রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ন ও নির্বাচনব্যবস্থা সরলীকরণ
- বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
- ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনের সময় থেকে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একাধিক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল- কী করে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভোটারদের সম্পৃক্ত করা যায়। তখনকার জাতীয় নির্বাচন-উত্তর সময়ে ও বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ শুরু করেছিলাম। ছোট করে একটি নির্বাচন গবেষণাগার ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপন করতে পেরেছিলাম। নিজের চিন্তাধারার প্রায়োগিক দিক বিবেচনা করে ময়মনসিংহের সদর থানার দাপুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তা ছাড়া ভোটারদের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল। আমি ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেহেতু আমার সচিবালয়ের অনেকের মতে, আমাকে ভয় করে নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে শেষ করেছিলেন। সেই ব্যাপারটি সঠিক নয় প্রমাণে ঢাকা শহরসংলগ্ন টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনও একই প্রক্রিয়ায় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
এ দু’টি নির্বাচন বিশ্লেষণে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করেছিলাম, তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় ভোটারদের ওপর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিলে অবশ্যই তা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এ দুটো নির্বাচনের বিষয় বিশ্লেষণ করে ১৯৯৪ সালে তদানীন্তন সরকারপ্রধানের কাছে ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন ও স্থানীয় ভোটারদের ওপর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া, ভোটার রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি সম্পর্কে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
সরকারপ্রধানকে এ নিয়ে ঘণ্টা তিনেক ব্রিফিং করেছিলাম। তিনি উৎসাহের সাথে তা গ্রহণ করেছিলেন। তৎসম্পর্কিত একটি বাজেটও পেশ করেছিলাম। এর প্রেক্ষাপটে আমার প্রস্তাব অনুসারে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শিতায় নানা বাধার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত আমি স্বেচ্ছায় নির্বাচন কমিশন ছেড়ে কোর্টে চলে আসি। এখনো দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি, স্থানীয় ভোটারদের কাছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিলে অবশ্যই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণের বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারা বহাল রাখা সম্ভব হবে না। নির্বাচনে যতদিন পর্যন্ত মনোনয়ন বাণিজ্য বজায় থাকবে ততদিন দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া অসম্ভব।
তৃণমূল পর্যায়ে ভোটাররা দলকে ভোট দেবে, মনোনীত প্রার্থীকে নয়। ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদের জন্য মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে দলগুলো। আনুপাতিক হারে ভোট প্রক্রিয়ায় এবং এ দেশের অতীত অভিজ্ঞতায় সাধারণভাবে একটি প্রশ্ন জাগে, এলাকাভিত্তিক সংসদ সদস্য মনোনীত হওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে কি না? এ প্রক্রিয়ায় যেহেতু সংসদ নির্বাচনের কোনো এলাকা থাকবে না, সারা দেশজুড়ে একটি নির্বাচনী এলাকা। কাজেই সংসদে দলের পক্ষে যারা সদস্য হবেন তাদের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থাকবে না। তবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওইরূপ সদস্যকে কোনো এলাকাভিত্তিক কার্যক্রমে দায়িত্ব দিতে পারবে। এটি দলের নিজস্ব ব্যাপার।
ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানের কমপক্ষে ৯০ দিন আগে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো প্রাথমিক সদস্যদের ভোটে মেধাক্রম অনুসারে একটি সদস্য তালিকা তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করবে। নির্বাচন কমিশন ওই ৯০ দিনের মধ্যে তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করে তা সংরক্ষণ করবে। নির্বাচনে ওই দল যে কয়টি আসন পাওয়ার অধিকারী হবে, ওই তালিকা থেকে ক্রমানুযায়ী দলের পক্ষে সংসদে উপস্থিত থেকে সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। প্রয়োজনবোধে দলীয় স্বার্থে বছরে ওই সদস্যদের ৫ শতাংশ পরিবর্তন করতে পারবে।
আনুপাতিক হারে ভোটপ্রক্রিয়া পরিচালনা ও তার ফলের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ গড়নে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। সেহেতু বিষয়টি সাধারণের বোধগম্য করতে নিম্নোক্ত উদাহরণ উপস্থাপন করছি-
ধরে নেয়া যাক, নির্বাচনে ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৯ কোটি ভোট দিয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ পার্লামেন্টে ৩০০টি আসনের ব্যবস্থা রয়েছে সেহেতু ৩০০ দিয়ে ৯ কোটিকে ভাগ দিলে (৯,০০,০০,০০০+৩০০=৩,০০,০০০) প্রতি সংসদ সদস্যের জন্য তিন লাখ ভোটের প্রয়োজন। ধরে নেয়া যাক, ১৫টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে যারা প্রাথমিক ভোট গণনায় যা ভোট পাবে প্রতি তিন লাখ ভোটের জন্য একজন করে সদস্য সংসদে পাঠানোর অধিকারী হবে।
অনূর্ধ্ব ৫০০ ভোটারের জন্য একটি করে স্থায়ী ভোটকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেটি অবশ্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দেখাশোনা করবে। ওটি হবে গণতন্ত্রের বিকাশকেন্দ্র। গণতন্ত্র চর্চা-সংক্রান্ত বিষয়াদির ওপর একটি গ্রন্থাগারও থাকবে। স্থানীয় শিক্ষিতসমাজ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের ওপর গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা ও প্রয়োজনে পাঠ দানের নির্দেশনা থাকবে।
স্থানীয় বিষয়াদি যথা- দেন-দরবার, সালিস, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, ধর্মীয় কার্যাদি সব কিছু সেখানে চলবে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনকি একটি ন্যায্যমূল্যের দোকান এখান থেকে পরিচালিত হতে পারে। স্থানীয় ভোটাররা ওই দোকানের অংশীদার হবে। একই সাথে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তিন শূন্য (শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দরিদ্রতা) প্রতিপাদ্যটিও কার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি পাড়ায়-মহল্লায় একটি করে ভোটার ক্লাব থাকবে, জাতি ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে ওই অঞ্চলের সব ভোটার তার সদস্য। তবে ১১ সদস্য (ছয় জন পুরুষ ও পাঁচ জন মহিলা) বিশিষ্ট ওই ক্লাবে নির্বাহী কমিটিতে যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নন তারা থাকবেন। ওই নির্বাহী কমিটির সদস্যরা এক উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট পরিচালনার দায়িত্ব নেবে এবং তারাই অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ওই ভোটকেন্দ্রের যৎসামান্য ব্যয় জোগানের ব্যবস্থা করবে। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষিত বয়স্ক ভোটাররা মুরুব্বি হিসেবে কাজ করবেন। সকাল ৮টা থেকে ১২টার ভেতর ভোটগ্রহণ শেষ করতে হবে। বেলা ২টার মধ্যে অনলাইনে নির্বাচনের ফলাফল নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ভোট না দেয়ার জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে, পৌরসভা ও পৌর করপোরেশনের ওয়ার্ডে একজন সহকারী নির্বাচনী কর্মকর্তা ও তার অফিস থাকবে।
আমার সময় আমি প্রতি উপজেলাতে উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও অফিসের ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছিলাম। জেলা পর্যায়ে তো জেলা নির্বাচন অফিসার আগে থেকেই রয়েছেন। বিভাগীয় পর্যায়েও ডেপুটি নির্বাচন কমিশনারের অফিস রয়েছে। কাজেই মূলত তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত তৃতীয় কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির কোনো প্রভাব থাকবে না বা রাখা যাবে না।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধকরণ ও তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা : আনুপাতিক হারের নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধকরণ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে চলিত রাজনৈতিক দলগুলোর পুনঃনিবন্ধন করাতে হবে। প্রত্যেক দলের জন্য মোট ভোটারের অন্ততপক্ষে ১ শতাংশ রেজিস্টার ভোটারদের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে এবং তা কমপক্ষে বা সর্বনিম্ন ১০টি প্রশাসনিক জেলায় তাদের সদস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে হবে।
এ দেশের রাজনৈতিক দল সংগঠন ও পরিচালনায় সঙ্গতকারণেই অর্থসঙ্কট রয়েছে। সে জন্যই নেতানেত্রীরা যেকোনো মূল্যে অর্থ সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে করে তাদের আসল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারে না। সেই সুযোগে কুচিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিরা সুযোগ বুঝে অর্থ দেয়ার বিনিময়েও দলে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে নেয়। শেষ পর্যন্ত ওই রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক চরিত্র নষ্ট হয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের একই অবস্থা। ভবিষ্যতে যেন কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থ সংগ্রহ করতে এমন প্রক্রিয়ায় পরতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আনুপাতিক হারের প্রথম নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক দল মোট প্রদেয় ভোটের ২.৫ শতাংশ ভোট পাবে এগুলোকে পরবর্তীতে অন্যান্য আইনের দৃষ্টিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে মনোনীত করা যাবে। তাদের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাষ্ট্রের রেভিনিও বাজেট থেকে অর্থায়ন করা হবে। যাতে করে রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যায়নিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে। অবশ্য তাদের প্রাথমিক সদস্যের সংখ্যানুযায়ী আনুপাতিক হারে অর্থায়নের ব্যবস্থা রাখা যাবে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন করতে গেলে সারা দেশকে ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করার প্রয়োজন থাকবে না। সারা বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী এলাকা হিসেবে চলে আসবে, তৎসংক্রান্ত মামলা-মোকাদ্দমা, অনুযোগ-অভিযোগের সুযোগ থাকবে না।
ভোট গ্রহণের দিন সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচনী কর্মকর্তার অনুমতিক্রমে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো ভোটার, যেকোনো কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবে। সব প্রবাসী ভোটারও অনায়াসে ওই সব দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসে অতি সহজে ভোট দিতে পারবেন। উল্লিখিত পরিবর্তনকে নির্বাচন সরলীকরণ প্রক্রিয়া বলা চলে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন নির্বাচনী আইনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ছয় ধরনের নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে : ১. ইউনিয়ন পরিষদ; ২. পৌরসভা; ৩. পৌর করপোরেশন; ৪. উপজেলা পরিষদ; ৫. জেলা পরিষদ ও ৬. সংসদ নির্বাচন। আনুপাতিক হারের একটি নির্বাচন দিয়েই সব নির্বাচনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়া সম্ভব। এতে করে অর্থ ও সময়, শক্তি বাঁচিয়ে অন্য উন্নয়নের খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া বর্তমানে প্রচলিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকেও সংসদ সদস্যদের দ্বারা সর্বজনীনভাবে উন্নীত করা যেতে পারে। তাতে করে কোনো রাজনৈতিক দলকেই নিজেদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে না হয়। অর্থাৎ নির্বাচনকে একটি সর্বজনীন রূপ দেয়া যেতে পারে।
বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা করতে নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ বেগ পেতে হয়, যেমন- নমিনেশন প্রথার জন্য বিভিন্ন সমস্যা তো আছেই, এই নমিনেশন যাচাই-বাছাই অনেক ক্ষেত্রে আপিল-নিষ্পত্তি ইত্যাদির জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যালট পেপার ছাপাতে নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় পড়তে হয়। আর আনুপাতিক হারে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের দুই এক বছর আগেই প্রয়োজনীয় ব্যালট পেপার ছাপিয়ে রাখা যাবে। তাতে করে প্রিন্টিংসহ অন্যান্য খরচাদির সাশ্রয় হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ দেশের মূল সমস্যা হচ্ছে একটি, সেটি হচ্ছে- সর্ব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধের দারুণ অভাব। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই ধাপে ধাপে এহেন অবক্ষয় হয়েছে। বর্তমান জনসংখ্যার বেশির ভাগই ১৯৭১ সালে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল। তাদের বয়স যখন ১৮ হয়েছিল তখন থেকেই স্বাভাবিক কারণেই মনে করতে শুরু করেছিল, বিশৃঙ্খলাটাই আসলে শৃঙ্খলা। ওই জনগোষ্ঠী বর্তমান সময়ে ৬০ ঊর্ধ্বে পৌঁছে গেছে। তারাই মূলত সর্বস্তরে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভেতর থেকে বিভিন্ন স্তরে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করছে, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প তথা অর্থনৈতিক সর্ব ক্ষেত্রেই তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশৃঙ্খলতাই অন্তর্নিহিতভাবে লালিত পালিত হয়ে এখন সর্বস্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ওই জনগোষ্ঠীর কাছে শৃঙ্খলাবোধের অবক্ষয় কোনোভাবেই ধরা পড়ছে না। আরো সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, জাতির বিবেক প্রায় বিলুপ্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এটিকে এইপর্যায় থেকে মুক্ত করে পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে সুকৌশলে তা চালিয়ে যেতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ, সংরক্ষণ ও ফলাফল অনলাইনের মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি অবশ্যই সম্ভব হবে।
এতে করে তৃণমূল পর্যায়ের ভোটার নির্বাচন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সংস্থা নির্বাচন কমিশন ও তাদের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকার হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। এমনকি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রেও বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটে যোগফলের হেরফের করার কোনো সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ শতভাগ নিরঙ্কুুশ স্বচ্ছতার মধ্যে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া, প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে। এতে করে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ব্যক্তিসত্তা ও আত্মবিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত রূপে গড়ে উঠতে থাকবে। একই সাথে যদি প্রতিটি ভোটকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে দেয়া যায় তাহলে ওই ক্ষুদ্র এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক, লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে থাকবে। তাতে করে সবার মনের অলক্ষ্যে এমন একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকবে, যা এখন মানুষ কল্পনাও করতে পারছে না। আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি, আনুপাতিক হারের নির্বাচন প্রবর্তনের ফলে সবার মধ্যে সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির আত্মবিশ্বাস অবশ্যই গড়ে উঠবে। অন্যথায়, পুনঃ পুনঃ স্বৈরশাসকদের আগমন ঘটতেই থাকবে।
গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মীদের কথাবার্তায় আচার-আচরণে এটি স্পষ্ট যে, তারা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে অস্থির হয়ে উঠেছে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত কয়েক যুগ ধরেই রাজনৈতিক কর্মীরা দল বা নেতা-নেত্রীদের কেন্দ্র করে ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে সময়ে-অসময়ে চাঁদা তুলতে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এটি অনেকটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে, এমনকি এটিকে মুখ্য কর্মকাণ্ড হিসেবেও গণ্য করছে। এটিই রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। এই চাঁদা তোলার সংস্কৃতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটি শুনে অবাক লাগে যে, একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার এলাকা সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করে চলেছে যে, তার এলাকায় এমনকি কোনো পান-বিড়ির দোকান দিলেও ওই দোকান থেকে পয়সা দিয়ে তাকে পান-বিড়ি কিনে খেতে হবে, এটি হতে পারে না। তার রাজনৈতিক অবস্থানে তাকে বিনা পয়সায় পান-বিড়ি খাইয়েই তাকে সেখানে দোকানদারি করতে হবে। কি অদ্ভুত মনোবৃত্তি জেগে উঠেছে। যত দিন এমন প্রকার মনোবৃত্তি থাকবে তত দিন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়।
* তা ছাড়া এটিও দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাদের লালিত-পালিত সন্ত্রাসীদের বলে দেয়, ‘চরে খাও আমরা দেখেও না দেখার ভান করব তবে প্রয়োজনে ডাক দিলে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে অবশ্যই হাজির হতে হবে। অন্যথায় ধরে ধরে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে।’ এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও তাদের নিজ নিজ দলে গণতন্ত্র চর্চার কার্যক্রম শুরু করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে হবে। সেটি হচ্ছে :
রাজনৈতিক দল নিবন্ধকরণ আইনটি পরিবর্তন করে তদস্থলে নতুন পরিস্থিতি চিন্তা রেখে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথা-
১. নতুন-পুরনো সব দলকেই রেজিস্টার ভোটারদেরকে তাদের দলের প্রাথমিক সদস্যভুক্ত করতে হবে।
২. যেহেতু আনুপাতিক হারের নির্বাচনে ভোটাররা দলকে ভোট দেবে দলীয় প্রার্থীকে নয়, সেহেতু প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই অন্যূন দেশের সর্বমোট ভোটারদের ১ শতাংশ ভোটারকে তাদের প্রাথমিক সদস্য তালিকায় আনতে হবে। ওই সংখ্যক ভোটার সংখ্যা অন্যূন ১০টি প্রাশাসনিক জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে।
৩. কোনো রেজিস্টার ভোটার একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবে না। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওইরূপ সদস্য হয়ে যায় তাহলে তাকে অন্যূন ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে ও তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল বলে গণ্য হবে।
৪. রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা প্রাথমিক সদস্যদের তালিকার ডাটাবেজ তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সারা বছরব্যাপী তা যাচাই-বাছাই করবে। নির্বাচন কমিশন দলগুলোর ওই প্রাথমিক সদস্যদের যাচাই-বাছাই করে সংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় ফান্ড থেকে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় খরচ জোগান দেবে। অবশ্য প্রতি দুই মাস অন্তর আগের কর্মকাণ্ড যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী অর্থ ছাড় দিতে পারবে। ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার করে বলা চলে- ধরে নেয়া যাক সারা দেশে ভোটার সংখ্যা এ বছরে ১২ কোটি রয়েছে, ওই ভোটারের ১ শতাংশ অর্থাৎ অন্যূন ১২ লাখ রেজিস্টার ভোটার অবশ্যই ওই দলের প্রাথমিক সদস্য হতে হবে। প্রতি রেজিস্টার সদস্যের জন্য প্রতি বছর ২০ টাকা ব্যয়ভার হিসাব করলে ওই দলটি সারা বছরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য সরকারি বাজেট থেকে দুই মাসিক কিস্তিতে মোট দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে পেতে পারে। তবে বাজেটে অর্থায়নের কমবেশি হতে পারে। যাক তাতে করে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের চাঁদা তোলার সংস্কৃতি বন্ধ হতে বাধ্য।
৫. কোনো প্রাথমিক সদস্য দল পরিবর্তন করলে তা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে।
৬. সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরাও দেশের নাগরিক হিসেবে যেকোনো রাজনৈতিক দলে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবে। কারণ এটি তাদের নাগরিক অধিকার, কোনো অবস্থাতেই এটি খর্ব করা যাবে না। তবে চাকরিরত অবস্থায় দলের কোনো পদে থাকতে পারবে না।
৭. কোনো রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে নিজ দলকে আর্থিক অনুদান দিতে পারবেন এবং ওইরূপ অনুদান অর্থের টেক্স রিবেটও পাবেন।
লেখক : সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (আপিল বিভাগ)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা