বাঙালি মুসলিম : শরৎ-বঙ্কিমের ঘৃণাভাষ্য ও লাল জুলাইয়ের চটকনা
উৎসের উচ্চারণ- মুসা আল হাফিজ
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:২২
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ১৮৭৬-১৯৩৮) গল্প বলেছেন। বাঙালি শুনেছে।
... স্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের ‘ফুটবল ম্যাচ’। সন্ধ্যা হয়-হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎ-ওরে বাবা-এ কি রে! চটাপট্ শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে! কি এক রকম যেন বিহ্বল হইয়া গেলাম। মিনিট দুই-তিন। ...পাঁচ-সাতজন মুসলমান-ছোকরা তখন আমার চারিদিকে ব্যূহ রচনা করিয়াছে-পালাইবার এতটুকু পথ নাই।[১]
মুসলমান আর বাঙালি আলাদা। অন্য। ভিন্ন। উভয়ের মধ্যে লড়াই হয়। মুসলমানরা ব্যূহ রচনা করে বাঙালির চার পাশে। পালাইবার পথ রাখে না। কিন্তু কেন এত সঙ্ঘাত? উভয়ে কি একমাঠে ঝগড়া ছাড়া খেলতে পারে না? কেন এত আলাদা মুসলমান? কিভাবে তারা এত ভয়ঙ্কর?
শরৎচন্দ্র প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, তা তো নয়। জবর সোজা জবাব নিয়ে তিনি হাজির। জানাচ্ছেন- ‘বস্তুত, মুসলমান যদি কখনও বলে-হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুট করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে...। দেশের রাজা হইয়াও তাহারা এই জঘন্য প্রবৃত্তির হাত হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে নাই। আওরঙ্গজেব প্রভৃতি নামজাদা সম্রাটের কথা ছাড়িয়া দিয়াও যে আকবর বাদশাহের উদার বলিয়া এত খ্যাতি ছিল, তিনিও কসুর করেন নাই। [২]
শরৎচন্দ্র আমাদের যে ইতিহাস শোনালেন, তার প্রতিধ্বনি আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের কণ্ঠেও শুনি। হিন্দুত্ববাদ মুসলিমদের ঠিক এই চোখ দিয়ে দেখে। কিন্তু এই চোখটা তৈরি হলো কোন মূল্যে? এর পেছনে সত্য মূল্য কতটুকু? বস্তুত হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের যারা যুক্তি নয়, আবেগ দ্বারা ইতিহাস লেখেছেন, তারাও চট্টোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারবেন না। কারণ (১) ঔপনিবেশিক কালপর্বের আগে হাজার বছর ধরে উপমহাদেশে মুসলিম হিন্দু পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক জীবন পার করেছে। মুসলিমরা অপরাপর জাতি ও জনগোষ্ঠীর সাথে নিজেদের সাম্রাজ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতাপূর্ণ সামাজিক বিকাশের ঐতিহ্য গড়েছেন। এশিয়া, আফ্রিকা বা ইউরোপে এই ব্যাপারটা ঘটেছে যুগ যুগ ধরে। যার স্পষ্ট স্বীকৃতি ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলোতে নিনাদিত। ভারত-বাংলায়ও এই ব্যাপারটা ঘটেছে স্পষ্টভাবে।
(২) মুসলিমরা লুণ্ঠনের জন্য এসেছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, কথাটা আগাগোড়াই অনৈতিহাসিক। মুহাম্মদ বিন কাসেম স্থানীয় সম্পদ দিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। কুতুবুদ্দীন আইবেক ভারতের সম্পদ দিয়ে ভারতকেই সাজিয়েছেন। তারপরের প্রত্যেক রাজবংশ ও শাসক একই কাজ করেছেন। সম্পদ লুট করে পাঠিয়ে দেবার মতো আলাদা কোনো স্বদেশ তাদের ছিল না। সুলতান মাহমুদ গজনবী কিংবা তৈমুরী আক্রমণ যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ভারতে প্রবেশ করেছে। আফগানিস্তানে হিন্দু শাহী রাজত্বের সাথে গজনী রাজত্বের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ভারতীয় রাজাদের অনুপ্রবেশ তাকে ভারতে নিয়ে আসে। সুলতান মাহমুদ সোমনাথ আক্রমণ করেছিলেন, এটাই এই দাবির আসল পুঁজি। এর ওপর পা রেখে গোটা মুসলিম আমলকে ডাকাতি বানাবার আগে চট্টোপাধ্যায়ের জানা দরকার ছিল, সোমনাথ আক্রমণে প্রায় অর্ধেক সেনাপতি ছিলেন হিন্দু, সুলতান মাহমুদের বাহিনীর ১২ সেনাপতি ছিলেন হিন্দু, যাদের দু’জন আবার বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ। হিন্দু ঐতিহাসিক কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ যদি সামনে থাকে, তাহলে সোমনাথের গোটা অভিযানের সামনে হিন্দু নেতাদের দেখা যাবে। সেখানে আনন্দ পালের ভূমিকার কথা জানলে চট্টোপাধ্যায় বাবু শরম পেতেন বোধ করি।
তৈমুর লংয়ের আক্রমণ রাজ্য দখলের জন্য ছিল না, বলা যায় না। কিন্তু তার মোকাবেলা মূলত করেছেন মুসলিমরাই। তার জুলুম মুসলিমদের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে প্রকৃত অর্থে। এই ঘটনাগুলোর একদেশদর্শী বিচার দিয়ে ইতিহাসের ভাষ্য দাঁড়ায় না। আবার নিজের কল্পিত একচক্ষু ব্যাখ্যাকে হাজার বছরের মুসলিম আমলের একমাত্র বিষয় হিসেবে চালিয়ে দেবার জবরদস্তি থেকে চট্টোপাধ্যায় তার দ্বিতীয় দাবি হাজির করতে পারলেন।
প্রতিমা ধ্বংসের অভিযোগও করেছেন তিনি। কিন্তু প্রতিমা ধ্বংস হয়েছে হিন্দুদের হাতেই বেশি। পুরীর জগন্নাথ মন্দির কোন ধর্মের মন্দির ছিল? স্বামী বিবেকানন্দের মতে-ওটা ছিল এক সময় প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির।...আমরা, হিন্দুরা তা দখল করেছি। [৩] জগন্নাথ মন্দির আঠারো বার আক্রমণ ও লুণ্ঠন করা হয়েছে। সেগুলো হয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধদের নানা অংশের হাতে।
শৈবরা জৈনদের কত মন্দির ভেঙেছে, এর পরিমাপ প্রায় অসম্ভব। বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের অগণিত মন্দির ভেঙেছে শৈবরা। সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, মহেন্দ্র বর্মা, অজাতশত্রু, সুভাত বর্মণ, দ্বিতীয় পুলকেশী, কাশ্মিরের রাজা শ্রীহর্ষ, রাজেন্দ্র চোল, পুষ্যমিত্র শুঙ্গু এসব ইতিহাস-প্রসিদ্ধ রাজাদের হাতে মন্দির ও প্রতিমা বিনাশের অসংখ্য দাগ। রাজা প্রথম নরসিংহ বর্মণের (৬৩০-৬৬৮) হাতে লুণ্ঠিত হয় চানক্যদের রাষ্ট্রদেবতা মন্দিরের মূল বিগ্রহ গণেশ মূর্তি; ৬৪২ সালে।
রাজা ললিতাদিত্যের (৬৯৯-৭৩৬) রাজ্যে পাল রাজাদের আক্রমণ ঘটেছে বারবার। কাশ্মিরে রাজকীয় দেবতা রামস্বামী নামক বিষ্ণু মূর্তিকে ভেঙে দেন তারা ।
চোল রাজা প্রথম রাজেন্দ্র (১০১৪-১০৪২) কুখ্যাত ছিলেন বিভিন্ন রাজমন্দির থেকে দেবমূর্তি লুট করার জন্য। ওড়িশার রাজা কপিলেন্দ্র তামিলনাড়ুতে আক্রমণ করেন ১৪৬০ সালে। লুট করেন বহু শৈব ও বৈষ্ণব মন্দির, ধসিয়ে দেন মন্দিরের স্থাপনা।
কাশ্মিরের রাজা শ্রীহর্ষের (১০৮৯-১১০১) একটি বাহিনী ছিল। যাদের কাজ ছিল মন্দির ধ্বংস করে সেখান থেকে ধনরতœ সংগ্রহ করা। সেই বাহিনীর নাম ছিল ‘দেববাৎপাটক’। কলহন তার রাজতরঙ্গিনীতে লিখেছেন, কোনো গ্রাম শহর বা নগরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার মূর্তির বিনাশ হয়নি রাজা হর্ষের হাতে। দ্বাদশ শতকেও গুজরাটের পারমার হিন্দু রাজারা সম্পদের লোভে অসংখ্য মন্দির লুট করেন। ধ্বংস করেন। সুভাত বর্মণ (১১৯৩-১২১১) এর কথাই ধরুন। দাভয় ও ক্যাম্বে অঞ্চলের বহু জৈন মন্দির লুণ্ঠন করেন তিনি ।[৪]
মুসলিমদের কি এমন কোনো বাহিনী ছিল? মোটেও না। বরং মুসলিম শাসকরা অসংখ্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ভূমিদান করেছেন। পুরোহিতদের মাসোহারা দিয়েছেন। জায়গীরে ভূষিত করেছেন। বেনারস, কাশ্মির ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দুমন্দির এবং তৎসংলগ্ন দেবোত্তর ও ব্রাহ্মোত্তর সম্পত্তি আওরঙ্গজেব নিজের হাতে দান করেছেন; এসব ‘সনদ’ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। চিত্রকোটের রামঘাটের বালাজী মন্দির বা বিষ্ণু মন্দিরটি অত্যন্ত বিখ্যাত। তার গায়ে আজো লেখা আছে, সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত বালাজী মন্দির। মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির উজ্জয়িনীর প্রধান এক মন্দির। রুদ্রসাগর হ্রদের তীরে অবস্থিত এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে স্বয়ম্ভু বা শিবের সাক্ষাৎ-মূর্তি মনে করা হয়। এই মন্দিরের ‘নন্দদীপ’ জ্বালাতে রোজ চার সের ঘি লাগে। বহু বছর আগ থেকেই এর জোগান দিয়ে আসছে রাষ্ট্র। সে মন্দিরের পুরোহিত বলেন, ‘মোগল আমলেও নিয়মিত ঘি সরবরাহ করা হয়েছিল। এমনকি এ প্রাচীন ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতেন আওরঙ্গজেবও।[৫]'
রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন-বাংলায় সম্রাট আওরঙ্গজেব যেকোনো মোগল শাসকদের চেয়ে বেশি মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। [৬]
কাশীর মন্দির, অর্থাৎ বিশ্বনাথের মন্দির আওরঙ্গজেব ভেঙেছিলেন- একথা খুব প্রচলিত। কেন ভেঙেছিলেন তারও একটা ইতিহাস আছে। বাংলা অভিমুখে যাত্রাপথে আওরঙ্গজেব যখন কাশীর কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তখন তার অধীনস্থ হিন্দুরাজারা অনুরোধ করেন যদি একদিনের যাত্রাবিরতি ঘটানো যায় তাহলে রাজমহিষীরা গঙ্গাস্নান করে প্রভু বিশ্বনাথকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে পারেন। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে রাজি হয়ে যান। কাশী থেকে পাঁচ মাইল দূরে আওরঙ্গজেব এক সেনাশিবির স্থাপন করেছিলেন। মহিষী, অর্থাৎ রাণীরা শিবিকারোহণে যাত্রা করলেন। স্নান সেরে পূজো দিয়ে রাণীর সঙ্গীসাথীরা ফিরে এলেন মন্দিরের বাইরে। ফিরে এলেন না একজন- কচ্ছের মহারাণী। আওরঙ্গজেব রাণীর খোঁজে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের পাঠালেন। খুঁজতে খুঁজতে পরে দেখা গেল ... ভূতল-কক্ষে প্রভু বিশ্বনাথের বেদির ঠিক নিচে প্রধান মহান্ত কর্তৃক মহারাণী ধর্ষিতা হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হিন্দুরাজাদের সোচ্চার দাবি মন্দির অপবিত্র, নোংরা হয়ে গেছে, বিগ্রহ সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। আওরঙ্গজেবও হিন্দুদের সঙ্গত দাবি মেনে নেন। তার হুকুম মতো বিগ্রহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মন্দির ভেঙে ফেলেন।[৭]
রাজা শংকর বর্মণ (৮৮৩- ৯০২) একাই ৬৪টি মন্দির লুট করেছিলেন।[৮] আর গোটা মোগল আমলে; ৫০০ বছরে ধ্বংসের শিকার হয় মাত্র ৮০টি মন্দির।[৯] কিন্তু এই মন্দিরগুলো ধ্বংস হয় ধর্মীয় কারণে নয়।
রিচার্ড ইটন বিস্তর গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের কারণেই মন্দিরগুলো ধ্বংস হয়। মন্দিরগুলো সম্পদ ও সামাজিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। প্রায়ই বিদ্রোহী রাজা ও সেনাপতিরা মন্দিরে আশ্রয় নিতেন। মন্দির পরিণত হতো সেনাঘাঁটিতে। ফলে অভিযান মন্দিরের দিকে এগিয়ে যেত। [১০]
আবার বহু মন্দির বিলুপ্ত হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এমনটি ঘটেছে বহু মসজিদের ভাগ্যেও। [১১]
আওরঙ্গজেব জামা মসজিদ ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন। এর পেছনেও ছিল অন্য এক সঙ্গতকারণ।
এই যখন বাস্তবতা, তখন বাবু চট্টোপাধ্যায় এত ঘৃণা বিস্তার করছেন কীসের বলে? তিনি হেনরি এলিয়ট (১৮০৮-১৮৫৩) ও জন ডাউসন (১৮২০-১৮৮১) প্রমুখের বানানো গল্পকে পুঁজি করেই মিথ্যাটি হাজির করেছেন। মুসলিমরা নারী ধর্ষণ করেছে, এমনতরো ঘটনা এলিয়ট-ডাউসনের মাথার ভেতরে ঘটেছিল বোধ হয়। ইতিহাস তা ঘটতে দেখেনি। চট্টোপাধ্যায় বাবু তা রাষ্ট্র করলেন প্রমাণের দায় না নিয়েই। গায়ে তার অনেক জোর ছিল তো! ঔপনিবেশিক ভাগ ও শাসন প্রকল্পের এই পণ্ডিতরা ওরিয়েন্টালিস্ট প্রবণতার বাজে দিকগুলো বহন করতেন। উপমহাদেশের বর্তমানকে রণক্ষেত্রে পরিণত করার পেছনের বহু গালগল্প তারাই প্রথমবার রটনা করেছেন ইতিহাস চর্চার নামে। তাকে অমৃত হিসেবে গিলেছে কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবিতা। সেই ধারায় অসংখ্য ইসলামফোব এমনতরো প্রচারণায় উপমহাদেশের বাতাসে বিষবিস্তার করছেন। সীতা রাম গোয়েল (১৯২১-২০০৩) যার নিকটতম নজির।
এই যে মুসলিমদের যেকোনো মূল্যে অপর ও অপরাধী বানাবার ঔপনিবেশিক প্রবণতা, তা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন এবং ওয়ার অন টেররের ওপর সওয়ার হয়ে নতুন ভয়াবহতা লাভ করেছে। কিন্তু বাংলায় তা ভয়াবহভাবে তেতে আছে বহু আগ থেকেই। থামেনি কখনো। এই তেতে থাকার প্রবণতা বাংলাদেশী সত্তা, বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থান, বাংলার মুসলিম, মুসলিম পরিচিতি ও প্রতীক ইত্যাদিকে বরাবরই দেখেছে ঘৃণার চোখ দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই চোখের ভালো নজির। তিনি ঢাকাকে বয়ান করেছেন এভাবে-
‘ঢাকাতে দুই-চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়নপথের পথিক হইবে-কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। বাড়িতে কাক আর কুকুর, আদালতে মুসলমান।’ (বঙ্গদর্শন)।
বঙ্কিমের বাঙালি জীবনে মুসলিমসত্তা কোনো সম্মান নিয়ে হাজির হতে পারে না। কারণ বাঙালির ইতিহাসের ফুটনোটেই কেবল তার জায়গা থাকতে পারে। সে বাঙালির বাইরের কেউ; অবাঞ্ছিত। নিম্নস্তরের। অধম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ‘বাঙালির উৎপত্তি’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে তিনি বাংলাভাষী মুসলমানদের বাঙালি জাতি থেকে একপ্রকার খারিজ করে দেন। বঙ্কিমের মতে, ‘ইংরেজ এক জাতি, বাঙালি বহু জাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙালি বলি তাহাদের মধ্যে চারি প্রকার বাঙালি পাই। এক, আর্য, দ্বিতীয় অনার্য হিন্দু, তৃতীয় অর্যানার্য হিন্দু, আর তিনের বাইরে এক-চতুর্থ জাতি বাঙালি মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালি অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙালি মুসলমান; উপরের স্তরে কেবলই আর্য।’
কিন্তু ঔপনিবেশিক ও হিন্দুত্ববাদী ভাষ্য বাঙালির ইতিহাসের ধারা নির্ধারণ করতে পারেনি। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তা মুসলিমদের প্রযতেœর স্বত্বকে পতাকার মতো তুলে ধরেছে ঊর্ধ্বে। মুসলিম ভাষ্য কখনো বাঙালি হিন্দুকে বাদ দিয়ে নিজেদের বাঙালি পরিচয় নির্মাণ করছে না। সে সবাইকে নিয়েই নিজের মুসলিম ও বাঙালি সত্তাকে একত্রে ধারণ করছে। এটা করতে গিয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলার ভূমির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ প্রদর্শন করেছে। এর ফলে গঠন করেছে বাংলা নামের সমন্বিত স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধার করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী মৃত্যুরাত্রি থেকে, মননশীল নির্মাণের ধারাকে দিয়েছে গতি ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভাষার জন্য প্রাণদানের পরম নজির স্থাপন করেছে। বাঙালি ও বাঙালিত্বের রাজধানী এখন ঢাকা। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণী নয়, বাঙালির এখন একটাই শ্রেণী, যা মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ বিশ্বাসের বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে আবহমান বাঙালি ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়ে বিকশিত।
দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্পষ্ট লিখেছেন : ‘যুক্ত বাংলায় এতকাল হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি থাকলেও কিছুতেই যেন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেনি। তার জন্য অনেকটাই দায়ী ফাঁকা হিন্দু উন্নাসিকতা। বাঙালি হিন্দুরা বহু দিন ধরে গোপনে বলে এসেছে- আরে ঐ লোকটা তো মুসলমান ও আবার বাঙালি নাকি? যেন মুসলমানরা বাঙালি হতে পারে না।
অধিকাংশ হিন্দুরাই জানে না কিংবা খেয়াল করে না যে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য যাবতীয় লড়াই বাঙালি মুসলমানরাই করেছে। একটু আগে থেকে শিক্ষা পাওয়ার সুযোগে হিন্দুদের মধ্যে অনেক বড় বড় লেখক জন্মে যেত বটে, কিন্তু সম্মিলিতভাবে বাঙালি হিন্দুরা বাংলা ভাষার জন্য কিছুই করেননি। মুসলমানরা যেটা ভাবতে শুরু করেছে পাকিস্তানি আমলেরও অনেক আগে, সেই উনিশশ’ সাইত্রিশ সাল থেকে।[১২]
বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় ২৭ কোটি মানুষ। এর মধ্যে ১৮ কোটি মুসলমান। রক্ত দিয়ে এই ভাষার মহিমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঢাকা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায়ও বাংলা ভাষা বলতে গেলে বিপন্ন। বঙ্কিমের উত্তরসূরিরা আজ বাঙালি থাকতে পারছে না। বোধ হয় চাইছেও না অনেকেই। দিল্লি ও হিন্দির দাসত্বের সামনে সমর্পিত তাদের দিন-রাত। এই বাস্তবতা বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা শরতের বাঙালি-বয়ানের প্রতি উপহাস করছে আজ। তবুও এ দেশে মুসলিম ও ইসলামলগ্নতাকে দেখবার বঙ্কিমি ঘৃণাদৃষ্টি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামফোব সেকুলার প্রবণতার প্রশ্রয়ে বহুমুখী ও অবিচল বিস্তার লাভ করেছিল। সেই মন ও দৃষ্টি নিজেকে বাঙালি ও বাংলাদেশী মননের চালকের ভূমিকায় দেখতে চেয়েছে। কিন্তু ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান তার গালে বড়সড় একটা চটকনা বসিয়ে দিয়েছে। বস্তুত এই প্রবণতার উচ্ছেদের মধ্য দিয়েই অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশের দায় ও দরদপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া লাল বিপ্লবের অঙ্গীকার।
[১] ‘শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, শরৎরচনাবলী, খণ্ড-১, পৃ. ৭।
[২] শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, প্রাগুক্ত
[৩] Complete works of Swami Vivekananda, Vol-3, lectures from Colombo to Almora
[৪] রোমিলা থাপার : সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, জে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, পৃ ৪৭
[৫] গোলাম আহমাদ মোর্তজা : ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়, পৃ.১৩৮।
[৬] Temple Desecration and Muslim State in Medieval India, Richard M Eaton/ Lives Of Indian Images, Richard H Devis, p 66-69.
[৭] অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম প্রথম খণ্ড, এক হাতে তলওয়ার, অন্য হাতে কুরআন। আরোহী প্রকাশন, মে, ২০২১)
[৮] আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮০-৮১
[৯] Temple Desecration and Muslim State in Medieval India, Richard M Eaton/ Lives Of Indian Images, Richard H Devis, p 66-69.
[১০] Essays on Islam and Indian History, Richard M Eaton, p 107
[১১] রোমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি : সাম ফ্যাক্টস, সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট, জুন-জুলাই, ১৯৯০, পৃ. ১৩।
[১২] সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। দেশ; ১৪.০৪.১৯৮৯।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা