‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত হলেই জাতীয় ঐক্যমত হওয়া সম্ভব’
- অনলাইন প্রতিবেদক
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩:০৩
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত হলেই জাতীয় ঐক্যমত হওয়ায় সম্ভব বলে টেবিল আলোচনা সভায় মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক বক্তারা।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘সংকট থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ঐক্যমতের বিকল্প নেই' নাগরিক ঐক্যের আয়োজনে রাজধানীর এক হোটেলে আলোচনা সভায় রাজনৈতিক নেতারা বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, ‘ঐক্যমতের ক্ষেত্রে ১৭ কোটি মানুষের কাছে একই মত পাওয়া সম্ভব নয়, যাওয়াও সম্ভব নয়। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মানুষের বা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত হলেই জাতীয় ঐক্যমত হওয়া সম্ভব। কারণ সরকার জাতীয় ঐক্যমত করতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই আসবে। জাতীয় ঐক্যমতের বৈধতার ক্ষেত্রে গণভোটের বিকল্প নেই। এটার মাধ্যমে ঐক্যমত পৌঁছাতে হবে।’
এ সময় সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেই সাথে চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ঐক্যমতের বিকল্প নেই। ঐক্যমতের মাধ্যমে সব সম্ভব। জাতীয় ঐক্যমতের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের শপথ নিয়েছে। তার মেয়াদ কত সেটা দেয়া নেই। নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে, নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ বলুক। কিন্তু সেটি ঠুনকো। এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছে, তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করতে হবে। কাউকে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধান নিয়ে বেশি বিরোধ নেই, আমি দেখেছি, আলী রীয়াজ সাহেব পাঠিয়েছেন। তবে ৭১ ইতিহাস লড়াই, এটা আলাদা। এটি ২০২৪-এর সাথে কম্পেয়ার করা ঠিক হবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যটাকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কারণ অনেক দেশে বিপ্লব হাতছাড়া হয়ে গেছে, নিজেদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যমত না থাকার কারণে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব রাফি সালমান রিফাত বলেন, ‘দেশে চলমান সঙ্কট কী ৫ আগস্টের পরের সঙ্কট? আমরা যে রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা বলি, এটি তো ১৫ বছরে ধ্বংস কাঠামোর এবং নির্বাচন কারনে তৈরি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্ক করার চেষ্টা করা হয়। এটি আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের মনে করেছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সবাই অংশ নিয়েছিল শুধুমাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। ক্রেডিট তো সব দলের, কারো একক নয়। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষায় আমাদের সকলের ঐক্যমতের জায়গায় কোনো বিকল্প নেই। ৩২ বাড়ি ভাঙ্গা নিয়ে অনেকে বিতর্ক তৈরি করেছে, কথা হলো এটির জন্য কে দায়ী। শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং তার অনুসারীদের মাথাচাড়া দেয়ার কারণে। আওয়ামী লীগের বিষয়ে আমাদের ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর একটা মার্শাল ল’ আসে। সেটি পাকিস্থান আমল থেকে দেখে আসছি। আন্দোলনের পর যে অন্তর্বর্তী সময়টায় নির্বাচন দিলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এবারের আন্দোলন কিন্তু ভিন্ন আমরা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আলো দেখেছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের অ্যাসেট। ওনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু এখন সরকারের পথ চলা ভিন্ন দেখছি। স্বল্পকালীন সরকারের জন্য এত বড় ক্যানভাস করা প্রয়োজন ছিল না। শেখ হাসিনা তো ১৫ বছরে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল নির্বাচনমুখী হওয়া। আমরা সরকারে সংস্কার প্রতিবেদনগুলো ফেলে দেয়ার কথা বলছি। এগুলো নিয়ে ভাবছি। শেখ হাসিনার পতনের পর কেউ আগের মতো দেশ চালাবে, এটা ভাবা যায় না। আমরা নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ চালাবো। যত সমস্যার একমাত্র সমাধান নির্বাচন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘সরকার ব্যর্থ অযোগ্য মনে করলে, নির্বাচনের মত বড় বিষয় সরকার করতে পারবে এটা কেন প্রত্যাশা করছেন? ৬ আগস্ট পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থান হাসিনার পতন গুরুত্ব দিয়েছে। সেই সাথে জাতীয় সরকারের কথা বলা হয়েছিল। আবার সেনা প্রধান বলেছিলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার হবে।’ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সরকারের না গিয়ে কেন অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে গেল?’
তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থান তখনই সফল হয়েছে যখন সকল ছাত্র, শ্রেণি পেশার মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নেমেছে তখনই সফল হয়েছে। এখনকার সরকারে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নেই। বাকি দুই স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধি আছে। এখন সংকট সমাধানের দায়িত্ব যদি ছাত্রদের উপর দিয়ে দেন তাহলে তাদের দেয়া রূপরেখায় আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন হতে পারবে না অথচ জাতীয় নির্বাচনের সময় আমরা চাচ্ছি অল্প সংস্কার করেই নির্বাচন হউক। এখানে কিন্তু আমাদের দুই ধরণের বক্তব্য হচ্ছে, এটা বলা যায় রাজনৈতিক দল গুলোর দ্বিচারিতা। আমরা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একরকম কথা বলছি আবার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিপরীতধর্মী কথা বলছি। যেহেতু ৯০ আন্দোলনের পর সংস্কার কমিটমেন্ট রাখতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো, ২০২৪-এর আকাঙ্ক্ষা তো ব্যাপক, সেটি করবে কি রাজনৈতিক দলগুলো? তা নিয়ে আস্থা সঙ্কট রয়েছে ছাত্রদের মধ্যে।
বাসদ-এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে থেকে ৬ মাসের জবাবদিহিতা চাওয়া দরকার। কী কী করেছে ৬ মাস? ১২ জনের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে এ সরকারের আমলে, এমন কি শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে পুলিশ সদস্যরা। এর কোনো প্রতিকার দেয়নি সরকার।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, ‘দেশে সঙ্কট আছে, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। বিভিন্ন স্বার্থে আমাদের নানা মত আছে, তবে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
গণসংহতি আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে, যেটি ব্যাবহার করে এক দলীয় বা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। সেটির বিলোপ করতে হবে। ৭২ সংবিধান হাত ধরে আওয়ামী লীগ বারবার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মানুষের নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। ৭২ সংবিধানের একদলীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রতারণা, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার যন্ত্র। যেটাকে পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। বর্তমানে মানুষের অধিকারের আন্দোলনকে সামনে রাজনৈতিক সঙ্কট হতে পারে বলে বাধা দেয়া যাবে না।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় নেতৃত্বে বের করতে ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিন। এতে করে নেতৃত্বে বের হয়ে আসবে। ক্ষমতার পেছনে না ঘুরে। এখন আমাদের ভিতরে কথার ফুলঝুড়ি উঠেছে। কোনো ঐক্যমত নেই। যত দিন যাচ্ছে সব কিছু ঝুলে যাচ্ছে। তাই সরকারকে বলি, বেশি বেশি সংস্কারের কথা বলে, কুসংস্কার করবে না। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। না হলে মঈন উদ্দিন ফখরুদ্দিনের মতো পালাতে হবে। এখন তো দেখি সরকার থেকে কিংস পার্টি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘১৫ বছর রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদ পতন ঘটাতে পারিনি। কিন্তু ছাত্ররা সেটি পেরেছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক ঐক্যমত করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাদের অংশীজন হিসেবে রাখতে হবে। যাতে আগামীতে কেউ ফ্যাসিবাদ না হয়ে উঠে।’
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘১৯৭১-কে বাদ দিয়ে কিছু করতে দেয়া হবে না। কেউ বলে মহান গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে বিপ্লব? কিন্তু বিপ্লব ও মহান অভ্যুত্থান আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়নি, স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালেই।’
ঐক্যমত কার সাথে কার এমন প্রশ্ন রেখে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘ঐক্যমত দরকার সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সম্মান দেখানো প্রয়োজন। এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংস্কার বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। কেউ বলে পরিবর্তন চাই, কেউ চায় না। ১৯৭১-এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ হয়েছিল, সেটার ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থান। এ বিষয়টি সবাইকে ধারণ করার আহ্বান জানান তিনি।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা