বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধার
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৩
দেশের পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বন্যদুর্গত জেলাগুলোতে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। জাতিসঙ্ঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিসের তথ্য মতে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ৫৯ লাখের বেশি মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বন্যায় ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব শিশুর বড় অংশ এখনো অভিভাবকদের সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করছে।
বিগত ৩৪ বছরে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা। বলা যায়, অনেকটা হঠাৎ করে তলিয়ে গেছে দেশের ১১ জেলা। কারো কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ফলে ঘরবাড়ি, সহায়সম্বল ফেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছোটে মানুষ। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ সেই সুযোগও পায়নি। এসব অঞ্চলে নিজ বাড়িতে আটকা পড়ে লাখো মানুষ। কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারলেও অনেকে নিরুপায় হয়ে বাড়ির ছাদ, টিনের চাল বা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে। এখনো বহু মানুষের অবস্থা বড়ই সোচনীয়। খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। রাত নামলে বিদঘুটে অন্ধকার আর সুনসান নীরবতায় দিন কাটাচ্ছে তারা। বন্যার পানি এখন নামতে শুরু করেছে। এতে আরেক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে।
পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের খামার। ভেসে গেছে গৃহপালিত ও খামারের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, আসবাবপত্র। পানির তোড়ে অনেকের বাড়িঘরও ভেঙে গেছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব এসব মানুষ এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বহু সড়ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মেরামত করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে।
আকস্মিক বন্যায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে এক কাপড়ে। সে ক্ষেত্রে তাদের খাবারের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এসব এলাকায় কিভাবে সংযোগ দেয়া যায়, তা জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার দিকে সরকারের মনোযোগ দেয়া উচিত।
ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এসব এলাকায় ক্ষতি কী যে ব্যাপক আকারে হয়েছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। ক্ষতি হয়েছে রোপা আমন, মাছের ঘের ও পোলট্রি খামারের। বন্যা-পরবর্তী সহায়তা ও পুনর্বাসনে গুরুত্ব দিতে হবে। এ এলাকাগুলোতে যে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।
সে দিন ফেনীর এক বন্যার্ত মহিলার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ও ছেলের গায়ের জামা ছাড়া কিছু নেই, এমনকি পায়ের জুতাও বানের পানিতে আসতে ছিঁড়ে গেছে। ঘরের খাট, তোষক, ফ্রিজ, আলমিরাহ এমনকি আমার অনেকগুলো মোরগ-মুরগি ও হাঁস ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন কী করে চলব, তাই ভেবে ভেবে অস্থির! এমনি হাজারো সমস্যা, কৃষকের বীজতলা ধ্বংস, পুকুরের মাছ, সবজিচাষির দুঃখের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।
জীবনহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির যে ভয়াবহ চিত্র তা উপলব্ধি করে, জরিপ করে পুনর্বাসন ও মেরামত এবং অর্থায়নের মাধ্যমে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসে নানা সংস্থা, সংগঠন ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীরা। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন আর্তমানবতার সেবায়। এ দেশে এমন অনেকে আছেন, যাদের দুঃখী মানুষের জন্য দরদ আছে। দুই দিন আগে যে ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছেন, আজ তারা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ জোগাচ্ছেন।
সন্ত্রাসী, জালেম, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে সম্মিলিতভাবে জনগণকে নিয়ে মাঠে ছিলেন তেমনি বন্যার্তদের দুর্দিনেও তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন পুনর্বাসনে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
এখন সমস্যা হলো- ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অনেকে পলাতক, গা ঢাকা দিয়েছেন। ফলে এ দুর্যোগের মুহূর্তে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিদের শূন্যস্থান কিভাবে পূরণ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। কৃষিবহির্ভূত ক্ষুদ্র্র কারখানা ও কুটিরশিল্পও থেমে গেছে। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে।
বন্যায় কৃষি খাতের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা দৃশ্যমান। অনেক এলাকায় পাকা আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমন ধানের ক্ষেত সবই ডুবে গেছে। বিভিন্ন সবজি যেমন- মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পটোল, ঢেঁড়স, করল্লা, ঝিঙে, বেগুন এবং মসলা ফসল- হলুদ, মরিচ তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
তেলজাতীয় ফসল- চীনাবাদাম, তিল, সূর্যমুখী পানির নিচে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদা, লটকন, ড্রাগন ফল বিনষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষ করা মাছ।
বাড়িতে পালিত হাঁস-মুরগি মরে গেছে। গবাদিপশু খুব কম বেঁচে আছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বড়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের বন্যায় ৬৮ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন-পৌরসভা ৫০৪।
১১ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৩ লাখ ছয় হাজার ৪০২। পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে তিন হাজার ৮৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। সেখানে তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৪২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ৩৪ হাজার ৫১৮টি গবাদি পশু আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে ৫১০টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে।
বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো, খাদ্য ও পানির সঙ্কট এবং রোগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিচ্ছে। এ মানসিক সমস্যাগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যদি তা সময়মতো মোকাবেলা না করা হয়, বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতি যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে; তা পুনরুদ্ধারে যদি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে দরিদ্র ও বেকারত্বের হার আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। যা কারো কাম্য নয়। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি উন্নয়নে, গ্রামীণ অর্থনীতি টেকসই করতে এবং সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, মাছচাষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্রঋণের সুদ মওকুফ বা সুদের হার কমানোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে যত দ্রুত সম্ভব স্থায়ী পুনর্বাসন যাতে শুরু করা যায় সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, এনজিও , দাতা সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে স্বচ্ছতার সাথে দুর্গতদের পাশে এগিয়ে এলে বৈষম্যহীন সমাজ, সুখী সমাজ ও সুষম অর্থনীতি উপহার দেয়া সম্ভব।
লেখক : অর্থনীতির বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা