আওয়ামী লীগে গৃহদাহ
- শরিফুল ইসলাম
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
হঠাৎ করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রীতিমতো আলোচনার ঝড় তুলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব:) মুহাম্মদ ফারুক খান। ফারুক খান শুধু আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও বটে। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ফারুক খান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন। স্ট্যাটাস দেয়ার পরপরই অবশ্য তিনি তার ফেসবুক আইডিটি ডিঅ্যাক্টিভ করে রাখেন। কিন্তু ততক্ষণে তার স্ট্যাটাসটি স্ক্রিনশটসহ ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় এবং গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসে।
ফারুক খান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘অনেক চেষ্টা করে অনলাইনে এসেছি। জেলের চার দেয়াল আমাদের নিজ সত্তার সামনে দাঁড়া করায়। অনেক কিছু বলতে চাই কিন্তু এখন সবই বলতে পারছি না। এতটুকুই বলব, শেখ হাসিনাকে নেত্রী মেনেছিলাম কিন্তু আজকে তার হঠকারিতার জন্যই আমাদের দলের এই পরিণতি। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযান ব্যতীত কোনো ধরনের রাজনীতিতে ফেরা উচিত হবে না। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আর চাই না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ফেরত চাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
কারাগারে বসে ফারুক খানের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, কারাগারে থেকে ফেসবুক চালানো সম্ভব নয়। ফারুক খান বর্তমানে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন। কারাগারে আটক কোনো বন্দীর পক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। ওই আইডি সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের পক্ষে কারাগারে থেকে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে অন্য কেউ বা তার আত্মীয়স্বজন আইডিটি পরিচালনা করছে কি না, তা কারা কর্তৃপক্ষ জানে না।
ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুক না কেন, এই স্ট্যাটাস যে ফারুক খান নিজে কারাগারে বসে দিয়েছেন, তা তার স্ট্যাটাসের ভাষা দেখে অনুমান করা যায়। একই সাথে ফেসবুক আইডিটি ডিঅ্যাক্টিভ করা থেকেও ফারুক খানের আইডির স্ট্যাটাসটি যে তার দেয়া সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারাগার সম্পর্কে একটি কথা বেশ প্রচলিত রয়েছে, তা হলো- টাকা হলে কারাগারে সবই মেলে!
গত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের জন্য কারগার ছিল মানসিক নির্যাতনের নিকৃষ্টতম স্থান। একই সাথে থানাগুলো ছিল শারীরিক নির্যাতনের টর্চার সেল। কারাগারের ভেতরে যেমন ছিল মানসিক নির্যাতন তেমনি কারাগার থেকে কোর্টে যাতায়াতের সময় ছিল সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার নিকৃষ্টতম আয়োজন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের নেতাকর্মীদের যেভাবে চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসীর মতো হাতকড়া ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে যেভাবে কারাগার থেকে কোর্টে যাতায়াত করানো হতো তা ছিল নজিরবিহীন। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা আব্দুস সুুবহানসহ এটিএম আজহারুল ইসলাম ও সালাহ উদ্দিন কাদেরের মতো নেতাদের হাতে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর দৃশ্য এখনো সবার চোখের সামনে ভাসে। কোর্ট থেকে রিমান্ড কিংবা গ্রেফতার করার পর থানায় নিয়ে অকথ্য নির্যাতন ছিল শতাব্দীর নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এসবের বাইরে আয়নাঘরের কথা বলাই বাহুল্য। আর এখন দিনদুপুরে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে পঙ্গু করাসহ নানাভাবে আহত করার পরও গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগের আসামিরা কারাগারে জামাই আদরে থাকেন। শুধু জামাই আদরেই থাকেন না, কখনো কখনো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতেরও ছক আঁকেন!
২.
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগে ফিরে যাওয়ার যে আকুতি ফারুক খানের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে তা দলটির রাজনীতির জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
শেখ হাসিনা দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করে ফেলেছিলেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে সহ্য করেননি। রাজনীতির মাঠের প্রতিপক্ষকে তিনি নির্মমভাবে দমন করেছেন। কোনো আইনকানুনের তোয়াক্কা করেননি। শেখ হাসিনার আক্রোশের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে বাদ যায়নি বিএনপিও। দলটির প্রভাবশালী নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও হাসিনা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে দিনের পর দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেছেন, রেখেছেন গৃহান্তরীণ করে। আর তার পুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা ও সাজা দিয়ে দিয়ে দেশে আসার পথই রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে শেখ হাসিনা বারবার এ ম্যাসেজই দিতেন যে, বেশি বাড়াবাড়ি করবা তো বিএনপি-জামায়াতের পরিণতি ভোগ করতে হবে। ফলে হাসিনাবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোও তার বিরুদ্ধে প্রত্যাশা অনুযায়ী দাঁড়াতে পারেনি কিংবা কখনো তার কথা মতোই চলেছে।
এসবের পাশাপাশি শেখ হসিনা তার পরিবারকে একক কর্তৃত্বের বলে অন্যায়-অন্যায্য সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন। বানিয়েছিলেন ক্ষমতার ভাগীদার। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, শেখ পরিবারের সদস্যরা গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ হাসিনার স্বজনদের মধ্যে অন্তত আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ছিলেন। আর সংসদ সদস্য হয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন। এ ছাড়া ক্ষমতার ছোট-বড় নানা স্তরে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন। এভাবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। শুধু শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ই যুক্তরাষ্ট্রে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন বলে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সম্প্রতি জানতে পেরেছে।
অন্য দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা, তার পরিবার এবং তাদের সরাসরি প্রশ্রয়ে রাজনীতিবিদ, আমলা, এমপি, মন্ত্রী, পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা ৩০ লাখ কোটি টাকারও বেশি পাচার করেছেন। প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন বা ১৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এ তো গেল রাজনীতি আর অর্থনীতির হিসাব। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। এটি যে শেখ হাসিনা তার একক ইচ্ছায় করেছিলেন তা নানা সময়ে তার বক্তব্য থেকেই প্রমাণ হয়েছে। আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে দেশের এমপি পদপ্রার্থী নিজেকে ভারতের এমপি প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিতেন! শেখ হাসিনার অতি ভারতপ্রেমের ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারত প্রতিবেশীসুলভ আচরণের পরিবর্তে প্রভুসুলভ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এই যখন অবস্থা তখন দেশের জ্বালানি খাতের দস্যু সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খানের ভাই ফারুক খান যে বুঝেশুনেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পরিবর্তে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের রাজনীতি চেয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। ফারুক খান ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, শেখ হাসিনার একের পর এক একতরফা ও রাতের ভোট করে সংসদ দখল করা ঠিক হয়নি। তিনি ঠিকই বুঝেছেন, ভারতের এত আবদার পূরণ করে দেশকে ভারতের কলোনির মতো বানানো ঠিক হয়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জেদ করে ছাত্র-জনতাকে পাখির মতো মারা ঠিক হয়নি। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে মানুষ আর শেখ হাসিনাকে মেনে নেবে না। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার যথাযথ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি চান। অতএব, এখন আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিয়ে ফারুক খানের এই ভাবনা যে শুধুই ফারুক খানের একার ভাবনা তা বলার সুযোগ নেই। এই ভাবনা আওয়ামী লীগের চিন্তাশীল অসংখ্য নেতাকর্মীর।
কিন্তু ফারুক খান যে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ চাচ্ছেন সেই আওয়ামী লীগ কি খুব ভালো? মোটেই না। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা তো শেখ মুজিবের রাজনীতিই করে গেছেন। শেখ মুজিব সংসদে বিল পাস করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যস্থা কয়েম করেছিলেন আর শেখ হাসিনা সংসদে বিল পাস না করে গায়ের জোরে একতরফা সংসদ নির্বাচন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান দিয়েই তো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দেশে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করেছিল। শেখ মুজিবের শাসনামলে ব্যাংক ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে শেখ হাসিনার আমলেও একই ঘটনা ঘটেছে। শুধু পদ্ধতিটা ভিন্ন।
৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে হলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী আচরণ তো বটেই, মুজিববাদও পরিহার করে আসতে হবে।
আওয়ামী লীগকে গণহত্যার বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। দলটির নেতাকর্মীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ বাংলাদেশে হবে না।
৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন যুগে পদার্পণ করেছে। এখানে আর স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ জায়গা করে নিতে পারবে না। নতুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আর কখনো নতজানু, স্থায়ী শত্রু-মিত্রের ভিত্তিতে রচিত হবে না। এখানে দেখা হবে শুধু জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই যেকোনো দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এখানে আর কখনো ভারতীয় আধিপত্যবাদ হালে পানি পাবে না। নতুন বাংলাদেশ হবে সবার। এখানে আর চেতনার তেজারতিতে দেশ বিভক্ত করার খায়েশ পূরণ হবে না। এখানে
এখন সবাই বাংলাদেশকে ভালোবেসে দেশপ্রেমের রাজনীতিতে উদ্বুব্ধ হবে।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে ফারুক খানের এমন বক্তব্য মাত্র শুরু হলেও শেষ নয়। আগামীতে শেখ হাসিনা তো বটেই, আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করার ক্ষেত্রেই দলটির মধ্যে আপত্তি চলে এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ফারুক খানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গৃহদাহ শুরু হলেও আগামী দিনে এই দাহ আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা