তরুণরাই ভবিষ্যৎ, জাতির রাহবার
- খন্দকার হাসনাত করিম
- ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
কী এক অবাক তারুণ্য বিস্ফোরিত হয়েছে তাদের পড়ার ঘরে, ক্যাম্পাসে, ক্লাসরুমে, আড্ডায়! এ তারুণ্যকে আমরা বুঝতেই পারিনি! অনুমানও করতে পারিনি তাদের দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ, মানবিকতা এবং সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি তাদের এমন দৃঢ় অঙ্গীকার। স্বৈরাচারের গুলির সামনে বুক পেতে দিতে শিখল কী করে? শহীদ আবু সাঈদ তাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলো। দেড় থেকে দুই হাজার আবু সাঈদ দেশের জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, বঞ্চনা-বৈষম্যের স্বৈরনীতি অবসানের জন্য অকাতরে শাহাদাতবরণ করে দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করে দিয়ে গেল। তারা দেখে যেতে পারল না তাদের সাহস এবং প্রতিবাদের মুখে ৫২ বছরে বাংলাদেশের বুকে চেপে বসা আধিপত্যবাদী ভারতের আগ্রাসন এবং স্বৈরাচার কবরস্থ হয়েছে, তাদের জাগরণে অনুপ্রাণিত হয়েছে সুদূর পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা, স্বাধীনতার জন্য পথে নেমেছে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ এবং বিশ্বব্যাপী জেনারেশন-জেড লাভ করেছে নতুন বার্তা, সংস্কারের এবং নতুন বিশ্ব গঠনের।
সরকারি চাকরির কোটাবৈষম্য মোচন করতে নেমে তারা রাজপথের সংগ্রামে একাকার করে দিয়েছে দেশের ডান-মধ্য-বাম সব মতের রাজনৈতিক বিভেদ, বৈষম্য। যারা ভারতের ক্রীতদাস এবং ভারতের লেলিয়ে দেয়া হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের লাঠিয়াল, তারা ছাড়া গোটা বাংলাদেশকে তারা ঐক্যবদ্ধ করে গেল এই চিন্তায় যে, প্রতিবেশী ভারত আমাদের শত্রু রাষ্ট্র এবং ভারতপন্থী দল, সংস্কৃতি এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী দালালগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুশমন এবং গণশত্রু। একই সাথে তারা জানান দিয়ে গেল, এই উপমহাদেশে এবং তাবৎ বিশ্বে যারাই ভারতের বিপক্ষে তারাই আমাদের বন্ধু ও সহযোগী।
৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে ছাত্র-জনতার দুনিয়া কাঁপানো গণ-জাগরণ ঘটে গেল তা আগে থেকে কেউই ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি। ১৭ বছর ধরে এ দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রাসনবাদী ভারতের লেলিয়ে দেয়া খুনি এরশাদ ও নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারী আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের দুর্গ টলাতে পারেনি। প্রধান দুটি বিরোধী দলের ওপর চালানো হয়েছে গুম, খুন, আয়না-বন্দী, মামলা-হামলা, সন্ত্রাস, নির্বাচনের নামে জোচ্চুরি। অথচ এত অত্যাচার-নিগ্রহে পড়া প্রধান বিরোধী দলগুলো কিছুতেই কিছু করতে পারছিল না। অথচ গুলিকে বুকে নিতে শেখা এই নবীন প্রজন্ম মাত্র এক মাসেই গণ-বিপ্লবের জোয়ার তুলে সেই ফ্যাসিবাদকে দেশছাড়া করতে পেরেছে। স্বৈরশাসক দলের গণ-বিচ্ছিন্নতা এত প্রকট হয়ে পড়ে যে, মানুষ এদের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য নীরবে অশ্রুপাত করছিল। এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে দেশের নবীন তারুণ্য। তাদের রাজপথের মিছিলেই ফুটে উঠেছে তার নতুন ভাবনা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। সেগুলোর লক্ষণীয় ব্যতিক্রমগুলো এত বেশি যে, এক লেখায় সেগুলোর শিরোনাম লিখতেও কলাম ফুরিয়ে যাবে। তবু বলতে হয়, নবীন প্রজন্মের মধ্যে আমরা অমিত দেশপ্রেম দেখে অভিভূত হয়েছি। কারণ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দেশপ্রেম মানেই সর্বগ্রাসী ভারতীয় আধিপত্যবাদ আর তাদের প্রতিনিধি ভারতীয় দোসর আওয়ামী খুনি সরকারের সমূলে উৎখাত। তারা এ ব্যাপারে ছিল দৃঢ়সঙ্কল্প। দ্বিতীয়ত, সাম্য এবং সমানাধিকারের প্রতি এই তারুণ্যের ধনুকভাঙা পণ। তৃতীয়ত, জেন্ডার সমতা। এই আন্দোলনে কিশোরী-তরুণী-ছাত্রীদের স্বৈরাচারের নির্যাতন সওয়া এবং প্রতিবাদে সংগ্রামী ভূমিকা দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছে। চতুর্থত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের গণ-মানুষের সংগ্রামের প্রতি দরদ সহমর্মিতা। এবারের ছাত্র আন্দোলনে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী সাহসী ভূমিকা রেখেছে দেশের প্রাইভেট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। মৃত্যুর মিছিলে তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শামিল হয়েছে। অথচ এরা সমাজের সচ্ছল পরিবারের সন্তান।
পঞ্চমত, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে তাদের পরিবারের, বিশেষ করে, মায়েদের অংশগ্রহণ এবং রাজপথে নেমে আসার ঘটনা। ষষ্ঠত হলো আওয়ামী লস্কর, গোপালগঞ্জ নামক অভিশপ্ত জেলার পুলিশ ও ছাত্রলীগ থেকে টোকানো পুলিশ ছাড়া অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষীদের কিছুটা হলেও নমনীয় ভূমিকা। সর্বশেষ এবং সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লবে সেনাবাহিনীর বীর দেশপ্রেমিক সদস্য এবং মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তাদের সহানুভূতি এবং গণসংহতি। ‘আর একটাও গুলি নয়’ এই বার্তা দিয়ে কার্যত ৩ আগস্ট থেকেই এই দেশপ্রেমিক বীর সেনানীরা তাদের বন্দুকের নল ঘুরিয়ে নেয়। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকা জাতির অন্তর স্পর্শ করে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর উচ্চাসনে যারা বসেছিলেন এবং এখনো বসে আছেন, তারা স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার ভারতীয় প্রভুদের দয়াতেই ছিলেন। তারা এখনো বহাল। তারা আওয়ামী নেতাদের জনতার কাছে সঁপে দিতে চাইবেন না, এটাই বাস্তব এবং ঘটনা ঘটেছে সেটাই। কুখ্যাত আয়নাঘর জেনারেল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালক পাকড়াও হয়েছেন ঠিকই। তবে তিনিও এখনো সেনা নিবাসেই আছেন। চাচ্ছেন রাজসাক্ষী হতে। আরো অনেক ফিফ্থ্-কলামিস্ট আছেন। তারা ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫-এর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের কথা জানেনই না। জাতি দেখেছে কিভাবে এই সিপাহি-জনতাই ১৫ আগস্টের সফল বিপ্লবের পালটা বিপ্লব নিপাত করার জন্য সে দিন ব্যারাক থেকে হাজারে হাজারে বেরিয়ে এসে জনতার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনে মৃত্যুর গণনা চলছে। ধারণা, ১৫০০ ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের মরণ আঘাতে শাহাদাতবরণ করেছে। অজস্র ছাত্রছাত্রী জনমের মতো কানা এবং পঙ্গু হয়ে গেছে। যত দিন তারা বেঁচে থাকবে এই জুলাই ২৪ গণহত্যার দুর্বিষহ স্মৃতি তাদেরকে তাড়া করে ফিরবে। স্বৈরাচারী হাসিনা শহীদ সন্তানের মায়ের কাছে না গিয়ে মুখে ছলনার রুমাল বেঁধে মেট্রো স্টেশন এবং স্বৈরাচারের পদলেহী বিটিভি দেখতে যায়। ফলে এত গণধিক্কার তার ওপর পড়েছে যে, পৃথিবীর আর কোনো স্বৈরাচারী এক নায়কের ভাগ্যে এমনটা জুটেছে কি না সন্দেহ।
’৭৫ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে বসিয়ে ভারতীয় RAW তাকে যে মগজ ধোলাই করেছিল তারই একটা পরিণতি দেশের জনগণ সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণা এবং বেপরোয়া বীতশ্রদ্ধ। শহীদ জিয়া তাকে দেশে আসতে দেবার যে ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ করেছিলেন, তারই খেসারত দিচ্ছে আজ এই দেড় হাজার সন্তানহারা মা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক মা বলেছেন, হাসিনা তার স্বজন হারিয়েছেন, সন্তান হারাননি। স্বজন হারানো এবং সন্তান হারানোর পার্থক্য রাত ও দিনের। স্বজন হারানোর নাটক ছিল হাসিনার রাজনৈতিক পুঁজি। তবে এই পুঁজির লভ্যাংশ আজ ‘শূন্য’ হয়ে গেছে। সে নিজেই তার বাবার এই রাজনৈতিক অপমৃত্যু তথা মরণোত্তর লাঞ্ছনার জন্য দায়ী। সে শেখ মুজিবকে আওয়ামী দানবের মূর্তি হিসাবে দাঁড় করিয়েছিল।
সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবেই পরিবর্তন করা যেত। কিন্তু হাসিনা তো নির্বাচন নামক গণতান্ত্রিক চর্চার শ্বাসরুদ্ধ করেছিল। নির্বাচনের নামে প্রতারণা করে জনগণের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। তার শক্তির দুর্গ ছিল তার পেটোয়া পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ, ভারতীয় RAW এবং দেশজুড়ে চেপে বসা তার সিভিল-মিলিটারি আমলাতন্ত্র।
যে জনগণকে আকণ্ঠ বৈদেশিক ঋণের জালে আটকিয়ে শেখ হাসিনা লাখ কোটি টাকা তথাকথিত উন্নয়নে ঢেলেছে তার অর্ধেকেরও বেশি চুরি করে লুটে নিয়ে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে সে নিজে, তার বোন, ছেলে এবং চ্যালা-চামুণ্ডারা ।
বাংলাদেশ থেকে এত পরিমাণ অর্থ পাচার হতে দেখে সাবধান করেছিল মার্কিন কেন্দ্রীয় অর্থ সংস্থা ফেড (ফেডারেল রিজার্ভ)। বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করা টাকার সামান্য একটা অংশ ফিলিপাইনে ধরা পড়ায় চমকে গিয়েছিল সে দেশের সরকার। সুইস ব্যাংকে জমানো সন্দেহভাজন আর্থিক ডিপোজিট তদন্ত করে স্বচ্ছতা আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সুইস সরকার। যে দুর্গগুলোর হদিস আজ অবধি পাওয়া যায়নি, সেগুলোর মধ্যে আছে ফিনল্যান্ড এবং বেলারুশ। ঠিকমতো তদন্ত হলে বের হতে বাধ্য হবে থলের বিড়াল। অধীর আগ্রহে জাতি সে দিনেরই অপেক্ষা করছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জাতীয় ঐক্য গড়ার পরিবর্তে ক্ষমতা জবরদখলকারী আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত ও খণ্ড বিখণ্ড করে তোলে। অথচ দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর সংঘটিত হলো জাতীয় ঐক্যের সেই অপূর্ণ বাসনা। রাজনৈতিক দলগুলো বিগত ৫৩ বছরে জাতীয় ঐক্য গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। নবীন তারুণ্য তাদের বাপ-চাচাদের ঐক্যবদ্ধ করে দিলো। জাতীয়তাবাদ, ইসলামী আদর্শ ও বিভক্ত দলীয় পরিচিতির সীমানা পেরিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ১৬ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং দেশের প্রধান দুশমন ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও তাদের স্থানীয় এজেন্ট আওয়ামী বাকশালীদেরকে গণশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তারা দেশের মূল জাতিসত্তার রাজনীতিকে সার্থকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে, এটাই তাদের মৌলিক অবদান। গুম-খুন-মিথ্যা মামলা-হয়রানি-কথায় কথায় তুলে নিয়ে যাওয়া- এবং ঠাণ্ডা মাথায় বিরোধীদেরকে খুন করে বেওয়ারিশ লাশের পাহাড় বানানোর মতো ফ্যাসিবাদের এই বাংলার মাটিতে কবর রচনা করে নিজেরাই ইতিহাস হয়ে গেল এই নবীন-তরুণরা। এরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ- এই ঐতিহ্যবাহী জাতির রাহবার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা