নারীর উন্নয়নে জাকাত : সিজেডএমের ভূমিকা
- শওকত আরা
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অর্থ হলো তাদের এমন সম্পদ, দক্ষতা ও সুযোগ প্রদান করা যাতে তারা অর্থনীতিতে পূর্ণ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। বর্তমান বিশ্বে নারীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও শিক্ষার অভাব, আর্থিক সেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের সীমাবদ্ধতাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার এক অনন্য ব্যবস্থা জাকাত। জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। ঈমান ও সালাতের পরই এর অবস্থান।
মুসলিমরা প্রতি বছর তাদের সঞ্চয়ের ২.৫ শতাংশ অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে বিতরণ করতে বাধ্য। জাকাত সমাজে সম্পদ পুনর্বণ্টনের বাধ্যতামূলক মাধ্যম, যা দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সহায়ক।
অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জাকাতের প্রাপক হিসেবে বিবেচনা করে জাকাতের অর্থ দেয়া হলে তা সমাজে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কিছু প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে এই পরিবর্তন সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় :
১. নারীদের আয় করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও সুযোগ দেয়া হলে তারা নিজেদের ও পরিবারকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনার সম্ভাবনা বাড়ায়। বিশেষত যেখানে নারীরা পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। এ ছাড়া নারীরা পুরুষদের তুলনায় তাদের আয়ের একটি বড় অংশ পরিবারে- বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিতে ব্যয় করে। তাই জাকাতের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করে।
২. সমাজে নারী-পুরুষের এমন বহু প্রচলিত ভূমিকা ও রীতি আছে, যা নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সীমিত করে তাকে আরো দুর্বল, অসহায় ও বিপর্যস্ত করে দেয়। নারীদের জাকাতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। ক্ষমতায়িত নারীরা তাদের পরিবারের ও বৃহত্তর সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে বেশি সক্ষম হয়, যা আরো সমতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীদের নিজেদের জীবনের ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ এনে দেয় এবং অন্যদের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে। ফলে নারীনির্যাতনের ঝুঁঁকি কমে।
৩. গবেষণায় দেখা যায়, উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) অনুমান করে যে, কর্মশক্তিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করলে অনেক দেশের জিডিপি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। নারীর ক্ষমতায়নকে সমর্থন করে, জাকাত-তহবিলভিত্তিক এমন উদ্যোগগুলো হতে পারে স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালক।
কেস স্টাডি : জাকাতভিত্তিক নারীর ক্ষমতায়ন
১. ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে জাকাত তহবিলকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। একটি উদ্যোগ হলো নারীদের জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোগ্রামে জাকাতের ব্যবহার। এতে নিম্ন আয়ের পটভূমি থেকে আসা নারীদের সুদমুক্ত ঋণ, আর্থিক শিক্ষার প্রশিক্ষণ ও ব্যবসা উন্নয়ন সেবা প্রদান করে।
উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জাকাত বোর্ড (Baznas)-এর দেসা বারদায়া প্রোগ্রাম, নারী উদ্যোক্তা প্রোগ্রাম, ফ্যামিলি হোপ প্রোগ্রামসহ আরো এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যা ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য অনুদান এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। এর মাধ্যমে হাজার হাজার নারী কৃষি, কুটিরশিল্প ও খুচরা খাতের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরু ও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
২. পাকিস্তান : পাকিস্তানে নারীদের শিক্ষার ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য জাকাত কাজে লাগানো হচ্ছে। জাকাতের অর্থে পরিচালিত কর্মসূচিগুলো সুবিধাবঞ্চিত তরুণীদের বৃত্তি দেয়, যা তাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ দেয়।
এ ছাড়াও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো নারীদের বিবিধ কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়; যা তাদেরকে চাকরি পেতে বা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অসংখ্য নারীকে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম করেছে।
৩. মিসর : মিসরে জাকাত ক্রমবর্ধমানভাবে সামাজিক উদ্যোগ এবং সমবায় মডেলের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। সমবায়ের মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের সম্পদ একত্রিত করতে, বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে এবং দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে পারে। যেমন- কিছু কর্মসূচি গ্রামীণ নারীদের কৃষিকাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ দেয়, যেমন মুরগি পালন বা হস্তশিল্প, যা তারা গৃহস্থালি দায়িত্বের পাশাপাশি পরিচালনা করতে পারে।
সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের অভিজ্ঞতা
সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেডএম) প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০০৮ সালে। ২০১০ সালে জীবিকা উন্নয়ন কর্মসূচি ও জিনিয়াস স্কলারশিপ কর্মসূচিতে জাকাত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু হয়। জীবিকা উন্নয়ন কর্মসূচিতে জাকাতের হকদার ২৮ হাজার ৬৫২ জন নারীর নামে সমসংখ্যক পরিবার নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমানে চলমান বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিবন্ধিত আছেন ১৪ হাজার ৫০০ জন নারী।
জিনিয়াস স্কলারশিপ কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া মেধাবী মুস্তাহিক ছাত্রছাত্রীর জন্য। এই প্রোগ্রামের আওতায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৭৮ জন এবং ছাত্রীর সংখ্য পাঁচ হাজার ১৫০ জন। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত ৬৭:৩৩ বা প্রায় ২:, যেখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও ছাত্রী ভর্তির অনুপাত প্রায় ৭:৩। এ ছাড়া আছে নারীদের জন্য নৈপুণ্যবিকাশ কর্মসূচির মাধ্যমে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার কার্যক্রম।
শিক্ষা কর্মসূচি ‘গুলবাগিচা’র অধীনে আছে প্রাক-প্রাথমিক ও কুরআন শিক্ষা এবং জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে এক হাজার ৫৬ জন শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৬৩ জনই মেয়েশিশু। ফোরকানিয়া মাদরাসায় এক হাজার ৮৯০ জন মুস্তাহিকের মধ্যে আছেন এক হাজার ১০০ মধ্যবয়সী নারী শিক্ষার্থী। ২০টি হিফজুল কুরআন মাদরাসার মধ্যে একটি শুধু মেয়েদের জন্য। ৫-১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য পরিচালিত এসব মাদরাসায় ছাত্র সংখ্যা এক হাজার ৩০১ এবং ছাত্রী ৮০ জন। জাতীয় কারিকুলামের তিনটি মাদরাসার মধ্যে একটি মেয়েদের। তিনটি মাদরাসার মোট ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬০ জন ও মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১৬ জন।
ফেরদৌসি স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বর্তমানে ৬১টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু আছে। এখানে ১৬ হাজার ৯০০ প্রসূতি ও স্তন্যদায়ী মায়েরা পূর্ণ ম্যাটার্নিটি সেবা পেয়েছেন। দুরারোগ্য ও রেফারাল রোগীদের চিকিৎসা, শারীরিক দিক থেকে বিশেষভাবে সক্ষম রোগীদের সহায়ক ডিভাইস প্রদান, বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণ, ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, ক্রনিক রোগীদের নিয়মিত ওষুধ বিতরণে সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি আছে নারী ও বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্পেইন।
‘ইনসানিয়াত’ হলো সিজেডএমের বন্যা, শৈত্যপ্রবাহ, রাজনৈতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে জরুরি দুর্যোগ সহায়তা কর্মসূচি। এর আওতায় নয় লাখের বেশি অসহায় মানুষ চিকিৎসা, বাসগৃহ নির্মাণ সুবিধার মতো সেবা পেয়েছেন। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলনে শহীদদের স্ত্রীদের হাতে তাদের অশোধিত মোহরানা হস্তান্তর, সন্তানের শিক্ষা, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করা, ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি।
দাওয়াহ বা প্রচারণা কর্মসূচি আয়োজন করে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, জাকাত ফেয়ার। এসব অনুষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের পাশাপাশি তাদের মধ্যে সিজেডএমের কর্মসূচি বিস্তারে গঠিত হয়েছে উইমেন ফোরাম ফর জাকাত ক্যাম্পেইন যেখানে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত নারীরা সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জাকাত দেয়া, বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া, ওয়ার্কশপ ও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনসহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
জাকাতের সুষ্ঠু প্রয়োগ নারীদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতিময় হলেও এর প্রভাব সর্বাধিক করতে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা প্রয়োজন :
ক. সচেতনতা ও শিক্ষামূলক প্রচারাভিযান এবং সম্পৃক্ততার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং আরো টার্গেটভিত্তিক জাকাতদানকে উৎসাহিত করা।
খ. স্বচ্ছতার সাথে তহবিল পরিচালনা, দক্ষতার সাথে তা বণ্টন করা ও জাকাতের কার্যকর প্রশাসনের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। জাকাত সংস্থাগুলোর মধ্যে জেন্ডার-সেনসংবেদনশীল কর্মসূচিগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।
গ. কিছু ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি নারীদের জাকাতপ্রাপ্তিতে বা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ সীমিত করতে পারে। জাকাতভিত্তিক উদ্যোগগুলো তাই জেন্ডার-ভূমিকা সম্পর্কে সামাজিক মনোভাব পরিবর্তনের বৃহত্তর প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত হতে হবে।
উপসংহার
জাকাত সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তিশালী পদ্ধতি। এ পদ্ধতির ইতিবাচক ফলাফল ইতোমধ্যে বিভিন্ন মুসলিম দেশের নারীরা ভোগ করছেন। জাকাতের প্রভাব বাড়িয়ে তুলতে ধর্মীয় নেতা, নাগরিক সমাজ ও সরকারের মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা হলে সমাজে নারীদের সামগ্রিক অবস্থার আরো উন্নয়ন ঘটবে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে যে জাকাত শুধু ইবাদতেরই স্তম্ভ নয়, বরং তা উন্নয়নেরও স্তম্ভ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা