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা। এর মানে হচ্ছে প্রকৃত ইসলামী জীবনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র যা হচ্ছে একটি অপরিহার্য শর্ত।
ঐশী প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ধর্ম নিয়ে যিশুখ্রিষ্ট (ঈশা আ:) যখন মানবসমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন তিনি নিঃসন্দেহে তৎকালীন মানুষের জন্য মুক্তির বারতা নিয়ে এসেছিলেন। এ সত্যকে খ্রিষ্টানদের মতো মুসলমানরাও মান্য করে। এমনকি ধর্মবিরোধী কমিউনিস্ট পণ্ডিতরাও তা অস্বীকার করতে পারেননি। আদি খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন : ‘আদি খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাস বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনের সাথে অদ্ভুত সাদৃশ্য বহন করে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো খ্রিষ্টধর্ম প্রারম্ভে নিপীড়িতদের আন্দোলন হিসেবে দাস, দরিদ্র, জাতিচ্যুত এবং রোম সাম্রাজ্যের শোষণে নিষ্পেষিত জনগণের ধর্ম ও আদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।’ দেখা যাচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের মূল আবেদন ছিল জনগণের মুক্তির সপক্ষে। কিন্তু এই ধর্মই যখন শাসক ও যাজকদের শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয় তখন এর সম্পর্কে ইউরোপীয় জনগণের মূল্যায়ন হয় ভিন্ন। পাশ্চাত্যের একজন পণ্ডিত খ্রিষ্টধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলেন, Science has shown religion to be History`s cruelest and wickdest hoax.

ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন, রেনেসাঁর উদ্ভব এবং সেক্যুলারিজমের প্রচলনের ফলে খ্রিষ্টধর্ম মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এর ফলে ইউরোপীয়দের ঐক্যের বড় বন্ধন খ্রিষ্টধর্ম ঐক্যকে আর ধরে রাখতে পারেনি। উদ্ভব হলো বহু জাতি-রাষ্ট্রের (Nation-State) এবং এতে করে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রাধান্য লাভ করল। আজও ইউরোপ জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে আছে।
খ্রিষ্টধর্ম ইউরোপীয়দের ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হয়। রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় ও প্রোটেস্টান্টদের ধর্মীয় বিষয় রাষ্ট্র থেকে আলাদা হলেও ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক জাতিরাষ্ট্র গঠন করে তারা যুগ যুগ ধরে তা অব্যাহত রেখেছে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদার ঘোষণা দিলেও প্রোটেস্টান্ট ধর্ম কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আবার ক্যাথলিক ধর্মমতও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও ধর্ম একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে পাশ্চাত্যে আজও বিদ্যমান।
আশা করি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement