৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের পথচলা

-

স্বৈরাচার পতনে দেশের জনগণের মধ্যে যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য প্রয়োজন, মৃত্যুভয় জয়ের যে মানসিকতা জরুরি; তা একদিনে হয় না। অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে, আহত ও গুমের শিকার এবং তার স্বজনদের আহাজারির পর আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে চব্বিশের দ্বিতীয় এ স্বাধীনতা পেয়েছি।
২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার ফাহাদকে হত্যার পর স্বৈরাচার পতনের মূল ভিত্তি তৈরি হলেও এর কাজ শুরু হয় আরো আগে। প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণ স্বৈরাচার কর্তৃক যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছিল, সবারই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে শাপলা চত্বর প্রতিটি ঘটনায় মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল, যে আগুনের বিস্ফোরণ ঘটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরপর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অন্যান্য ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত ছাত্রলীগের এমন নির্মমতা চললেও বুয়েটই প্রথম শিক্ষার্থীরা এই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বুয়েটের সব শিক্ষার্থী এক হয়ে ক্যাম্পাস থেকে আমরা ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করি। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরপরই দেশের ছাত্র-জনতা জেগে ওঠে। যার ফলাফল হিসেবে দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য পূর্বের চেয়ে অনেকটা কমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে, যা স্বৈরাচারের জন্য একটা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা যায়।
২০১৩ সালে বুয়েটের স্বৈরাচারী ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর থেকেই বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াবহ যুগ। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে বুয়েট ছেড়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। তাদের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়ে হাত-পা ভেঙেছে, হসপিটালাইজড হয়েছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বেশি। অনেক ঘটনা এখনো আমাদের সামনে প্রকাশিতই হয়নি। প্রক্সি এক্সাম, তাদের মতের সাথে না মিললেই যে কাউকে ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন, ক্যান্টিনে বিনামূল্যে খাওয়া, মেস ম্যানেজার হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের টাকা মেরে বাইক কেনাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি। এসব পাপের ফলাফল হিসেবেই ২০১৯ সালে অবশেষে বুয়েটে ছাত্রলীগের পতন হয়।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ এরপর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে চেষ্টা করলেও বুয়েটে ছাত্রলীগকে আর ফেরাতে পারেনি। তারা প্রথমে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ২০২২ সালের ১৩ আগস্ট রাতের আঁধারে ‘বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ’ ব্যানারে বুয়েট অডিটোরিয়ামে সভা করার মাধ্যমে। কিন্তু তা জানতে পেরে সাথে সাথেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শেষ পর্যন্ত পালাতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারের দোসররা। কিন্তু পরের দুই দিন ঢাবি থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বুয়েটে এসে শোডাউন দিয়ে যায় এবং দেশব্যাপী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বুয়েট শিক্ষার্থীদের হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এরপর ২০২৩ এর ১৩ জুলাই আরেক ধাপ এগিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুয়েটের দুইজন শিক্ষার্থীকে পদ দেয়া হয়। যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আবারো আন্দোলন গড়ে তুলে। এভাবে বারবার ব্যর্থ হয়ে তারা একটি ইস্যু তৈরির চেষ্টা করে যায়। যার অংশ হিসেবে ঘটে ৩০ জুলাই এর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনা।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে অনেকেই ২০১৯ থেকে ঘটনার আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বুয়েট ক্যাম্পাসকে রক্ষা করতে সবসময়ই সামনের সারিতে ছিল। এদেরকে চাপে রাখা এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিবির জুজুর ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পাসে আবার ফিরে আসা ছিল লীগের মূল পরিকল্পনা।
কিন্তু সারা দেশের বিভিন্ন মহলের চাপে আমাদের দ্রুত জামিন দিতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বুয়েটের যেকোনো ইস্যুতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনা টেনে এনে কাভার দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এই বাধাও উতরে যায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। এরপর ফাইনাল স্টেপ হিসেবে আসে জঙ্গি নাটক। ২০২৪ এর এপ্রিল-মে তে জঙ্গি নাটকের অংশ হিসেবে হাওরে আটককৃতদের একটা অংশ এবং অন্যান্য কিছু শিক্ষার্থীকে জঙ্গি বলে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়, বুয়েট শিবির নাম দিয়ে ভুয়া লিস্ট তৈরি করে মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়। বুয়েট কেন্দ্রিক এসব প্রোপাগান্ডার মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করে বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি ও আওয়ামী গুজব সেল সিআরআই এর কো-অর্ডিনেটর তন্ময় আহমেদ। এসবের পরেও বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। কিন্তু ধরেই নেয়া হয়েছিল এই প্রতিরোধ আর বেশি দিন হয়তো করা সম্ভব হবে না। এর মধ্যেই শুরু হয়ে যায় কোটা আন্দোলন, যার শেষ হয় স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে।
২০১৯-এর শহীদ আবরার ফাহাদ থেকে আমরা যেই বারুদ পেয়েছিলাম তা জ্বলে উঠে ২০২৪-এর আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আবরার ফাহাদের শাহাদতের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছিলাম আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস, আর আবু সাঈদের শাহাদতের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম গুলির সামনে বুক পেতে দেয়ার সাহস। যেই সাহসের সামনে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ‘৩৬ জুলাই’ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় খুনি হাসিনা।
শহীদ আবরার ফাহাদের ত্যাগের মাধ্যমে বুয়েটিয়ানরা যে মাথা উঁচু করা শিখেছে তা আর স্বৈরাচারের কাছে নত করতে হয়নি। যারা বুয়েটে ছাত্রলীগকে ঢুকাতে চেয়েছিল ছাত্র-জনতা তাদের দেশ থেকেই বিতাড়িত করে দিয়েছে। এখন সময় আমাদের এই স্বাধীনতা রক্ষা করার। দেশ পুনর্গঠনে আমাদের সবাইকে এমন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, যেন আর কোনোদিনই কোনো স্বৈরাচারের কাছে, কোনো আগ্রাসনের সামনে আমাদের মাথা নত করতে না হয়।
লেখক : সাবেক বুয়েট শিক্ষার্থী


আরো সংবাদ



premium cement