প্রদেশ ভাবনা : থিম ও স্পিরিট
- রিন্টু আনোয়ার
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে যা সব মহলে আলোচিত। একই সাথে কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে আলাদা বিভাগ করারও সুপারিশও এসেছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গ্রেটার ঢাকা ক্যাপিটাল সিটি বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ তো আছেই। শেষ পর্যন্ত কী হবে তা দেখার অপেক্ষা। কারণ সুপারিশ বা প্রস্তাব আদৌ সিদ্ধান্ত নয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। বাস্তবায়নের ভিত্তি দিয়ে যাবে অন্তর্র্বর্তী সরকার। বাস্তবায়ন নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। তাই অপেক্ষাটা কিছুটা দীর্ঘ হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে প্রশাসনে কিছু সংস্কার এবং বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব শুরু হয়েছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের হাতে। সেটার ফলোআপ হয়নি; বরং এরশাদ পতনের পর তা থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রশাসন সংস্কারের আবেদন ও তাগিদ থেকেই যায়। যে তাগিদ আবার এলো অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, উন্নয়নের ধারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ কমানো, দুর্নীতির লাগাম টানা, সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সর্বোপরি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করা। উন্নয়ন তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, ইউনিয়ন, জেলা-উপজেলা-সিটি করপোরেশনসহ গোটা স্থানীয় সরকারকে কর্মতৎপর রাখার কথা সব দলই বলে। কিন্তু গোলমাল বাধে কাজকর্মে।
মানুষের ঢল থামিয়ে তা সারা দেশে জেলা শহরে, উপজেলা সদরে এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে গেলে প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারে বিন্যাস দরকার, তা এখন সবারই উপলব্ধি। উন্নয়ন, প্রশাসন ও সরকারব্যবস্থার তৃণমূলে ইউনিয়ন পরিষদ। একসময় এই ইউনিয়ন পরিষদব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী ছিল। পরে যোগ হয়েছে উপজেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। যেখানে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি। সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতার এখতিয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে এবং রাজনৈতিক ভুল দৃষ্টিভঙ্গির সুযোগে উপজেলা পরিষদব্যবস্থা একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। কার্যত এই ব্যবস্থা কাগজে-কলমে বিদ্যমান থাকলেও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ অচল হয়ে পড়ে। এ নিয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। যুক্ত হয়েছিলাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন প্রস্তাবের কর্মকাণ্ডে। থানাকে উপজেলা, মহকুমাকে জেলা এবং দু’টি বিভাগ করা হয়েছিল তার সময়ে। অপ্রয়োজনীয় কিছু দফতর বিলুপ্তির পাশাপাশি তিনি গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য এলজিআরডি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ঢাকা শহরের যে আয়তন তাতে বিশ্বের অন্যান্য আদর্শ শহরের মতো করে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ লোক বাস করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা দুই কোটির বেশি। ঢাকার রাস্তা, পার্ক, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, শিক্ষা-চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি অকুলান।
জাতিসঙ্ঘের হিসাবে, কোনো স্বাস্থ্যকর শহরে প্রতি একর এলাকায় বাস করতে পারেন ৭০ থেকে ৮০ জন নাগরিক। সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ১২০ জন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় তা ৭০০ থেকে ৮০০ জনের বাস। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর জাপানের টোকিওতে মোট তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস করলেও সেখানে প্রতি একরে ৯০ জনের কম মানুষ বাস করে। সিঙ্গাপুরের মতো বহুতল ভবনসমৃদ্ধ শহরে তা ৮০ জন, সিডনিতে ৫৮ জন ও নিউ ইয়র্কে ১১২ জন।
বাংলাদেশের ভালো সব কিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। ভালো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, হাসপাতাল, নার্সিংহোম সব ঢাকায়। যারা একবার ঢাকায় আসেন তারা আর নিজ জেলায় ফিরতে চান না। তাদের দোষ নেই। ঢাকার বাইরে জীবিকা ও সুযোগ-সুবিধা থাকলে তারা নিশ্চয়ই ঢাকামুখী হতেন না। এসব দিক বিবেচনায় দেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করার সুপারিশ ছিল ওই প্রস্তাবে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের কমিশন মাত্র চারটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেছে। উভয় প্রস্তাবের থিম ও স্পিরিট একই।
সার্কের কয়েকটি দেশে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা আছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও একই শাসনব্যবস্থা বলবৎ। আমাদের দেশের একটি বিভাগের জনসংখ্যার চেয়েও কম জনসংখ্যার দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা রয়েছে, তাই বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি প্রবর্তনে বাধা থাকা উচিত নয়।
নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এখনই নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে। সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দ্রুত উন্নয়ন এবং নতুন শতকে অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশকেও সংস্কারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে এরশাদের প্রকল্পে একটি প্রাথমিক ধারণা বা কাঠামো উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার মান্যতা দেয়া হয়। দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন এবং উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এর জন্য সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের দেশে সংবিধান সংশোধন নতুন কিছু নয়। এ পর্যন্ত ১৬-১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে আবারো সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে দলমত নির্বিশেষে সবার একমত হওয়া কঠিন নয়।
আমাদের ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল- কেন্দ্রীয় সরকার আয়তনে ছোট হবে এবং জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যেমন- প্রতিরক্ষা, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শিক্ষা এবং জ্বালানির মতো জাতীয় বিষয়গুলো তার হাতে থাকবে। স্থানীয় প্রশাসন এবং উন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয় বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার নৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রাদেশিক সরকারকে সহযোগিতা করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত উন্নয়ন তহবিল থাকবে। স্থানীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে এ তহবিল গঠিত হবে। প্রাদেশিক সরকার হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ফেডারেটিং ইউনিট। প্রত্যেক প্রদেশের নিজস্ব প্রাদেশিক পরিষদ থাকবে। প্রত্যেক থানা ও উপজেলাকে প্রাদেশিক পরিষদের এক একটি আসন বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও তার সহকর্মীরা অনেক খেটে যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাতে অনেকটা ভারতীয় পদ্ধতির আদল আছে, যেখানে কেন্দ্রশাসিত রাজধানী মহানগর সরকার গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তন, জেলা পরিষদ বাতিল, উপজেলা পর্যায়ে একজন এএসপিকে ‘জননিরাপত্তা অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার মতো সুপারিশও রয়েছে। একটির বদলে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন এবং উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ থেকে ৫০ শতাংশে কমিয়ে আনার প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত।
জনপ্রশাসনের ‘জেলা প্রশাসক’ এবং এ ধরনের বিভিন্ন পদ-পদবির নাম পরিবর্তনের সুপারিশের পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তার দায়িত্ব ও ক্ষমতা কমবেশি করার সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন- জেলা প্রশাসককে ডিসট্রিক্ট কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা কমিশনার করতে বলা হয়েছে। জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা (নালিশি মামলা) প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। বলা হয়েছে- ‘তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন।’
উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপনের সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে- উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন করা হলে নাগরিকরা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেয়ার কথা বলেছে কমিশন। থানার অফিসার ইনচার্জ-ওসির কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে উপজেলা জননিরাপত্তা অফিসার হিসেবে পদায়নের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। বলা হয়েছে- এর ফলে থানার জবাবদিহি আরো বাড়তে পারে।
দেশের জনসংখ্যা ও সরকারের কার্যপরিধির নিরিখে বর্তমান প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা- এই চার বিভাগে বিভক্ত ছিল। বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে পুরনো চার বিভাগের সীমানা ধরে চারটি প্রদেশ করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে কমিশন। এর ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে। এছাড়া, জেলা পরিষদ বাতিল ও উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতেও বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনে। বর্তমানে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার সার্ভিসের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে। তবে, সরকারকে দেয়া প্রস্তাবে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো- সাধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। সিভিল সার্ভিসের আওতায় একীভূত ক্যাডার সার্ভিস-এর বদলে কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতা অনুযায়ী আলাদা নামকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে চালু বিভিন্ন ক্যাডারকে ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিন্যস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপসচিব পদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে আনার প্রস্তাব আছে প্রতিবেদনে। সচিব নিয়োগে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন, সিনিয়র সচিব পদটির পরিবর্তে মুখ্যসচিব পদ চালুর সুপারিশও রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো- বিধিবদ্ধ প্রশাসন, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য, ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ, কৃষি ও পরিবেশ, মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন।
সব প্রস্তাব বা সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে তা নয়। তবে এতে অনেক অসঙ্গতিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা