হানিয়া-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য
- মো: বজলুর রশীদ
- ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া তেহরান গিয়েছিলেন। সেখানে ৩১ জুলাই ২০২৪ ভোরে গুপ্ত হামলার শিকার হয়ে তিনি ও তার এক দেহরক্ষী নিহত হন। চলমান গাজাযুদ্ধে এর আগে হানিয়া বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ স্বজনকে হারিয়েছেন। মাত্র দু’ মাস আগে ইসরাইলি বিমান হামলায় তার তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি নিহত হয়। এপ্রিলে তার এক বোনকে হত্যা করা হয়। ৬২ বছর বয়স্ক হানিয়া কাতারে প্রবাস জীবনযাপন করছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি হামাসের প্রধান হন। তার নিহত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মুসা আবু মারজুক প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেন। বৈরুতে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরকে হত্যার একদিন পর ৩১ জুলাই তেহরানে ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড ঘটে।
জায়নবাদী ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়েই গুপ্তহত্যার অভিযান শুরু হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল জায়নবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো ও প্রতিশোধ নেয়া। নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় বেদুইন পুলিশ সদস্য আরিফ-আল আরসানকে। সেই প্রথম। ১৯১৬ সালে তাকে গুলি করা হয়।
১৯৪৮ সালে দখলদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গুপ্তহত্যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং এটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি সামরিক ও রাজনৈতিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। যেমন, ঘাসান কানাফানি, আবু হাসান সালামা, কামাল আদওয়ান, খলিল আল-ওয়াজির প্রমুখ বিখ্যাত নেতারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
গুপ্তহত্যার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। গাড়িতে বিস্ফোরক স্থাপন, বৈরুতে কানাফানিকে এই পদ্ধতিতে হত্যা করা, বাড়িতে উচ্চক্ষমতার বিস্ফোরক ব্যবহার, প্যারিসে মাহমুদ আল-হামশারিকে হত্যা, সরাসরি গুলি করা, প্যারিসে বাসিল আল-কুবাইসির হত্যাকাণ্ড, বিষ প্রয়োগ, ইরাকে ওয়াদিহ হাদ্দাদকে, বুবি-ট্র্যাপ, তামের আল-কিলানিকে মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় বুবি-ট্র্যাপ দিয়ে হত্যা করা হয়। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। বিদ্রোহী অভিযান বন্ধ করার লক্ষ্যে আবু আলী মুস্তাফা, শেখ আহমেদ ইয়াসিন, সালাহ শেহাদেহ, রায়েদ আল-কারমি এবং আরো অনেককে হত্যা করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ হামাস নেতাদের বিদেশেও খুন করে। মাহমুদ আল-মাবউহকে ২০১০ সালে দুবাইয়ে, ২০১৬ সালে মুহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে তিউনিসিয়ায়, ওমর আল-নায়েফকে বুলগেরিয়ায় হত্যা করা হয়। ইরাকে ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার ৬২ বছর বয়সী কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়, ইসরাইল এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ায়। হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিডিয়ায় এটিকে সফল অপারেশন বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডজনখানেক পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে দেশ-বিদেশের মাটিতে। দশকের পর দশকের এই গুপ্তহত্যার পর অবশেষে গত সপ্তাহান্তে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, নেতানিয়াহু এবং প্রধান সেনাপতিকে হত্যার নির্দেশনাসহ কমান্ডো বাহিনী পাঠানো হয়েছে।
জিহাদি দলকে হত্যার জন্য বিমান ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ব্যক্তি পর্যায় থেকে পরিবার, সমাজ ও সংগঠন ধ্বংস করা এবং বিপক্ষকে নির্মূল করার বড় হাতিয়ার গুপ্তহত্যা। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে, ইসরাইল কথিত শান্তি আলোচনা সফল করার জন্য সামরিক পদক্ষেপে জড়িত প্রত্যেককে নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল। একই সময়ে, হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের মতো ইসলামী সংগঠনগুলো ধ্বংস করা ছিল তার লক্ষ্য।
গুপ্তহত্যার সিরিজ অভিযান গাজা স্ট্রিপ লক্ষ্য করে পরিচালিত ছিল কেননা এখান থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ পরিচালিত হতো। ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি গাজায় বিভিন্ন যুদ্ধ ও হামলার সময়, আহমেদ আল-জাবারি, রায়েদ আল-আত্তার, বাহা আবু আল-আত্তা এবং জিহাদ আল-ঘান্নামের মতো কিছু কৌশলী প্রতিরোধ নেতাদের হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে মারওয়ান আল-কাওয়াসমি এবং আমের আবু আয়েশাকে, ২০১৭ সালে বাসিল আল-আরজকে, ২০১৮ সালে আহমেদ জারার এবং আশরাফ নালাওয়াকে, ২০১৯ সালে ওমর আবু লায়লাকে বড় মাপের নেতাদের গুপ্তহত্যা করা হয়, এবার ২০২৪ সালে ইসমাইল হানিয়াকে অল্প সময়ের ব্যবধানে সপরিবার হত্যা করা হলো।
গুপ্তহত্যার অসংখ্য অভিযান সফল হয়নি, এর ফিরিস্তি অনেক লম্বা। ১৯৯৭ সালে খালেদ মেশালকে জর্দানে বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সফলভাবে বিষ প্রয়োগ করার পরও অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয় এবং এতে জর্দানের সাথে কূটনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়। ২০১৯ সালে সিরিয়ায় ইসলামিক জিহাদের সামরিক কর্মকর্তা আকরাম আল-আজুরিকে ইসরাইলিরা হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের একটি প্রজন্মকে প্রতিরোধ থেকে বিরত রাখা। এখন দেখা যাচ্ছে, সে চেষ্টা আদৌ সফল হয়নি এবং পশ্চিমতীরে সঙ্ঘাত দিন দিন বাড়ছে। যারা বলত ইসরাইল একটি অপরাজেয় শক্তি এবার তারা হিসাব কষে বলছে, হামাসকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড ইরানের নেতৃত্বকে অপমানিত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সঙ্ঘাত খুব দ্রুত এবং উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রসারিত ও আন্তর্জাতিকীকরণ হয়ে গেছে। ইরান ও তার প্রক্সি মিত্ররা- প্রধানত হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুথিরা যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেটি মধ্যপ্রাচ্যকে বড় প্রভাবিত করছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পরিচালক ড. আলী ভায়েজ বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড পুরো অঞ্চলজুড়ে একাধিক বড় ধরনের গুপ্তহত্যা ও অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলা ডেকে আনবে।’
ইরানের স্বার্থ এখনো ইসরাইলের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো, বিশেষত যেখানে ওয়াশিংটন সরাসরি জড়িত। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে তেহরান একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে না জড়িয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভাবমর্যাদা, প্রতিপত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের উপায় খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ঘোষণা করেছেন যে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া ছাড়া ইরানের আর কোনো বিকল্প নেই। গাজা যুদ্ধ এই অঞ্চলে সঙ্ঘাতের একটি সম্পূর্ণ নতুন পর্যায়ের সূচনা করেছে, এটি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়, একদিকে ইরান ও হিজবুল্লাহ এবং অন্যদিকে ইসরাইল সরাসরি মার্কিন সমর্থনসহ একটি সত্যিকারের যুদ্ধ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘে ইরানের মিশন বলেছে, হানিয়া হত্যার জবাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ‘বিশেষ অভিযান’ চালাবে। হানিয়ার হত্যা ইরানিরা সহজভাবে নিতে পারছে না।
কাতার বলেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার রোডম্যাপে হানিয়ার হত্যা বড় সমস্যা এবং তা বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। এসবই ইচ্ছাকৃত এবং এটা স্পষ্ট যে নেতানিয়াহু গাজায় বিরাজমান কূটনীতির যে কোন সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে চাইছে।
হানিয়া একটি চুক্তি ও সমঝোতার জন্য চাপ দেয়া ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি গাজাবাসীদের সাথে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কথা বলতে সক্ষম ছিলেন, তিনি প্রভাবশালী ছিলেন এবং হামাসের অভ্যন্তরে দৃঢ় বক্তব্য রাখতে পারতেন। হামাস তাকে মাস্টারমাইন্ড মনে করে। হানিয়া হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের সবকিছুকে জটিলতর করায় ফলপ্রসূ কূটনীতির সম্ভাবনা নিভু নিভু করে দিয়েছে। এই অঞ্চলের পুরো পরিস্থিতি এমনিতেই জটিল, তারপর সেখানে বছরব্যাপী মরণপণ যুদ্ধে হামাস যেকোনো ধরনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে সেটা অনেকে মনে করতেন না। হানিয়া সামরিক শাখা এবং বাইরের বিশ্বের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করতে দক্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চান না। তিনি সম্পূর্ণ বিজয় চান যার অর্থ চিরস্থায়ী যুদ্ধ। যুদ্ধ জয়ের জন্য নেতানিয়াহু প্রয়োজনে কম ক্ষমতার পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য বসে আছেন। তবে গাজায় পরমাণু বোমা ফেললে, ইরানও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। তাই এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টির পূর্বে ইরানকে শেষ করতে হবে। সেজন্য ইরানকে যুদ্ধে টেনে নিয়ে আসতে চায় ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র। এটি চলছে বহু বছর ধরে।
হানিয়ার মৃত্যুতে শোকের পরিবর্তে উল্লাস প্রকাশ করেছেন ইসরাইলি হেরিটেজ-বিষয়ক মন্ত্রী আমিখাই এলিয়াহু। হানিয়ার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘হামাস নেতার মৃত্যুতে পৃথিবী খানিকটা ভালোর দিকে এগিয়ে গেল।’ তিনি ইসমাইল হানিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এই নশ্বরদের জন্য কোনো করুণা নেই।’ এই মৃত্যুর খবরে তেলআবিবে সেনারা রাস্তায় রাস্তায় নৃত্য করে বলে খবর প্রকাশ পেয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় হানিয়াকে তারা কতটা ভয় পেত।
হানিয়ার হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্কের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো নেগার মোরতাজাভি মনে করেন: একজন রাষ্ট্রীয় মেহমান ইরানের সুরক্ষিত বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ইরানের জন্য অপমানজনক। পশ্চিমা বিশ্ব চায়, ইরান সরাসরি যুদ্ধ করুক।
নেতানিয়াহু ও ইসরাইল তার চরমপন্থী মিত্ররা যেকোনো ধরনের উত্তেজনা প্রশমন বা গুরুতর কূটনীতির বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া ইরান ও লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরাইল তার সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না বুঝতে পেরে নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনকে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। বৃহত্তর সঙ্ঘাতের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের আরো দেশ দরকার। এবার সেটিই হলো; জনাব বাইডেন সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ‘প্রধান সামরিক মিত্র’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে আমিরাতে ইতোমধ্যে বিরাজিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো আরো উন্নত মানের আধুনিক অস্ত্র পাবে এবং এইসব ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারত ব্যবহার করতে পারবে। এই মুহূর্তে বল ইরান, হামাস ও হিজবুল্লাহর কোর্টে এবং তারা যেভাবেই সাড়া দিক না কেন, পরবর্তী পদক্ষেপ এ অঞ্চলে মোটেই সুখকর কিছু হচ্ছে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা