জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী
- প্রফেসর এম এ রশীদ
- ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মিশনে অংশগ্রহণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রভাব বেড়েছে। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে এবং সেই থেকে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা দক্ষতা, সাহস ও পেশাদারিত্বের জন্য প্রশংসিত হয়ে আসছেন।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে যেমন- কঙ্গো, লেবানন, সুদান, লাইবেরিয়া, মালিসহ আরো অনেক স্থানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিয়মিতভাবে নিযুক্ত আছেন। তারা সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাড়াও মানবিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসাসেবা, পুনর্বাসন কার্যক্রম এবং স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের এই অবদান শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠাই নয়; বরং দেশের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক সুবিধাও নিয়ে এসেছে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃত।
মিশন পরিচালনায় বাংলাদেশী শান্তিরক্ষাবাহিনীর ভূমিকা
বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা শান্তি প্রতিষ্ঠা, সঙ্ঘাত নিয়ন্ত্রণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে আসছেন। তাদের এই কার্যক্রম শুধু অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রদানেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা স্থানীয় জনগণের সহায়তায় মানবিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে।
পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বাড়ছে
জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করার ফলে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং সরাসরি সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করার মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এটি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামরিক বাহিনীর উচ্চতর প্রশিক্ষণ
আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ : শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়ার আগে সদস্যদের জাতিসঙ্ঘের মান অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে আধুনিক কৌশল, প্রযুক্তি ব্যবহার, মানবাধিকার রক্ষা এবং জাতিসঙ্ঘের নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জিত হয়।
বহুজাতিক দলে কাজ করার অভিজ্ঞতা : বাংলাদেশী সেনারা বিভিন্ন দেশের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। এটি তাদের বহুজাতিক দলগত কাজের দক্ষতা বাড়ায় এবং বৈশ্বিক সামরিক কৌশল সম্পর্কে অবগত হতে সহায়তা করে। বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ : সঙ্ঘাত নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসবাদ দমন, জননিরাপত্তা বজায় রাখা এবং মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা
সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় দায়িত্ব পালন : বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা কঙ্গো, মালি, দক্ষিণ সুদান এবং দারফুরের মতো সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করার সময় সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অস্ত্রধারী বিদ্রোহী দল ও সশস্ত্র মিলিশিয়াদের সাথে মুখোমুখি হতে হয়, যা তাদের যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে মূল্যবান শিক্ষা দেয়।
অস্ত্র পরিচালনা : শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়ার সময় সামরিক বাহিনী বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র পরিচালনা এবং সঙ্কট মোকাবেলার কৌশল রপ্ত করে। এটি পরবর্তী সময়ে দেশের প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়।
মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা : শান্তিরক্ষীরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়; বরং যুদ্ধকালীন মানবিক সঙ্কট, উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তা প্রদান এবং জরুরি সহায়তা প্রদানের মতো পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতাও অর্জন করেন।
প্রভাব ও গুরুত্ব
দেশের নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ : শান্তিরক্ষা মিশনে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশে ফিরে সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হওয়া দেশের ভাবমর্যাদা উন্নত করে।
নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা : যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অস্ত্রবিরতি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা সামরিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের উপস্থিতি সঙ্ঘাত নিয়ন্ত্রণ এবং অস্ত্রবিরতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বিরাট ভূমিকা রাখে।
মানবিক সহায়তা : শান্তিরক্ষীরা শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদানেও ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য তারা প্রায়ই প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। অবকাঠামো উন্নয়ন : মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশী সদস্যরা সেতু, রাস্তা, হাসপাতাল এবং স্কুল নির্মাণেও সহায়তা করেন, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন : বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্থানীয় জনগণের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করেন, যা তাদের ওপর স্থানীয় জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করে। এটি মিশনের সফল বাস্তবায়নে সহায়ক হয় এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।
নারী শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা : বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। নারী শান্তিরক্ষীরা স্থানীয় নারীদের সাথে কাজ করে তাদের অধিকার রক্ষায় সাহায্য করেন এবং নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন। শান্তিরক্ষার এই পথ অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক, কারণ তারা এমন সব এলাকায় কাজ করেন যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, সশস্ত্র সঙ্ঘাত এবং নানা ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে।
আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার উদাহরণ
জীবন উৎসর্গ : শান্তিরক্ষা মিশনে নিযুক্ত বাংলাদেশের শতাধিক বাংলাদেশী কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাদের এই আত্মত্যাগ দেশের জন্য গৌরব ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা : শান্তিরক্ষা মিশনে আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সম্মাননা অর্জন করেছেন। তাদের সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসঙ্ঘ বিভিন্ন পদক দিয়েছে।
মানবিক সাহায্যে আত্মত্যাগ : শুধু সশস্ত্র সঙ্ঘাতে নয়, অনেক বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী স্থানীয় জনগণের সেবা করতে গিয়েও জীবন দিয়েছেন। এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়েছে।
শান্তিরক্ষাবাহিনী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
শান্তিরক্ষাবাহিনীর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
বেতন ও ভাতা : জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশী সৈন্য ও পুলিশ সদস্যরা জাতিসঙ্ঘ থেকে বেতন ও ভাতা পেয়ে থাকেন। এই আয়ের একটি বড় অংশই দেশে পাঠানো হয়, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ : দেশের বাইরে মিশনে কাজ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দেশের কর্মসংস্থান সমস্যার কিছুটা সমাধান করছেন। শান্তিরক্ষীদের আয় এবং দেশে ফিরে প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধি : শান্তিরক্ষাবাহিনীর সদস্যরা তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় অংশই প্রবাসী আয় থেকে আসে। যেখানে শান্তিরক্ষাবাহিনীর রেমিট্যান্সও অবদান।
সামরিক সরঞ্জাম উন্নয়ন : শান্তিরক্ষাবাহিনীর অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সরাসরি দেশের সামরিক শক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী আন্তর্জাতিক মানের সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ পেতে সক্ষম হয়, যা পরবর্তী সময়ে দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
শান্তিরক্ষাবাহিনী থেকে প্রাপ্ত ট্যাক্স
শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়া বাংলাদেশী সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য তাদের বেতন ও অন্যান্য ভাতার জন্য ট্যাক্স দেন। এই ট্যাক্স সরকারের আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভর্সিটি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা