হেফাজত কেন ‘রাজনীতিমুক্ত’ হতে চায়?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ জুন ২০২১, ২২:১০
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামকে এবার রাজনীতিমুক্ত করার কথা বলে জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বেই এর নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে সংগঠনটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, মামুনুল হকসহ যারা রাজনীতির সাথে জড়িত, এমন নেতাদের নতুন কমিটিতে কোনো পদে রাখা হচ্ছে না।
দু’একদিনের মধ্যেই আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে।
এদিকে, হেফাজতেরই অনেক নেতা বলেছেন, গত মার্চ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনায় সংগঠনটির নেতাদের গ্রেফতার অভিযান যখন চলছে, সেই পটভূমিতে সরকারের চাপে, নাকি সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করা হচ্ছে-এ নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে সংগঠনটির আমির করে ১৫১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর চার মাস পরই গত এপ্রিল মাসে সেই কমিটি বিলুপ্ত করে বাবুনগরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় ।
এই আহ্বায়ক কমিটি এমন এক সময় গঠিত হয়েছিল, যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় হেফাজতে অনেক নেতাকে।
সেই গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এখন আবার সংগঠনটির নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
হেফাজতে ইসলামের সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, তারা আহ্বায়ক কমিটির বদলে পূণাঙ্গ কমিটি গঠন করছেন। আমরা এডহক কমিটির সদস্যরা পরামর্শ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা পুরোনো মুরব্বী এবং বড় বড় আলেম যারা আছেন, তাদেরকে নিয়ে এই কমিটি করা হবে।
গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় হেফাজতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা এবং হাটহাজারী এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা হয়।
সেই ঘটনার মামলায় হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান চালানো হচ্ছে।
সঙ্কট সামলাতে হেফাজতের নেতৃত্বকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করতে দেখা গেছে।
সে সময়ই আকস্মিকভাবে যে আহ্বায়ক কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, তখনও সংগঠনটিকে রাজনীতির বাইরে রাখার কথাই বলা হয়েছিল। তা নিয়ে হেফাজতের অনেক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিলেন।
হেফাজতের কর্মকাণ্ড ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করেন লেখক শরীফ মোহাম্মদ।
তিনি বলেছেন, এখন রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে হেফাজতের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে যোগাযোগ এবং চাপের বিষয় অন্যতম কারণ হতে পারে। কিছু দিন আগে যখন হেফাজতে ইসলামের কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়, তখনই এটা বোঝা যাচ্ছিল য হেফাজত একটা ভালো চাপে আছে। এর আগেও গ্রেফতার ইত্যাদির পর যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একাধিকবার হেফাজতের নেতৃবৃন্দের বৈঠকের খবর আসছিল, তখনো এটা মনে হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, এখন যে হেফাজতের একটা কমিটি গঠনের কথা উঠেছে এবং সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দেয়া হবে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে আগের যোগাযোগ, সরকারি চাপ, প্রত্যাশা এবং বাস্তবতা-এই সবগুলোকে সামনে নিয়েই হয়তো কিছু একটা হবে।
হেফাজত কওমী মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হলেও এর শুরু থেকেই কমিটিতে আমির এবং মহাসচিব ছাড়া অন্য পদ এবং সদস্যদের বেশিরভাগই ছিলেন ইসলামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিভিন্ন সময় হেফাজতের কর্মসূচির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছে।
যদিও ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচির পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সে সময় আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল।
হেফাজত বলেছে, মার্চের সহিংসতার ঘটনায় অব্যাহত গ্রেফতার অভিযানে মামুনুল হক এবং আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ তাদের ৫০ জনের বেশি কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগের পেছনে সরকারের চাপ রয়েছে, এমন সন্দেহের কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের একাধিক নেতা।
তারা বলছেন, মামুনুল হকসহ রাজনীতির সাথে জড়িতদের কমিটির পদে রাখা হচ্ছে না, এমন ধারণা তারা পাচ্ছেন।
হেফাজতের নতুন কমিটি সর্বোচ্চ ৪০ সদস্যের হতে পারে। জুনায়েদ বাবুনগরীই আমির এবং নুরুল ইসলাম জেহাদী মহাসচিব হচ্ছেন। অন্য পদগুলোতে এবং সদস্যদের তালিকাও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
হেফাজতের সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী দাবি করেছেন, তাদের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো চাপ নেই। সরকার এটার মধ্যে কোন ইন্টারফেয়ার করছে না। আমরাই হেফাজতে ইসলামের চরিত্র এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রাখার জন্যই করছি।
জেহাদী আরো বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যখন গঠন করা হয়েছিল, তখন থেকেই এটা একটা অরাজনৈতিক সংগঠন। এবং মূল দায়িত্বে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা ছিলেন, অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাই থাকবেন। এর মূল দায়িত্বে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি আসবে না।
একইসাথে তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে জড়িতরা পদে থাবেন না। কিন্তু সংগঠনে থাকবেন। তারা সংগঠন থেকে কাউকে বাদ দিচ্ছেন না। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড হেফাজতের প্রোগ্রামে থাকবে না। তবে অরাজনৈতিক চরিত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে জেহাদী বলেছেন, অরাজনৈতিক কর্মসূচি বলতে, যারা ইসলাম বিদ্বেষী বা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে, মহানবী সা: এর বিরুদ্ধে লেখে বা কর্মকাণ্ড করে তাদের প্রতিবাদের জন্যই এই সংগঠন। সেটাই থাকবে।
আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলে আনাস মাদানীর নেতৃত্বে একটি অংশ হেফাজতের নেতৃত্বে জুনায়েদ বাবুনগরীকে মেনে নিতে পারেননি। তাদের দিক থেকে এখন পাল্টা কমিটি করার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে এই অংশের সাথে কোন আলোচনায় না গিয়ে নতুন কমিটিতে আহমদ শফীর বড় ছেলে মো: ইউসুফকে রাখা হতে পারে, হেফাজতের এখন নেতৃত্ব থেকে এমন ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে।
শরীফ মোহাম্মদ বলেছেন, সরকারের চাপ বা হেফাজতের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট রয়েছে, তবে কওমী মাদরাসাগুলো খোলার বিষয়টি বড় চাপ তৈরি করেছে। সেজন্য রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের বিষয় একটা কৌশল হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। এখন কওমী মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা হয়েছে। অথচ মাদরাসাগুলো বন্ধ। তাদের অনেকে মনে করছেন যে সরকারের কঠোরতা হেফাজত কেন্দ্রিক, অথবা মাদরাসার ছাত্র ক্যাম্পাসে চলে আসলে কোনো জটিলতা হতে পারে কি না-এগুলো বিবেচনায় নিয়েও সরকার হেফাজতে ইসলাম এবং মাদরাসা খোলার ব্যাপারে নেতিবাচক কোনো অবস্থানে থাকতে পারেন। এজন্য মাদরাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা মহলগুলো-তারাও চাচ্ছেন, পরিস্থিতি যাতে এমন না হয় যে সরকারের সাথে দূরত্ব বা জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষাবর্ষ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্যে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষা বিষয়ক চাপটাও একটা বড় চাপ এবং বাস্তবতা হিসাবে থাকতে পারে।
তবে হেফাজত নেতা নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, নতুন কমিটি হলে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তাদের সংগঠনের কাজে গতি আসবে।
এদিকে কয়েক দিন আগে হেফাজতের ৫০ জনের বেশি নেতার সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সূত্র : বিবিসি