গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে কী ঘটেছিল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৪০
গাজীপুরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে শুক্রবার মধ্যরাতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এ সময় হামলাকারীদের ওপর পাল্টা হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এই হামলায় অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান।
আহতদের প্রাথমিকভাবে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হামলায় আহতদের মধ্যে প্রায় সবাই ছাত্র বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শুক্রবার রাতে এই হামলার ঘটনার পরই তা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের অনেকেই ফেসবুক লাইভ করেন গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ থেকে।
সেখানে আহতদের অনেককে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। লাইভে এসে তারা অভিযোগ করেন, এই হামলা চালিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে কাউকে পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার রাত ২টার দিকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যালের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সভা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আহতদের দেখতে সেখানে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
শনিবার ‘মার্চ টু গাজীপুর’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
গাজীপুর থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেছেন, ‘ওই হামলার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন একজনকে আটক করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।’
তবে তার পরিচয় জানাননি তিনি।
কী হয়েছিল গাজীপুরে?
শেখ হাসিনার বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে গত দু’-তিন দিনে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ খুলনা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ছাড়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
গাজীপুরের স্থানীয় সাংবাদিক রিপন শাহ জানান, শুক্রবার রাতে গাজীপুর সদরের রাজবাড়ি মাঠে একটি সংগঠনের সমাবেশ ছিল। গাজীপুরের বিভিন্ন থানা থেকে দলটির কর্মীরা ওই সমাবেশে যোগ দেয়।
তিনি জানান, ওই সমাবেশ শেষে এর কর্মীরা গাজীপুরের বর্ণমালা সড়ক হয়ে টঙ্গীর দিকে যাচ্ছিল। সেখান থেকে একটি পক্ষ গাজীপুর মহানগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ড ধীরাশ্রম দক্ষিণখানে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালায়।
এ সময় গ্রামে ডাকাত হামলা চালিয়েছে বলে স্থানীয়রা পার্শ্ববর্তী মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়।
রিপন শাহ জানান, মাইকিং শুনে আশপাশের লোকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। তারা ভাঙচুরকারী কয়েকজনকে মারধর করেন।
পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।
সেখান থেকে গুরুতর আহত কয়েকজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন গাজীপুরের সিভিল সার্জন মাহমুদা আখতার।
গাজীপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মুহিম বলেন, ‘আমাদের গাজীপুর চৌরাস্তায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেটি শেষ করে আমরা সেখানে চা খাচ্ছিলাম। সেখান থেকে আমাদের কাছে খবর আসে সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেনের বাড়িতে কে বা কারা হামলা ভাঙচুর করছে। সেই খবর পেয়ে ছাত্ররা সেখানে যাওয়ার পর কয়েকজনকে মোজাম্মেল হক সাহেবের বাড়িতে দেখতে পায়। যাদের কেউ কেউ স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা জানান, ছাত্ররা সেখানে পৌঁছানোর পরই মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়।
মুহিমের দাবি, যারা ছাত্রদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছে তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
তবে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। পাওয়া যায়নি আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতার বক্তব্যও।
ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ‘এই হামলায় মোট ১৪ জন আহত হয়েছে। তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।’
পরিকল্পিত হামলা, দাবি বৈষম্যবিরোধীদের
শুক্রবার মধ্যরাতে গাজীপুরে সাবেক এমপি মোজাম্মেল হকের বাড়িতে স্থানীয়দের হামলায় ছাত্র জনতার ওপর স্থানীয় হামলাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করা হয় হামলার পরপরই।
রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট ও লাইভে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে ছাত্রদের ওপর এই হামলা চালিয়েছে।
হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গাজীপুরের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রাজীব ইশরাক আদনান।
আদনান বলেন, ‘রাত সোয়া ৮টার দিকে আমাদের কাছে যখন খবর আসে যে সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে। প্রতিহত করতে আমাদের কর্মীরা সেখানে ছুটে যায়।’
মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা হলেই কেন বৈষম্যবিরোধীরা সেখানে ছুটে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হামলা-লুটপাটের অভিযোগ হলে এখন আমাদের ওপর দায় আসে। সেটি যেন আমাদের ওপর না বর্তায় তাই আমাদের কর্মীরা সেখানে ছুটে যায়।’
এই হামলাকে সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে আদনান বলেন, ‘যারা বলছে তাদের এলাকায় হামলা হয়েছে তারা সবাই রাম দা হাতে নিয়ে বের হতে পারে না। সেখানে শত শত লোক ছিল। যাদের সবার হাতে রাম দা ছিল। মানুষ ১০-২০ মিনিটের মধ্যে এক সাথে হতে পারে না। ওদের একদম প্ল্যান করে করা। প্ল্যান ছাড়া এখানে আর কিছু হয়নি। সব কিছু পূর্বেই প্ল্যান করা ছিল।’
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রকাশিত খবরে আহত একজন সাক্ষাৎকার দেন।
হামলায় আহত সেই ছাত্র অভিযোগ করেন, ‘শুরুতে আমাদের ওপর যখন হামলা হয় তখন থানা থেকে কোনো রেসপন্স আসেনি। দলীয়ভাবে সবাই (হামলাকারীরা) ওই বাসায় ঢোকে ও বাসার ভেতর অ্যাটাক করে। তখন আমরা তাদের বলি যে আমরা তো ছাত্র, ছাত্র প্রতিনিধি।’
তিনি যোগ করেন, ‘ঘটনাস্থলে কী হয়েছে সেটা দেখার জন্য আমরা সেখানে যাই।’
‘মার্চ টু গাজীপুর’ কর্মসূচি
ওই হামলার পরপরই এর প্রতিবাদে শুক্রবার রাত ২টার কিছু আগে গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুরের নেতা মো: আবদুল্লাহ বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে। এটি শোনার পর প্রতিহত করতে আমাদের শিক্ষার্থীরা রওনা হন। দ্রুত ১৫-১৬ জন ঘটনাস্থলে চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লুটপাট হচ্ছে। এতে বাধা দিলে পেছন থেকে হুট করে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তাদের হাতে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র ছিল।’
তিনি যোগ করেন, ‘অন্য শিক্ষার্থীরা আসার আগেই ওই ১৫ জনকে ছাদে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে অন্যান্য শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে গেলে তাদেরকেও পেটানো হয়।’
সেখান থেকেই এই হামলার প্রতিবাদে শনিবার গাজীপুরে ‘মার্চ টু গাজীপুর’ কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হয়।
ওই ঘটনার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে গাজীপুরের তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
সারজিস আলম ফেসবুকে ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করে লেখেন, ‘গাজীপুরে আজকেই হবে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের শেষ দিন। আমরা আসছি…।’
ভোর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে একটি শনিবার গাজীপুরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘গাজীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসী মোজাম্মেল-জাহাঙ্গীরের চাপাতিবাহিনীর হামলার প্রতিবাদে আজ শনিবার বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন সারাদেশের আপামর ছাত্রজনতা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা।’
পুলিশি অভিযানে আটক একজন
এই হামলার খবর শুক্রবার রাতেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে এই হামলার জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে দায়ীও করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ‘সাবেক মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর বাসভবনের ভেতর কয়েকজনকে মারধর করা হয়েছে।’
তবে স্বাধীনভাবে সেই ভিডিও যাচাই করা যায়নি।
এই হামলার পরই পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয় জড়িতদের আটকের জন্য।
গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, ‘হামলার পরই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় পুলিশ। শনিবার সকাল পর্যন্ত একজনকে আটক করা হয়েছে।’
আটক ব্যক্তির কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে গাজীপুরের ওসি বলেন, ‘তিনি স্থানীয় বাসিন্দা। সরাসরি হামলার সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আমরা এখনো পাইনি।’
পুলিশ জানিয়েছে, ওই হামলার সাথে যারা যারা জড়িত তাদের সবাইকে আটকের চেষ্টা চলছে।
এই হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ওসি বলেন, ‘এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে।’
সূত্র : বিবিসি