নয়া থাই প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন শুরুতেই সঙ্কটে
- আহমদ মতিউর রহমান
- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:২৫
থাইল্যান্ডে সম্প্রতি বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। বিদায় নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ¯্রথো থাভিসিন। দেশটির সাংবিধানিক আদালত তাকে বরখাস্ত করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। ৩৭ বছর বয়সী পেতংতার্ন হলেন দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে তার ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে পেতংতার্নের দল ফেউ থাই পার্টি দ্বিতীয় হয়েছিল। তবে তারা জোট সরকার গড়ে তোলে। পেতংতার্ন হলেন গত দুই দশকে থাইল্যান্ডে সিনাওয়াত্রা পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া চতুর্থ ব্যক্তি। অন্য তিনই সেনা অভ্যুত্থান কিংবা সাংবিধানিক আদালতের রায়ে ক্ষমতাচ্যুত হন।
এই রাজনৈতিক বাঁক বদল কি কারণে? দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে একবার কারাগারে যাওয়া এক প্রাক্তন আইনজীবীকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেয়ার কারণে দেশটির সাংবিধানিক আদালত গত ১৫ আগস্ট মি. থাভিসিনকে বরখাস্ত করে। বলা হয়, এই নিয়োগের মধ্য দিয়ে তিনি ‘নৈতিকতার নিয়ম লঙ্ঘন’ করেছেন। পাশাপাশি তার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ারও রায় দেয় আদালত। পরদিন প্রধানমন্ত্রী পদে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে পেতংতার্নের নাম ঘোষণা করে ফেউ থাই পার্টি। স্রেথা ও পেতংতার্ন দুজনই ফেউ থাই পার্টির নেতা। এর দুইদিন পর পেতংতার্নকে নিয়োগ দেয়া হয়। সমস্যা হলো দেশটির সাংবিধানিক আদালত খুবই পাওয়ারফুল একটি সংস্থা। অনেকগুলো সরকারকে বিদায় করেছে এই আদালত। আদালতের হস্তক্ষেপে এর আগে পেতংতার্নের দলের চারটি সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। কথা হচ্ছে, পেতংতার্নও ভবিষ্যতে এমন সঙ্কটে পড়বেন না তা হলফ করে বলার উপায় নেই। পেতংতার্ন তা জানেন। ১৫ আগস্ট পেতংতার্ন বলেছিলেন, তিনি মি. থাভিসিনের বরখাস্তের বিষয়টি জানতে পেরে ‘খুব মর্মাহত’ হয়েছিলেন। মি. থাভিসিন ও নিজের পরিবারের সাথে কথা বলার পর মিজ পেতংতার্ন সিদ্ধান্ত নেন ‘দল ও দেশের জন্য কিছু করার থাকলে তিনি তা করবেন। এখন সে সময় এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
থাইল্যান্ডের স্কুল এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন পেতংতার্ন। সিনাওয়াত্রা পরিবারের মালিকানাধীন রেন্ডে হোটেল শিল্পগোষ্ঠীতে কয়েক বছর কাজ করেছেন তিনি। তার স্বামী ওই শিল্পগোষ্ঠীর উপপ্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা। ২০২১ সালে তিনি ফেউ থাই পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে দলের নেতা নিযুক্ত হন। তার নিয়োগ থাইল্যান্ডের শীর্ষ নেতৃত্বে নতুন শক্তি এনেছে। ফেউ থাইয়ের সদস্যরাও হয়তো আশা করছেন, তিনি দলের রাজনৈতিক ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারেন।
২০২৩ সালের ১৪ মে থাইল্যান্ডে ৫০০ সদস্যের প্রতিনিধি পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনীতিতে নবাগত পিটা লিমজারোয়েনরাতের নেতৃত্বে দ্য মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি সবচেয়ে বেশি আসন জিতে বিশ্লেষকদের বিস্মিত করে। তারা পায় ১৫১ আসন। ১৪০ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয় ফেউ থাই পার্টি। এই দল ২০১১ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছিল। ২৩ সালে ভোট পড়ে রেকর্ড ৭৫.২২ শতাংশ। নতুন দল ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি পায় ৩৬ আর ভুমজাইথাই পার্টি ৭১ আসন পায়।
আগেরবারের থেকে ২০টি আসন বেশি। সামরিক জান্তা সমর্থিত দল পালং প্রচারত পায় মাত্র ৪০টি আসন। আগের নির্বাচনের চেয়ে ৭৬ আসন কম। থাইল্যান্ডে সরকার গঠনের জন্য দরকার ২৫১ আসন। কোনো দলই সেটি না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান প্রায়ুথ প্রানওচা। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি রয়েল থাই আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর ন্যাশনাল কাউন্সিল অব পিস অ্যান্ড অর্ডার নামক পরিষদ গঠন করে ৯ বছর ক্ষমতায় থাকেন। তারপরই ২৩ সালে নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে ৭৭টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল জোট সরকার মিলিটারি সিভিলিয়ান সমন্বয়ে গঠিত পালং প্রচারথ, ভুমজাই থাই, ডেমোক্র্যাট দলগুলো এবং নতুন ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টিসহ ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল জোট সরকার। নতুন থাই নেশন দলের নেতা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জান্তা নেতা প্রায়ুথ চান ওচা। তার পুরনো দল পালং প্রচারথ আলাদাভাবে নির্বাচন করে। গণতন্ত্রপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে ছিল ফেউ থাই এবং মুভ ফরোয়ার্ড দল। মুভ ফরোয়ার্ড দল হলো ভেঙে দেয়া ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির কার্যকর উত্তরসূরি, যেটি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো ফল করেছিল। পিটার নেতৃত্বাধীন মুভ ফরোয়ার্ড গণতন্ত্রপন্থী, সামরিকবিরোধী দলগুলোর সাথে জোট গঠন করেছিল। তাদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল কিন্তু সিনেটে রাজতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনীর মিত্রদের দ্বারা কার্যকরভাবে অবরুদ্ধ হওয়ার পর সরকার গঠন করতে পারেনি। ফেউ থাই তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করে। মুভ ফরোয়ার্ডের সাথে তার জোট ভেঙে দেয় এবং রক্ষণশীল সামরিকপন্থী দলগুলোর সাথে মিত্রতা করে। এরপর দলটি রিয়েল এস্টেট টাইকুন স্রেথা থাভিসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে। তিনি ২২ আগস্ট ২০২৪ সংসদ দ্বারা নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক সঙ্কটের ফলে সরকার গঠনে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। বছরখানেক পর ৭ আগস্ট ২০২৪-এ থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত তার সরকারকে বরখাস্ত করে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্নের সামনে কী অপেক্ষা করছে? বয়সে ও অভিজ্ঞতায় কম মিজ পেতংতার্ন কি সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন, এসব প্রশ্ন আসছে সামনে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন থাইল্যান্ডের স্থবির অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর মতো কঠিন কাজের মুখোমুখি তার সরকার। ১০০ দিনের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হলেই এসব বিষয়ে তুল্যমূল্য হবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে বরখাস্তের অভিশাপ নিয়ে ফিরে যেতে হবে। নতুন নির্বাচনের বিষয়টিও সামনে আসতে পারে। আর সামরিক অভ্যুত্থান সামাল দেয়া এবং আদালতের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে টিকে থাকাটাও তার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ দেশটিতে এ দু’টি কর্নার থেকে হস্তক্ষেপ ঘটে থাকে অহরহ। পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে তার পক্ষে ৩১৯ ভোট পড়েছে। আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ১৪৫টি। সমর্থনের দিক থেকে তিনি ভালো অবস্থানে আছেন। তবে রাজনীতির পাশা খেলায় এই দান উল্টে যেতে সময় লাগে না।
পেছন থেকে বাবা মি থাকসিন পেতংতার্নকে পরিচালনা করবেন, এমনটি মনে করা হচ্ছে। ব্যাংককের বিশ্লেষকরাও তাকে ফেউ থাই পার্টির ডি-ফ্যাক্টো নেতা বলে মনে করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর পেতংতার্ন বলেন, তার বাবা মি. থাকসিন তাকে ‘নিজের সেরাটা দিয়ে’ কাজ করার উৎসাহ দিতে ফোন করে বলেছেন, তিনি তার বৃদ্ধ বয়সে এসে মেয়েকে এই দায়িত্ব পেতে দেখে উৎফুল্ল। পেতং বলেন, আমি সত্যিই আশা করি যে, আমি মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস পুনঃস্থাপন করে দিতে পারব, সব থাই জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে আমরা সুযোগ তৈরি করতে পারি।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, এগুলো রাজনীতির মেঠো বক্তৃৃতা। বাস্তব বড় কঠিন। বাবার সহযোগিতা তাকে খানিকটা সহযোগিতা করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সামরিক বাহিনীর খাড়া ও সাংবিধানিক আদালতের চোখ রাঙানি তাকে কতখানি স্বস্তি দেবে তা এখনই বলা কঠিন। দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে তাকেও ভুগতে হবে।
সাত কোটি লোকের দেশ থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটির সঙ্কট আঞ্চলিক সঙ্কটকেও উচ্চকিত করতে পারে। সহসাই অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরানো কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ দিকে ব্যাংকক পোস্ট অনলাইনের খবর, পেতংতার্ন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়েই জোটসঙ্গীদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। পালং প্রচারথ পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেল এবং বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষিমন্ত্রী থামানাত প্রম্পো সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, তিনি পার্টির নেতা জেনারেল প্রবিত ওংসুওনের সাথে বিবাদের কারণে দল ছাড়ার কথা ভাবছেন। পালং প্রচারথ পার্টি নেতা প্রবিত এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল থামানাতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দলটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে। থামানতের নাম মন্ত্রিসভার মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ পড়ার পরে দল ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলের চারটি মন্ত্রি পদের কোটা রয়েছে এবং জেনারেল প্রবিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশমন্ত্রীর পদে তার ছোটভাই জেনারেল ফাচারভাত ওংসুওয়ানকে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। থামানাতের অংশের কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন। ১৯৯০ সালের একটি মামলায় সাজা ভোগের কারণে থামানাতকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ তিনি থাকলে মন্ত্রিসভা আগের সরকারের মতোই বরখাস্ত হওয়ার শঙ্কার মধ্যে পড়তে পারে। এটি নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি জ্বলন্ত সমস্যা। পত্রিকাটি আরো জানায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে বিরোধ দূর করতে জেনারেল প্রবিথের সাথে দেখার খবর অস্বীকার করেছেন। জেনারেল প্রবিত ও ক্যাপ্টেন থামানাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব একটি নতুন সরকার গঠনে বিলম্ব করবে কি না জানতে চাইলে থাকসিন বলেন, ফেউ থাই মন্ত্রিপদের জন্য মনোনয়ন প্যানেল গঠন করে অগ্রসর হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, শুরুতেই সঙ্কট দৃশ্যমান। জোটের অন্যান্য দলের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে এই সঙ্কটের পথ ধরে বড় সঙ্কট সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা