২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি

আওয়ামী লীগের প্রতীক - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রধান দল ও শক্তি। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। তারিখটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়লাভের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। পাশাপাশি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যও দিনটি অত্যন্ত কলঙ্কের। সেদিনটি আওয়ামী লীগ কেন বেছে নিয়েছিল তা তখনকার উদ্যোক্তা নেতারা বলতে পারবেন।

আওয়ামী লীগ মূলত পাকিস্তান মুসলিম লীগের একটি অংশ, যা ভিন্ন দলরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের সবাই দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি নতুন দলের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে দলটি গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তখন সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ তাদের মধ্যে ছিল না। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সংখ্যালঘু প্রধানত হিন্দুদের সমর্থন লাভের আশায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। একপর্যায়ে সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা দেখে তার দিকেও ঝুঁকে পড়ে।

১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এতে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত বিশাল দেশ এবং পারমাণবিক শক্তিধর। ভারত মহাসাগরে এর প্রভাব অনেক। দেশটির অর্থনীতি বাংলাদেশের তুলনায় নানাদিক থেকে এগিয়ে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চার হাজার মাইলের বেশি সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। সুতরাং স্থায়ী প্রতিবেশী ভারতকে উপেক্ষা করে চলার মতো অবস্থা বাংলাদেশের নেই। আওয়ামী লীগ শুরু থেকে ভারতের প্রতি অনুরক্ত একটি দল। দলটির এ নীতি ঐতিহাসিক কারণে এ দেশের হিন্দুদের কাছে বেশ গ্রহণীয়। আওয়ামী লীগ শুধু ভারত নয়, সে দেশের জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করে থাকে। অবশ্য নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলে ওই সরকারের সাথেও একই মাত্রায় সম্পর্ক দেখা যায়। এমনকি ভারতের আনুকূল্য ও হিন্দুদের সমর্থনের কথা দলটি নিঃসঙ্কোচে প্রচারও করে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে বিবেচনা করা হয় স্বাধীনতার স্থপতি ও ‘জাতির পিতা’ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের ও প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সংবিধানে বর্ণিত চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে তাদের দলীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল গঠনের পর একজন শিক্ষাবিদ ওই চারটি মূলনীতিকে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ভাবিত আদর্শ উল্লেখ করে তাকে ‘মুজিববাদ’ বলে আখ্যায়িত করে একটি বই লেখেন। অবশ্য দলীয় আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে দলটি স্থির থাকেনি।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ : বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিভাষার তাৎপর্যগত মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উপজাতিদের ‘বাঙালি’ হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের বাঙালি বলে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে একটা বড় ধরনের ভুলের সূচনা করা হয়েছিল।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা : ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলে নতুন দেশ কোন নীতি ও মূল্যবোধ নিয়ে পরিচালিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ‘গণতন্ত্র’কে গ্রহণের বিষয়ে কারো কোনো মতপার্থক্য ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। এ জন্য তাকে বহু নির্যাতন ও কারাভোগ করতে হয়েছে।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র যথাযোগ্য স্থান পাবে, এটা ছিল স্বাভাবিক ও সময়ের দাবি। শেখ মুজিব স্বাধীনতার সনদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্ত আইনগত ক্ষমতাবলে দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। তদনুসারে ১৯৭২ সালের ১১ জানয়ারি একটি রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন সাধন করা হয়। এভাবে বাংলাদেশ সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। (মওদূদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল)

সমাজতন্ত্র : ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগের সূচনালগ্ন থেকে দলীয় নীতিতে ‘সমাজতন্ত্র’ ছিল না। পরে যোগ করা হয়। পাকিস্তান আমলে পরিভাষাটি তেমন একটা ব্যবহার করা হতো না। ৬ দফায় সমাজতন্ত্র ছিল না। তবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিব ও তার দল সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের হাত দিয়ে সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিও চালু করে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর প্রায় সবাই তাতে অংশ নেয়। চীন ব্যতীত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার প্রভাব বলয়ের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা করে। ভারতে কংগ্রেস সরকার ও তার নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সোভিয়েত ব্লকের সুসম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। অন্য দিকে পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সোভিয়েত ব্লকের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করে। সৌদি আরবও একই পথ অনুসরণ করে। মুসলিম দেশগুলোর সামনে বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা বিয়োগাত্মক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও পাকিস্তানের বন্ধু ও সোভিয়েত বিরোধী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। অবশ্য চীনপন্থী বাম দলগুলো মতপার্থক্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ভারতও চীনপন্থীদের অস্তিত্ব নির্মূলে উৎসাহী ছিল।

যাই হোক, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে বন্ধু হিসেবে কাছে পায়। অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ময়দানেও প্রায় সব দল সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল। ভারত পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও ইন্দির গান্ধী সমাজতন্ত্রের অনুরাগী ও বন্ধু ছিলেন। আর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। এরূপ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব কৌশলগত কারণে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। সমাজতন্ত্রের অর্থ কেবল শিল্পের জাতীয়করণ ছাড়া অন্য কিছু ছিল বলে মনে হয়নি। মুজিব সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে নয়-বরং ক্ষমতা সংহত করার কাজে লাগাতে অধিকতর সচেষ্ট ছিলেন। পরে তার গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে তা প্রমাণিত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র পরস্পরবিরোধী। তা সত্ত্বেও মুজিব এ জগাখিচুরি নীতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি। এমনকি তার অতি উৎসাহী ভক্তরা পরস্পরবিরোধী গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের সাথে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মিলিয়ে ‘মুজিববাদ’ নামে এক নতুন মতবাদ দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেয়।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ : ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং অধিকাংশ বাম দল দাবি করে যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সেকুলারিজমের জয় হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির দর্শন দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়।

বাংলাদেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও লেখক বলে থাকেন, পাশ্চাত্যে সেকুলারিজম বলতে যা বুঝায় বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ঠিক তা বুঝায় না। তারা মনে করেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; বরং সব ধর্মের সহঅবস্থান, সব ধর্মের প্রতি সমান আচরণ ইত্যাদি। তাদের মতে, ‘প্রকৃত কথা হলো, ধর্ম তার নিজস্ব ক্ষেত্রেই বিচরণ করবে, রাজনীতির দেয়াল ডিঙ্গিয়ে অনধিকার প্রবেশ ঘটাবে না।’ (অধ্যাপক মুয়াযযাম হুসাইন খান, মুজিববাদ)
আবুল মনসুর আহমদ মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মবিরোধীও নয়, ধর্মহীনও নয়। তিনি আরো মনে করেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেয়ে বর্ণনা করা অধিকতর নিরাপদ; তার চেয়ে উত্তম তাকে অনুধাবন করা। তবে তার এ ব্যাখ্যার সাথে সবাই একমত নয়।

লেখক : গবেষক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব


আরো সংবাদ



premium cement