ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব স্বৈরাচারের ফেরার পথ উন্মুক্ত করবে
- জিয়া আহমদ এনডিসি
- ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিন মাস অতিবাহিত করল সেদিন। এই সময়কালটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে একটি সরকারের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ডক্টর ইউনূসের সরকার তো শুধু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ক্ষমতাসীন হয়নি। তারা দেশে এমন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চান যার ফলে ভবিষ্যতে এই দেশে স্বৈরাচারের পুনরাবির্ভাবের পথ রুদ্ধ হবে। স্বৈরাচারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন গণবিরোধী বিধি-বিধান জারি, আইন প্রবর্তন, সর্বোপরি অপশাসনের মাধ্যমে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, ব্যাংক, নির্বাচন ব্যবস্থাপনাসহ দেশের সব ক’টি প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে, তাতে কোনো সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করা অসম্ভব। সে কারণে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এই ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কারের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসাবে অনুষ্ঠান করতে চান, যাতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
এই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যেই ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য দেশের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১০টি কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনগুলো এখন অংশীজনদের মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। গত ৮ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের গত তিন মাসের সাফল্য তুলে ধরেন, যেখানে তিনি অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো এবং বিশ্বের পরাশক্তিসহ ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর আমাদের দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে পাশে থাকার অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন। এখন পর্যন্ত তো সবই ভালো। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
কোটা ইস্যুতে ২০১৮ সালেও ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছিল, সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক আদেশবলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করে দেন। বিষয়টা সে সময় তিনি গোঁজামিল দিয়ে শেষ করেন। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। এবার ভারতকে ‘করিডোর’ ও মংলা বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার সময় জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার জন্য আদালতকে ব্যবহার করে সে কোটা বিলুপ্তির প্রশাসনিক আদেশ বাতিল করে দেয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই এতে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং একটি সমন্বয় পরিষদ গঠন করে দেশব্যাপী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়।
আন্দোলনের একপর্যায়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ‘আবু সাইদ’কে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে’ গুলি করে হত্যা করলে ছাত্রদের বিক্ষোভ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতেও শেখ হাসিনার রক্তের তৃষ্ণা মিটেনি, তার অনুগত বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাতেই থাকে। একেকটা ছাত্রের মৃত্যুর সাথে সাথে ছাত্রদের আন্দোলন আরো দুর্বার হয়ে ওঠে। পরপর হত্যার শিকার হন ওয়াসিম, মুগ্ধ, আয়মানসহ অসংখ্য ছাত্র ও জনতা। এ সময় মালিবাগ কুড়িল সড়কের দায়িত্ব নেয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, রায়েরবাজার এলাকায় বিক্ষোভ সমন্বয় ও অংশগ্রহণ করে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরকর্মী ছাত্র ও স্থানীয় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সেই পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজ ৯ দফা দাবিনামা পেশ করে, যার মধ্যে ছাত্র হত্যার বিচার ও সরকারের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি ছিল অন্যতম।
ছাত্রদের ওপর এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে দেশের জনগণ আর ঘরে থাকতে পারেনি। তারা দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে রাজপথে নেমে আসে। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা প্রথমে, তারপর আপামর জনগণ। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের ৯ দফা দেশের সর্বস্তরের মানুষের ১ দফা দাবিতে পরিণত হয়, যা ছিল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আগস্টের ৪ তারিখে হাসিনা সরকার শেষ চেষ্টা হিসাবে সর্বশক্তি দিয়ে মিরপুর-১০ গোলচক্কর দখলে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সারা ঢাকার স্বৈরাচারবিরোধী মানুষের সামনে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। মিরপুর দখলমুক্ত হয়। অপর দিকে মালিবাগ ও যাত্রাবাড়ীতে ভারত থেকে ভাড়াটে সৈন্য এনে গণহত্যা চালালেও, তারা স্থানীয় ছাত্র-জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ছাত্র সমন্বয়কদের তরফ থেকে ৫ আগস্ট ঢাকা মার্চের ঘোষণা দেয়া হয়। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশে হাসিনা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।
হাসিনার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সমন্বয়কেরা পাদপ্রদীপের আলোর সামনে আসে। তারা ডক্টর আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ডক্টর ইউনূসের সাথে যোগাযোগ করে এবং তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে সম্মত হন। এরপর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই সরকারে আসিফ নজরুল ও দু’জন ছাত্র সমন্বয়ক উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে চলেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল দুটোও এই সরকারের সফলতা চাইছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বলেছেন যে তারা কোনোভাবেই এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবেন না, যে কারণে বিএনপির একটি বৃহৎ অংশ দ্রুত নির্বাচন চাইলেও তিনি এই সরকারকে সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ছাত্র সমন্বয়কদের একটা অংশ এই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানকে তাদের কৃতিত্ব হিসেবে বেশি জাহির করতে চায়। তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিদ্রƒপ করেছে। প্রায় এক মাস নীরবতার পর বিএনপি নেতৃত্ব এই গণ-অভ্যুত্থানে তাদের দলের শহীদ কর্মীদের তালিকা ও সংখ্যা প্রকাশ করার মাধ্যমে এটি যে একটি গণ-আন্দোলন ছিল তার প্রমাণ দেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কখনোই এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এমনকি যখন গণ-অভ্যুত্থান সফলতা লাভ করে, তখনো তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। তিনি দেশে আসার পর তাকে যারা ব্রিফ করেছে, তারা হয়তো নিজেরাই সমন্বয়ক বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ছাত্রদেরকে তিনি তার ‘নিয়োগকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি এমনকি আমেরিকায় যেয়ে একজন সমন্বয়ককে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু বাস্তবতাটা হলো এই আন্দোলন কোনো পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। বরং এটি মাঠের আন্দোলনকারীদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এগিয়েছে। এর মধ্যে এই ছাত্র সমন্বয়কদের ভূমিকাটি ছিল দেশের অন্যান্য স্থানের সমন্বয়কদের সাথে আলাপ করে মাঠের অবস্থা বিবেচনায় এনে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা। অবশ্যই এটি একটি বিশাল কাজ, কারণ এই নির্দেশনা অনুযায়ীই পরবর্তী দিনের আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই সমন্বয়কেরা এক দিকে ‘শাহবাগ অন্য দিকে শহীদ মিনার’ অঞ্চলের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সরকারের নিপীড়ক বাহিনীর কারণে। আর তখন ঢাকার মাঠের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসার ছাত্র ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
আমাদের সমন্বয়কদের মধ্যেও এই বিষয়টা লক্ষ করা যায়। প্রথমে আন্দোলনের শুরুতে ৬৫ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয়ক পরিষদ গঠন করা হয়েছিল; পরবর্তীতে আন্দোলনের মূল সমন্বয়কদের গ্রেফতার ও সরকারি দমন-নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমন্বয় পরিষদের কলেবর বৃদ্ধি করে ১৫৮ জনের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির পর সমন্বয়কদের একটা বড় অংশ পড়াশোনায় ফিরে গেছে (বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের একটা অংশ পদত্যাগ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হলে স্বৈরাচার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। হাসান মাহমুদের মিডিয়া সাক্ষাৎকার, স্বৈরাচারী হাসিনার টেলিফোনের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ প্রচেষ্টা ভালো লক্ষণ নয়।
সমন্বয়কেরা রাজনীতি করতেই পারেন। সেটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি পরিহার করার লক্ষ্যে তাদের রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতিতে আসা উচিত। তারা একটি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’র কথা বলছেন, যা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরাও প্রয়োজন।
যারা এই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কাছে জনগণ আত্মম্ভরিতা প্রত্যাশা করে না। তারা যদি প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে ব্যর্থ হন তাহলে শুধু তাদের নয়, দেশের জনগণেরও ভোগান্তির শেষ থাকবে না। এ কথা শুধু ছাত্র নেতৃত্ব নয়, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। আর সরকারেরও কাজ হবে এই সমন্বয়কদের আবেগ ও দেশপ্রেমকে কাজে লাগানোর। সরকারে উপদেষ্টা হিসাবে যে তিনজন সমন্বয়ক কাজ করছেন, তারা চমৎকারভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো এখনো স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের চারণভূমি হয়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই দূতাবাসগুলোতে সমন্বয়কদের নিয়োগ করলে তারা দেশবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব কূটনীতির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারবেন, যা গত ১৭ বছরে পেশাদার কূটনীতিকেরা করতে সক্ষম হন নাই। ডক্টর ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে। এ সময়ে এ ধরনের নিয়োগ দেশের কূটনীতির চেহারাই বদলে দিতে পারে এবং তা দেশের জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা