বাংলায় ইসলাম প্রচারে ঐতিহাসিক ও ভূমিজ প্রেক্ষিত
উৎসের উচ্চারণ- মুসা আল হাফিজ
- ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাংলায় ইসলামের বিকাশ বাঙালির যে সাংস্কৃতিক আকার তৈরি করে, তাতে যুক্ত ছিল ঐতিহাসিক ও ভূমিজ প্রেক্ষিত। বৈদিক সাহিত্য বাংলাকে আর্যাবর্তের বাইরের এলাকা হিসেবে দেখিয়েছে। বৈদিক যুগের শেষে (খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০-৫০০) আর্যাবর্তের আনুমানিক বিস্তৃতি ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পশ্চিম গঙ্গা সমভূমিতে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে ছিল অবৈদিক আর্য ও অনার্যদের বাস। যারা বৈদিক প্রতিপত্তি ও ব্রাক্ষণ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছিল। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কবুল করেছেন যে, ‘আর্যরাজগণের অধঃপতনের পূর্বে উত্তরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এই আন্দোলনের ফলাফল।’
বাংলার প্রাচীন জনপদগুলো জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে স্বাগত জানায়। এখানে তখন শক্তিশালী সংস্কৃতি ছিল। কৃষি ও শিকারজীবী, গৃহী ও অরণ্যজীবী এরকম হিসেবে অসংখ্য কৌম বা গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছিল। আর্য-ব্রাহ্মণ্য প্রভাবকে প্রতিরোধ করেছে এখানকার জনপদগুলো। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই।’
আর্যদের হোমাগ্নি প্রথমে সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে জয় করতে চেয়েছে এই অঞ্চল। বহু শতকের ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলে বাংলা-অঞ্চলের প্রতি বৈদিক ক্রোধ সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থের পক্ষী-বিশেষ’ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে দস্যু, ঋষি বিশ্বামিত্রের অভিশপ্ত অঞ্চল বাংলা ও বাঙালি।
পুরাণ ও মহাকাব্যের যুগেও এই ক্রোধ জারি থেকেছে। মহাভারতে ভীমের দিগি¦জয় প্রসঙ্গে বাংলার সমুদ্রতীরবাসী জাতিগুলোকে বলা হয়েছে ‘ম্লেচ্ছ’, ভাগবত পুরাণে কিয়াত, হূণ, অন্দ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, আভীর, যবন, খস। বৌধায়নের ধর্মসূত্রে বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) অঞ্চলের লোকদের বলা হয়েছে ‘সংকীর্ণ যোনয়ঃ’, এরা একেবারে আর্য সংস্কৃতির বাইরে। এই জনপদে কেউ স্বল্পকালের জন্য গেলেও ফিরে এসে তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এর মানে পরিষ্কার। বৈধায়নের কালে যদিও বাংলায় ব্রাহ্মণ্য প্রভাব ছড়াতে শুরু করেছে, তখনো ঘৃণার ধারাটা থেকে গেছে বাংলার প্রতি।
বাংলার প্রতি ঘৃণা ছিল বটে। কিন্তু তাকে অধিকার করার প্রয়াস ছিল অব্যাহত। শেষ অবধি রাজনৈতিক প্রচেষ্টার চেয়ে সাংস্কৃতিক প্রয়াসে জোর দেয়া হয়। সমন্বয়ের পথ ধরে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রবেশ করে। সেটা ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫ অব্দে। এই সময় মৌর্য ও শুঙ্গযুগের আর্যীকরণের ধারা শক্তিশালী হয়। এটা ছিল প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপটি সম্পন্ন হয় ৩১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে, গুপ্তযুগে। এর মাধ্যমে বাংলার সাংস্কৃতিক সীমানা পরিবর্তিত হতে থাকল। বাংলায় জায়গা করে নিলো বৈদিক সংস্কৃতি। কিন্তু তাও নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। সমাজে বৌদ্ধ প্রভাব জারি থেকেছে, রাষ্ট্রেও সে প্রত্যাবর্তন করেছে। দেবভাষা হিসেবে আরোপিত বৈদিক আধিপত্যকে জনগণ কবুল করেনি। প্রাকৃতের ভেতর থেকে আবিষ্কার করেছে বাংলা ভাষা।
শশাঙ্কের (৬০০-৬২৫ খ্রি:) মৃত্যুর পর আনুমানিক ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এক শতক কালেরও বেশি সময় ধরে চলেছে নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচার, আইনহীনতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ছোট ছোট রাজ্যে অনবরত বিভক্তি। যা বাংলার জীবনকে তীব্র মোচড় দেয়। যার ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করে পাল রাজবংশ। পাল আমলেও সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত সমাজের ভেতরতলে ছিল বিদ্যমান। সঙ্ঘাত ও সমন্বয় চলছিল নানা খাতে। রাষ্ট্র বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাবকেও এড়াতে পারছিল না।
অবশেষে সেন আমল ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে রাষ্ট্রকাঠামোতে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু সামাজিক সঙ্ঘাত অবসিত হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়ন গণজীবনকে বিষিয়ে তোলে অবিরত। এর বিবরণী আছে রামাই পণ্ডিতের চম্পুকাব্য শূন্যপুরাণে। এতে জাজপুরের ১৬০০ বৈদিক ব্রাহ্মণের নির্মমতা ও সমাজজীবনে ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক চিত্রিত হয়েছে।
এ সময়ে বাঙালি হিন্দু কবিরা বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে তখন কবিতা লিখছেন সংস্কৃতে। জয়দেব (১১৭৮-১২০৬) লিখেছিলেন গীতগোবিন্দ। বৌদ্ধ, জৈন ও প্রকৃতি ধর্মের অনুসারীদের ওপর বয়ে যায় নিপীড়ন। রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা বৌদ্ধ ও জৈনদের একটা অংশকে পিষ্ট করে ভয়াবহভাবে। জীবনকে জারি রাখতে তারা স্বীকার করে নেন শ্রেণীবহির্ভূত অবস্থান। বিভিন্ন সহজিয়া ধর্মের আশ্রয়ে তারা বেঁচে থাকতেন।
কিন্তু বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দুরাই এখানকার অধিবাসীরা ছিল না, আদিবাসী ও কোমসমূহের অনুসারীরা ছিলেন বড় সংখ্যায়। বস্তুত কোমসমূহের ধর্মের অনুসারীরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা অস্ট্রিক, নর্ডিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলয়েড ইত্যাদি রক্তধারা বহন করছিল। এদের মধ্যে বিশেষ অর্থে তারা ছিল দ্রাবিড়। বাঙালির দেহ, ভাষা ও সংস্কৃতির গঠনে যাদের ভূমিকা ও উত্তরাধিকার প্রখর ও প্রবল। তারা একদা টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় জীবন কাটাত। সাগরতীর ও নদী অববাহিকাকে বাসস্থান হিসেবে বেছে নিত। তাদের যে অংশটা গঙ্গা-মেঘনা বেসিনে এলো, তাদের জীবনীশক্তি ও সৃষ্টিশীলতা ছিল প্রচণ্ড। গঙ্গারিডি এরই প্রমাণ বহন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে যার শক্তিমত্তার কাছে হার মেনেছিল আলেকজান্ডারের বঙ্গজয়ের অভিলাষ। বৈদিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের লড়াকু মেজাজ ও ঐতিহ্য ছিল গরীয়ান।
হিউয়েন সাঙের বিবরণের ইশারা হলো, তার সময়ে এই ভূমিতে কমপক্ষে অর্ধেকের মতো মানুষ ছিল আদিবাসী, গ্রামীণ কোম ধর্মের। এই ধর্মের কোনো সংহত অবয়ব ছিল না। চাষাবাদের সাথে যুক্ত করে নানা দেব-দেবীর উপাসনা তারা করতেন। তাদের ছিল স্বতন্ত্র গ্রামদেবতাও। জনপদসীমার বাইরে থান বা স্থান নামের গ্রামভিত্তিক দেবতাদের জন্য একটা জায়গা নির্ধারিত থাকত। তার উদ্দেশে পশু-পাখি ইত্যাদি বলি দেয়া হতো। তার প্রতি ভয় ও ভক্তি প্রচলিত ছিল। খুব সম্ভবত কালের ব্যবধানে তারা নিজেদের পুরনো সংহত ধর্ম হারিয়ে ফেলে নিজেদের চারপাশের প্রকৃতির ভেতরে ধর্মকে সন্ধান করছিলেন।
ব্রাহ্মণ্য বিধানে গ্রাম্য দেবতার পূজা নিষিদ্ধ; মনু তো বারবার এই সব দেবতার পূজারিদের ধ্বংসের বার্তা শুনিয়েছেন। কিন্তু কোনো বিধান, কোনো বিধিনিষেধই গ্রামদেবতার পূজা বন্ধ করতে পারেনি। বরং বাংলার প্রাচীন এই লোকজ ধর্মের শীতলা, মনসা, বনদুর্গা, ষষ্ঠী, নানা প্রকারের চণ্ডী, নরমুণ্ডমালিনী শ্মশানচারী কালী, শ্মশানচারী শিব, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতি অনার্য গ্রাম্য দেবদেবীরা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মকর্মে আধিপত্য বিস্তার করেন।
রথযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি ছিল লোকজ ধর্মানুসারীদের কাছে পবিত্র। তাদের প্রধান দেবতা ছিল শিব ও ধর্মঠাকুর। বাংলার জনসমাজে এই ধর্ম কোনো একক প্রক্রিয়া নিয়ে দাঁড়ায়নি। বিচিত্র ছিল তার ধারা ও ধরন। মূলত প্রকৃতিপূজা ছিল এর কেন্দ্রীয় প্রবণতা। তুলসী গাছ, সেওড়া গাছ, বট গাছ, পাথর, পাহাড়, ফল, ফুল, পশু, পাখি, বিশেষ জায়গা ইত্যাদির প্রতি দেবত্ব আরোপ করা হতো। এসব বিষয় অধিগ্রহণ করে হিন্দুসমাজ। এর মাধ্যমে বাংলার জনজীবনে প্রবেশের পথ প্রসারিত করে। লোকজ কোম ধর্মাবলম্বীদের বাইরে জনগোষ্ঠীর বড় অংশ ছিল বৌদ্ধ। আর ছিল জৈন ও হিন্দু। এই যে বহু বিশ্বাস ও বহু সংস্কৃতিলগ্ন জীবন, তা বিপণœতার শেষ সীমানায় ধাবিত হচ্ছিল। কিন্তু পরাজয় কবুল করছিল না।
ইতিহাসের এই যে ধারা, তার গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে বাঙালির বিকাশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিপত্তির হাতে নিপীড়িত-সুবিধাবঞ্চিত পদকর্তাদের সংগ্রামের ভেতর থেকে বাঙালির জীবন ও অনুভবের চিত্র রচনা করেছে। চর্যাপদের রচনাকালের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তা রচিত হয়। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, শতক ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত হয় পদগুলো। ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে যখন প্রথম পদটি রচিত হচ্ছে, ততক্ষণে বাংলায় ইসলামের দাওয়াত চলে এসেছে।
লালমনিরহাট জেলায় ৬৯ হিজরি সনে নির্মিত যে মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে, সে প্রমাণ করে তখন সেখানে মসজিদ আবাদ করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম ছিলেন। তখন থেকেই মুসলিম সমাজ গঠিত হতে থাকে একটু একটু করে। এর মানে হলো বাংলা ভাষার প্রথম আত্মপ্রকাশের লগ্ন থেকে ইসলাম এই ভূমিতে বিকশিত হচ্ছে। বাঙালি হয়ে ওঠার প্রথম প্রহরের সাথে এখানে ইসলামের বিকাশের প্রথম প্রহরও গতিমান। এখানকার সমাজে ইসলামের স্থিতি লাভ খুব ধীরগতিতে হয়েছে। কিন্তু সামাজিক কোনো প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেনি। এই ভূমি কেন প্রতিরোধ ছাড়াই ইসলামকে জায়গা দিলো? এর কারণ বহুবিধ। একটা কারণ অবশ্যই আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। সে নতুন জীবনবাদকে কবুলের জন্য মঞ্চ তৈরি করে রেখেছিল।
কারণ দীর্ঘ সঙ্ঘাতে রক্তাক্ত ইতিহাস নতুন উত্তরণের চ্যানেল তালাশ করছিল।
ইসলাম যদি কোনো বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়ে আসত, তাহলে এই মঞ্চটা তার হতো না। ইসলাম যে জীবনবাণী নিয়ে হাজির হলো, তা ছিল সহজ-সরল। তার মধ্যে ছিল সহজাত মানব-আচারের প্রতি উদার দৃষ্টি। যাদেরকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে, যারা পতিত, লাঞ্ছিত, অস্বীকৃত, যারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে জীবনের বোঝা বহনের প্রাত্যহিক সংগ্রামে বাধ্য, যাদেরকে পদপিষ্ট করাকে ন্যায্য মনে করে ক্ষমতাবানরা, সেই মানুষদের আশ্রয়, আশা ও উদ্ধার হয়ে উঠল মুসলিম বিজয়। সেই মানুষগুলো এক জুলুম থেকে মুক্ত হয়ে আরেক জুলুমের ভয়ে ছিল না। এর ফলে বাংলার জীবন তার তিক্ত অতীতের প্রান্তর পেরিয়ে বাঙালি সত্তার বিকাশের ধাপগুলোতে ইসলামকে আলিঙ্গন করতে সম্মত হলো।
ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার প্রশ্নে বৌদ্ধ-হিন্দুদের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন স্থানীয় প্যাগানরা। যারা কোমভিত্তিক ধর্ম অনুসরণ করতেন। সেন আমলে বৌদ্ধদের সংখ্যা বড় অর্থে কমে। জৈনদের সংখ্যাও কমে। প্রাণের হানি প্রত্যহ তাদের পিছু ধাওয়া করছিল। কিন্তু তাতে হিন্দু জনসংখ্যা যে খুব বেড়ে গেল, তা বলা যাবে না। স্থানীয় ধর্মের অনুসারীরাই ছিল তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্থানীয় ভূমিপুত্রদের কোমভিত্তিক ধর্মের অনুসারীরা ধীরে ধীরে এত ব্যাপকভাবে মুসলমান হলেন, যার ফলে তাদের ধর্ম অনুসারীর অভাবে প্রায় হারিয়ে যেতে লাগল। ব্রিটিশ আমলের আদমশুমারিতে দেখা গেল মুসলিমদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি শাসনকেন্দ্র থেকে দূর-দূরান্তের গ্রামে। এসব গ্রামে মূলত ভূমিপুত্র প্যাগানরা থাকতেন। এদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন এই ভূমির আর্যপূর্ব অধিবাসী। বস্তুত বাঙালি জনগোষ্ঠীর রক্তধারার আদিসূত্র বহন করছিলেন প্রধানত এরাই।
বাংলার মুসলিমরা নি¤œবর্গীয় হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত, এই বক্তব্য সত্যকে কমই প্রকাশ করে। বাঙালি মুসলিমরা প্রধানত বাংলার ভূমিপুত্র কৌম-ধর্মের একদা অনুসারী। বাঙালির ইতিহাস আর্যদের ইতিহাস নয়, বরং তা তাদের আগে এই ভূমিতে সভ্যতা রোপণকারীদের অগ্রগতি ও বিবর্তনের ইতিহাস। ইসলাম এই গতিধারায় হাত ধরাধরি করে বাঙালির নবযুগ নিশ্চিত করেছে।
বাঙালির মননে ইসলামের চাষাবাদে ভূমিজ বাস্তবতাও কাজ করেছে কম-বেশি। বাংলার পশ্চিম অঞ্চলে অনাবাদি ও মৃতপ্রায় বহু দ্বীপে পীরদের সক্রিয়তা মুখর জনপদে রূপান্তরিত হয়। দক্ষিণবঙ্গে বিস্তৃত বহু জঙ্গল যোগাযোগ, জনবসতি, চাষাবাদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিণত হয় পীরদের নির্দেশনায়। সেখানে জনপদ নির্মাণ ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা সহজ ছিল না। এখানে প্রয়োজন ছিল নেতৃত্ব, দক্ষতা, জনজীবনে প্রভাবশালী অবস্থান আর পুঁজি। রিচার্ড ইটনের গবেষণা দেখিয়েছে এই নেতৃত্ব, প্রভাব ও সাংগঠনিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন পীর-দরবেশগণ। তাদের নেতৃত্বে দক্ষিণ এলাকার নবগঠিত ভূমিতে বহু জনপদ তৈরি হয়। কৃষক সম্প্রদায়ের নতুন উত্থান ঘটে। স্থানান্তরিত চাষিদের অগ্রগতি নতুন মাত্রা লাভ করে।
এমনতরো জনপদ গঠনে ইটন খান জাহান আলী রহ:-এর নজির হাজির করেন। সাবেক জঙ্গলকে ধান ক্ষেতে রূপান্তরিত করা, লবণজল বাইরে রাখার জন্য জমিতে ¯্রােত বরাবর বাঁধ দেয়া, বন পরিষ্কার, জল সরবরাহ এবং সংরক্ষণের জন্য ট্যাংক খনন, শ্রমিকদের জন্য কুঁড়েঘর তৈরি, বাঘ, জ্বর ও মহামারীর বিপদ মোকাবেলা ইত্যাদির পেছনে উদ্যোগ ও গাঠনিক যে সক্ষমতা, তার নজির শুধু খান জাহানে নয়, অন্য বহু পীর-মাশায়েখের জীবনে ছিল।
নদীভাঙন, গতিপথ পরিবর্তন, খরা, মহামারী, বন্যা ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির প্রেক্ষিতে জীবনের যে জটিলতা, হুমকি ও বিপন্নতা, সেখানে পীরদের আশ্রয়ী ভূমিকা জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল। নির্ভরতা দিয়েছিল। জীবন ও সম্পত্তির হানিতে পীরদের সান্ত¡নাদায়ী ভূমিকা ছিল। নতুন ব্যবস্থা, আয়োজন ও গোড়াপত্তনেও তারা সৃষ্টিশীল ছিলেন। নদীভাঙনে গৃহহীনদের আবাসন, অভিবাসন ইত্যাদিতেও তাদের ভূমিকা ছিল নিয়মিত। প্রভাবশালী পীরদের খানকা ও আস্তানায় আশ্রয়ী মানুষদের বিশাল সমাগম থাকত। লঙ্গরখানায় খাবার খেতেন হাজার হাজার মানুষ। লঙ্গরখানার মানুষেরা যেমন ছিলেন মুসলিম, তেমনি অমুসলিম।
এসব গঠন , বিকাশ ও ভূক্তিকর্মের কেন্দ্রে ছিল ঈমানবাহিত নীতিবোধ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গোত্র-বর্ণ, ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে সুফিরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের সেবাকর্মে সমাজনেতারা সহায়তা করতেন এবং এর পরিধি দেখে আন্দাজ করা যায়, সেবাকর্মের পরিসর কত প্রসারিত ছিল। বড়কাটরার পাশেই ছিল সুফি আস্তানা। বড়কাটরার স্থাপনায় প্রাপ্ত শিলালিপি জানায়, সেখানে গরিবদের প্রতিপালনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থাপনা ছিল। যারা সামর্থ্য রাখে না, তাদের সেখানে বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। সেখানকার বাইশটি দোকান বরাদ্দ ছিল কেবল গরিবদের প্রতিপালনের জন্য।
শিলালিপিটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে (সাজেন, ২০২০)।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলির ত্রিবেণীতে অবস্থিত জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগা থেকে সাতটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই শিলালিপিগুলোতে সুফি সাধক ও স্থপতি জাফর খান গাজীকে মানবতার খেদমতে নিয়োজিতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। মসজিদের মেহরাবে স্থাপিত একটি শিলালিপির আলোকে জাফরখান গাজী মসজিদটি ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করা হয় (নস্কর, ২০২১) । জাফর খান গাজীর সমাধি কক্ষে স্থাপিত আরেকটি শিলালিপি থেকে জানা যায় জাফর খান গাজী ত্রিবেণীতে দারুল খয়রাত নামে একটি মাদ্রাসাও নির্মাণ করেছিলেন। এ শিলালিপিতে তাকে সাতগাঁওর শাসনকর্তা হিসেবেও সম্বোধন করা হয়েছে। এমনতরো বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন সুফিদের খেদমতে খালক বা সৃষ্টিসেবার সাক্ষ্য হাজির করে।
সুফি-দরবেশগণের প্রভাবে এই ভূখণ্ডটি সুফি সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলোর জন্য একটি সমৃদ্ধ আবাসভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ফলে তৎকালে বাংলাদেশে ষোলোটি জেলার মধ্যে এগারটি জেলার নামকরণ করা হয়েছিল সুফি সাধকদের নামে। মেহেরপুর (দরবেশ মেহের আলির নামে) বাগের হাট (খান জাহান আলি রহ.-এর একটি বাগ বা বাগিচা ও এর সাথে যুক্ত হাট মিলিয়ে বাগেরহাট। কিংবা হজরত আঘা বাকের বা জায়গিদার বাকির খাঁ রহ:-এর নামে) জামালপুর (হজরত শাহ জামাল রহ:-এর নামে) শরীয়তপুর (হাজী শরীয়তুল্লাহ রহ:-এর নামে) মাদারীপুর (হজরত বদরুদ্দিন শাহ মাদার রহ:-এর নামে) মুন্সীগঞ্জ (ইদ্রাকপুর গ্রামের সুফি মুন্সী হায়দার হোসেন কিংবা সুফি ও জমিদার এনায়েত আলি মুন্সীর নামে), গাজীপুর (সুফি শাসক ফজল গাজী রহ:-এর নামে) ফরিদপুর (সুফি-সাধক শাহ শেখ ফরিদউদ্দিনের নামে) চাঁদপুর, (পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকির কিংবা সুফি শাহ আহমেদ চাঁদ এর নামে) হবিগঞ্জ (সুফি সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পুত্র সৈয়দ হবি উল্লাহ বা হবিবউল্লাহর নামে)। মৌলবীবাজার (মৌলবী কুদরত উল্লাহর নামে।) মুঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের নামে ঢাকার নাম জাহাঙ্গীরনগর ছিল, কিংবা সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ-এর নামে ময়মনসিংহ ছিল নাসিরাবাদ। এরা ছিলেন শাসক। কিন্তু সিলেটের ব্যাপারটা ভিন্ন। হযরত শাহজালাল রহ:-এর নামে সিলেট ছিল জালালাবাদ। এখানে আধ্যাত্মিক শাসনের প্রভাব কাজ করেছিল মূলত।
ঐতিহাসিক মোহর আলী উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি সুফি ইসলাম প্রচার ও প্রচার করেছেন। তারা ছিলেন জনগণের চোখে ইসলামী নৈতিকতা ও সততার প্রথম ও প্রত্যক্ষ নমুনা। তাদের উত্তরাধিকারসমূহ প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের মধ্যেও জনতার চিন্তা-চেতনা ও প্রেরণার মর্মে এখনো বহমান। এই প্রভাব এখানকার সমাজ-সভ্যতার বিকাশে সুফি ভূমিকার ব্যাপকতা, গভীরতা ও বৈচিত্র্যকে বয়ান করে। বাঙালি কেবল নিজেদের সংস্কৃতির বিকাশে সুফিঋণ স্বীকার করেনি বরং নিজেদের সভ্যতার পরিগঠনে ও সম্পন্নতায় তাদের দানের সুবিশাল পরিসরকে গৌণভাবে হলেও বরেণ্য রেখেছে।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা