২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

অজেয় তারুণ্যই গড়বে নতুন বাংলাদেশ

-

পৃথিবীতে কোথায়ও কোনো গণবিপ্লব আইনিকাঠামো মেনে বা সংবিধান- সম্মত পন্থায় সংঘটিত হয় না। তবে বিপ্লব সফল হলে সেই সাফল্যই হয় আইনের ভিত্তি। বিপ্লব ব্যর্থ হলে সেটা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণবিপ্লব সফল হয়েছে এটা যারা এখনো মেনে নিতে পারছে না, তারাই কেবল গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে পুনরাত্মপ্রকাশের দিবাস্বপ্ন দেখছে। ভুলে গেলে চলবে না, এই গণবিপ্লবে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী একাত্মতা প্রকাশ করে। সেই অর্থে আগস্ট ২০২৪-এর গণবিপ্লব ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালের মহাবিপ্লব এবং একই বছরের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবের সমতুল্য। ৫ আগস্ট ২০২৪ আমাদের অজান্তেই বিশ্ব ইতিহাসে একটি সফল গণবিপ্লবের দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এবং সহমর্মিতা অর্জনে সমর্থ হয়। বিশ্ব ইতিহাসে স্বৈরাচারী একনায়কত্ব উচ্ছেদের নিরিখেও এই বিপ্লব একটি নজির হয়ে থাকল।

পৃথিবীর রাষ্ট্র বিজ্ঞান বলবে, এই বৈপ্লবিক সাফল্য আরেকটি ফরাসী বিপ্লব, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। এই পতন গোটা পৃথিবীর স্বৈরাচারী একনায়কত্বের অনিবার্য পতনের পুনরাবৃত্তি বলেই আরো একবার গণ্য হবে। এখানে মায়া কান্নার সামান্যতম সুযোগ নেই। স্বৈরাচারের পরিণতি এরকমই কিংবা এর চেয়েও ভয়াবহ হয়ে থাকে। পতনের পর দেশে দেশে সাবেক স্বৈরাচারের যে পরিণতি হয় এ দেশের তার সামান্যই ঘটেছে। হাজারখানেক কিশোর-তরুণ-সাধারণ মানুষের বুকে যেভাবে গুলি চলেছে, বিগত ১৬-১৭ বছর ধরে যে নৃশংসতম হত্যা, গুম, জেল, নির্যাতন এবং নিকৃষ্টতম ‘আয়নাঘরের’ বর্বরতা চলেছে তার পতনের পর গণরোষ এবং বদলা নিঃসন্দেহে এর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারত।

খেয়াল করুন পর্তুগালে সালাজার একনায়কত্বের অবসানে, স্পেনে সিভিল ওয়ারের পর, চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর কী ঘটেছিল? কত কোটি মানুষকে খুন করা হয়েছিল কম্বোডিয়া-ভিয়েতনামে? আগস্ট মহাজাগরণের পর বাংলাদেশে রাষ্ট্র দলিল সংবিধান আমূল পরিবর্তন করা এবং স্বৈরাচারের বিষাক্ত নাগ-ছোবল হানা দেবার গর্ত মুখগুলো স্থায়ীভাবে ‘সীলগালা’ মারতে না পারলে প্রতিবিপ্লব যে অনিবার্য এটা দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রেরই জানা।

সব দেশেই কিন্তু বিধানসভা বা বিধায়কমণ্ডলী নির্বাচন করে নির্বাচিত কনস্ট্যিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি দ্বারা সংবিধান রচিত হয়নি। বাংলাদেশের যে মূল সংবিধান সেটাও কিন্তু কোনো নির্বাচিত বিধায়কমণ্ডলী কর্তৃক রচিত নয়। ১৯৭০ সালে সামরিক শাসক নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় যে আইনগত কাঠামো অধ্যাদেশ (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, ১৯৭০) খসড়া করে এবং যার সুপারিশের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন হয়, সেটা কিন্তু কোনো রাষ্ট্রপতি বা সংসদ নির্বাচন ছিল না। সেটা নিতান্তই ছিল শাসনতন্ত্র রচনাকারী বডির নির্বাচন এবং সেটা অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান : বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের স্থলে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন একটি দেশের সংবিধান সেই নির্বাচিত বিধায়কদের দিয়েই পাস করিয়ে আইন আকারে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যারই অনিবার্য ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এ দেশে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বা গণসম্মতিহীন একটি স্বৈরতন্ত্র জন্ম নেয়।

স্পেনে সংবিধান রচনার জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের দেশে যখন যে শাসক যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই সংবিধানকে সংশোধনীর পর সংশোধনী এনে কেটে ছিঁড়ে মূল সংবিধানের অন্তর্দর্শনই আর আস্ত রাখা হয়নি।
২০২৪ এর আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর তাই এখন যুগোপযোগী আধুনিক, মানবিক এবং নতুন বাস্তবতার আলোয় উদ্ভাসিত একটি সংবিধান রচনা আজ সময়ের অনিবার্য প্রয়োজন হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। এতে প্রতিফলিত হতে হবে প্রায় নিরঙ্কুশ জনসংখ্যার আদর্শ, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বৈশিষ্ট্য, ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতিসত্তা বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন, ইতিহাসে এই আদর্শের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যাবলি এবং নতুন এক গণতান্ত্রিক, লিঙ্গসাম্য, ধর্মীয় ও বিশ্বাসগত সম্প্রীতি, নাগরিক অধিকার, সমতা, সমান সুযোগ, নিরাপত্তা এবং কল্যাণ ও মানবিকতার অবিচল রক্ষাকবচসমূহ।

এখানে থাকবে না কোনো ধরনের বৈষম্য, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর পরিচয়। থাকবে না এ দেশের দেশপ্রেমিক মানুষদের মধ্যে রাজনৈতিক বা পররাষ্ট্রনীতিগত কোনো ভেদাভেদ। পদ্মায় বাঁধ দিয়ে জল আটকিয়ে বাংলাদেশকে মরুভ‚মি বানালে এবং বর্ষায় বদ্ধ জল ছেড়ে দেওয়ায় ভাসান বন্যা ঘটলে বাংলাদেশের হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান, সমতলবাসী, পাহাড়ি সবার জীবনেই নেমে আসছে এবং আসবে মহাবিপদ। সীমান্তে বিএসএফ গুলি চালালে সব ধর্মের সব জাত-পাতের মানুষই মরবে বা মরছে। গুলি কোনো ধর্ম চেনে না।

ভারত গত ৫২ বছর ধরে বাংলাদেশে যা করছে তাকে সম্প্রসারণবাদী-আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বললেও কম বলা হবে। ভারতের পুঁজিপতিরা একচ্ছত্রভাবে যে বাণিজ্যিক আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কোমর ভেঙে দিচ্ছে, তার সমান শিকার এ দেশের সব ধর্ম-বর্ণ গোত্র, জাত-পাতের সব মানুষ। কাজেই আমাদের সবাইকে এই সরল সত্যটা মানতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা একটা বিলিয়ন ডলারের কথা বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশ একটা পরিবার।’ বিশ্ব আজ দেখছে বাংলাদেশের মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা রাত জেগে লাঠি হাতে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘর-ব্যবসা পাহারা দিচ্ছে। সন্ত্রাস চালানো সব কটা পাণ্ডা ডাণ্ডাবেড়ি খেয়ে স্বীকার করছে আওয়ামী লীগ তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে তাদেরকে টাকা-পয়সা অস্ত্রপাতি দিয়ে নৈরাজ্য করতে লেলিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের জঘন্যতম স্বৈরাচার এই আওয়ামী-বাকশালীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে; আগুন দিয়েছে। হিন্দুদের ওপর চড়াও হয়েছে। আমাদের পরীক্ষিত ও প্রমাণিত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের হাত ভেঙে দিয়েছে। গোপালগঞ্জের ষড়যন্ত্র দেশ দুনিয়ার কাছে দেখিয়ে দিয়েছে নিষ্ঠুর পিশাচ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কোন লেভেল পর্যন্ত যেতে পারে। এ থেকে সাবধান হতে হবে।

সংবিধান এবং সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে কত কথা মনে এসে যাচ্ছে। হয়তো পাঠকের কাছে একটু অসংলগ্ন মনে হতে পারে। সেজন্য অপরাধ নেবেন না। আমি এখানে পশ্চিম বাংলার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও তার ঢাকাইয়া বাল্যবন্ধু ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী সাঁতারু ব্রজেন দাসের একটি স্মৃতি উল্লেখ না করে পারছি না। এই ঢাকারই সন্তান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার তার বাল্যবন্ধু ব্রজেন দাসকে লিখলেন, তার বড়ই ইচ্ছে করছে ঢাকায় আসতে। ব্রজেন দাস সারাটা দিন কাটাতেন ঢাকা ক্লাবে। কিন্তু থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। কবি বন্ধু ঢাকায় এলেন। ব্রজেন দাসও নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এলেন এবং তিনি কখনো বাস-টেম্পু-হলারে উঠতেন না। পায়ে হেঁটে এই আঠার কিলোমিটার রাস্তা ওই বয়সেও দিব্যি তরতরিয়ে চলে আসতেন। ব্রজেন দাস ঢাকা ক্লাবে এসে কবি বন্ধুকে উঠালেন। নাশতা করলেন। কবি বললেন, ব্রজেন, চল না সকালের মর্নিং ওয়াকও হয়ে যাবে, আমাদের সময়ের ফেলে আসা সেই চানখারপুল, নিমতলি, মিটফোর্ড, বাবুবাজার, নাজিরাবাজার, বেচারাম দেউড়িও দেখে আসা যাবে। বেরিয়ে পড়লেন দুই বাল্যবন্ধু। হাঁটতে হাঁটতে তারা যেই না ঢাকা মেডিক্যাল পর্যন্ত এলেন, দেখলেন ওই সাত সকালে ঢাকা মেডিক্যালের এমারজেন্সির সামনে একটা লম্বা মিছিল। সবার পরনে আলখেল্লা, মাথায় টুপি। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে গেলেন। কবি একটু এগিয়ে গিয়ে মিছিলের একেবারে সামনে এসে দেখলেন বাচ্চাগুলো প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বললেন, তোমরা এত সকালে এখানে? জবাবে শিশুরা বলল, বারে, আপনি শোনেননি? গতকাল আমাদের জগন্নাথ হলের ছাত্র ভাইরা ছাদ ভেঙে বহু ছাত্র মারাও গেছেন, এখানে চিকিৎসাও নিচ্ছেন। আমরা পাশের আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। আমরা আমাদের ভাইদের জন্য রক্ত দিতে এসেছি। কপালে হাত ঠেকিয়ে কবি তার বন্ধু ব্রজেন দাসকে বললেন, ‘এরা সেই ভাগ্যহত পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকের সন্তান, যাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্যের মূল্য আমরা কলকাতার বাবুরা কোনোদিন দিতে পারিনি আর পারব বলেও মনে হয় না।’
কথাগুলো বলতে বলতে কবি নাকি শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। আসলেই এরা সেই পূর্ববঙ্গের ভাগ্যহত কৃষকের সন্তান। ইতিহাস এদের প্রতি কখনোই সুবিচার করেনি। এদের ‘হৃদয়ের ঐশ্বর্যের’ মূল্য বাবুরা কোনো দিন দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিপন্থী মিডিয়া আজো যেভাবে কথা বলছে, তাতে কবির সেই কথাটিই বারবার মনে পড়ছে।
ওদের উদ্দেশ্যে বলছি, দয়া করে নতুন বাংলাদেশের অজেয় তারুণ্যকে বুঝতে চেষ্টা করুন। এরা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জেনারেশন। এরা জিন্স-টি শার্ট পরে। আবার মিছিলে, রণাঙ্গনে যেই না আজান শোনে স্রেফ প্যান্টের ঝুলটা গুটিয়ে ওদের মধ্যেই একজন ইমামতি করতে দাঁড়িয়ে যায়। অন্যরা তার পেছনে কাতার বেঁধে বলে ‘আল্লাহু আকবার’।
বাংলাদেশের এই নবীন তারুণ্য ফিলিস্তিনিদের দেশপ্রেম থেকে শিখেছে। নতুন এক বাংলাদেশের এরাই আসল স্থপতি। এদের বুঝতে না পারলে বুঝতে হবে, আমরা এতটাকালে কিছুই বুঝিনি- কিছুই শিখিনি।


আরো সংবাদ



premium cement