২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পুলিশ বাহিনীর সংস্কার : প্রস্তাবনা ও পরামর্শ

পুলিশ বাহিনীর সংস্কার : প্রস্তাবনা ও পরামর্শ - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের কার্যক্রম বিশেষত বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করার কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়ে পুলিশের ‘চেইন অব কমান্ড’। দলীয়করণের মাধ্যমে পুলিশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পেশাদারিত্ব ছিল না।

ইতিহাসের পাতায় বাংলা অঞ্চলে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগে পুলিশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ মনুসঙ্গহীতা, চিত্রলিপিতে সম্রাট অশোক এবং প্রখ্যাত ভ্রমণকারীদের সূত্র থেকে পুলিশের প্রাচীন খণ্ডিত ইতিহাসের খোঁজ মেলে। এ ছাড়াও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরবৃত্তির ৯টি ধরন উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় পুলিশি কাজ ছিল তথ্য সংগ্রহ করা, রাজ্যবিরোধী কার্যক্রমে নজরদারি, সরকারি কাজে প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং সমাজের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। গুপ্তচর দায়িত্ব এমনভাবে পালন করত যে, তারা সেনাবাহিনী, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের কার্যকলাপের ওপরও নজরদারি করত। এ জন্য লোভ এবং উসকানি দেয়ার জন্য অর্থ ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগের পুলিশি ব্যবস্থা শেরশাহ শুরি দ্বারা প্রবর্তিত হয় এবং সম্রাট আকবরের সময়কালে এই ব্যবস্থা আরো সংগঠিত হয়। সম্রাট আকবর তার প্রশাসনিক কাঠামো তিন ভাগে ভাগ করেন : মীর আদাল, কাজী ও কোতোয়াল। কোতোয়াল বলতে প্রধান বড় শহরের পুলিশ কর্মকর্তাদের বুঝাত। সে সময় কোতোয়ালি পুলিশ ব্যবস্থা ঢাকা শহরের মধ্যেও বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমানেও বাংলাদেশের অনেক জেলা সদর পুলিশ স্টেশনকে কোতোয়ালি থানা বলা হয়। মোগল আমলে কোতোয়াল একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়।

১৮২৯ সালে ব্রিটেন পার্লামেন্টে পুলিশ গঠনসংক্রান্ত একটি বিল আনা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় লন্ডন মেট্রো পুলিশ। সেই সময় পুলিশের অপরাধ দমন বা প্রতিরোধের সাফল্য ইউরোপের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩৩ সালে লন্ডন মেট্রো পুলিশের অনুকরণে নিউইয়র্ক সিটিতে গঠিত হয় নগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ। ১৮৫৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। পিপলস অ্যাক্ট-১৮২৯ এর অধীনে গঠিত লন্ডন পুলিশের আদলে ব্রিটিশ সরকার ভারতেও স্বতন্ত্র পুলিশ ফোর্স গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮৬১ সালে the commission of the Police Act (Act V of 1861) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়। ওই আইনের ফলে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। প্রদেশ পুলিশ প্রধান হিসেবে একজন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসেবে সুপারিনটেনটেন্ড অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করা হয়।

ব্রিটিশদের তৈরি করা এই ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশ পুলিশে প্রবর্তিত আছে। পাকিস্তান শাসনামলে প্রথমে বাংলাদেশ পুলিশের নাম রাখা হয় ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ নাম ধারণ করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে সারা দেশে পুলিশ সদস্যরা দীর্ঘ ৯ মাস সম্মুখযুদ্ধে ও গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং পাকসেনাদের চোখে চোখ রেখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে ১২৬২ জন পুলিশ সদস্যের শহীদ হওয়ার তালিকা পাওয়া যায়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যরা ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ নামে সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্রিটিশ আমলে ১৮৬১ সালে প্রণীত আইন দিয়ে চলছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী।

মূলত জনগণকে শাসন করার মানসিকতা থেকেই প্রণীত হয়েছিল ১৮৬১ সালের আইনটি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের পুলিশের নাম প্রথমে ‘ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ’ রাখা হয়। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’ নাম ধারণ করে। একাত্তরের পর বাংলাদেশ পুলিশ নামে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি রঙের। ২০০৪ ও ২০১৬ সালে পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙ পরিবর্তন করা হয়েছিল। মহানগর ও জেলা পর্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেয়া হয়েছিল। আবার পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতা রয়েছে। পুলিশের এসব সংস্কারে বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পুলিশের সংস্কারের জন্য ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭’ প্রস্তাব করে পুলিশ সদর দফতর। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে- রাজনৈতিক চাপে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত কাউকে দুই বছরের আগে বদলি করা যাবে না। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা যেকোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোনে সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যাবে না। বিদ্যমান আইনগুলোর ব্যবহারসহ এ ধরনের ঘটনায় তদন্ত করার এখতিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ক্রসফায়ার, অ্যানকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে কারো মৃত্যু হলে তা আইনসঙ্গত ছিল কি-না তা তদন্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

এসব ক্ষেত্রে খসড়া প্রস্তাবে ১১ সদস্যের জাতীয় পুলিশ কমিশন, পাঁচ সদস্যের স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে দ্রুত সাজা দেয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবটি ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় পর্যালোচনা কমিটি। কমিটি অধ্যাদেশের ২৩টি ধারাসহ কয়েকটি উপধারার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তার মধ্যে ছিল আইজিপি নিয়োগ প্রক্রিয়া, এএসপি নিয়োগ, সরকার কর্তৃক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা না থাকা, পুলিশ প্রশাসনের ক্ষমতা, ইউনিট প্রধানের ক্ষমতা, পুলিশের আইন উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, জেলা পুলিশ সুপারের ক্ষমতা, জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন, পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি, পুলিশপ্রধানের ক্ষমতার বিধান। পরে হাসিনা সরকারের আমলেও এ অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান। হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে বিদ্যমান পুলিশ বাহিনীর ওপর তৈরি হয় অনাস্থা ও সন্দেহ। পুলিশ বাহিনীর অধস্তন সদস্যরাও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, তারা তাদের ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করার আদেশ দিয়ে হাসিনা পতনের পর কোনো নির্দেশনা না দিয়েই পালিয়ে যায়। ফলে ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে অনেক অধস্তন পুলিশ সদস্য আহত-নিহত হন। বাংলাদেশ পুলিশ বৈষম্যবিরোধী কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু দাবি উত্থাপিত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান দাবি হচ্ছে- স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, যা বাস্তবায়িত হলে পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে বলে আশা করা যায়।

ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের বর্বরোচিত ভূমিকা এ বাহিনীর সংস্কারের প্রয়োজনকে আরো তীব্র করে তুলেছে। ইতোমধ্যেই পুলিশের পোশাক ও মনোগ্রাম পরিবর্তন করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ বাহিনীর মূল সমস্যা হচ্ছে এর রাজনীতিকীকরণ। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা দুই লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) পদে যথাক্রমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৯২৫ জন এবং সাড়ে ১১ হাজার। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অর্ধেকের বেশিই নিয়োগ পেয়েছেন হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে। নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের বড় অংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন।

এ ছাড়া স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে যে বিরাটসংখ্যক নিয়োগ হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও নিয়োগের আগে পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় খতিয়ে দেখা হয়েছে। এই রাজনীতিকীকৃত পুলিশ বাহিনীকে আওয়ামী সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে প্রায় সব স্পটে পুলিশ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। নিয়মবহির্ভূত প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এ জন্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশের গুটিকয়েক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাই দায়ী। হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়া মাত্র ওই সব কর্মকর্তা দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান। সেজন্য পতনের পর সাত দিন পুলিশকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে বাহিনীটিকে সচল করতে নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ও বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।

কোনো দেশে আইনের শাসন জারি রাখতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর সে জন্য পুলিশ বাহিনীকে হতে হবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, যাতে কোনো অপরাধী রাজনৈতিক যোগসূত্রের অজুহাতে আইনের হাত থেকে রক্ষা না পেতে পারে। জনগণ হয়তো বাধ্য হয়ে পুলিশের কাছে যায়, কিন্তু পুলিশ আন্তরিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে এমনটি জনগণ বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় জনতা ও পুলিশ যেরকম মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর পূর্বাবস্থা জারি রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।

পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগের ইতিহাস যেখানে অনেক পুরনো, সেখানে পোশাকের রঙ এবং মনোগ্রাম পরিবর্তন এবং কিছু প্রশাসনিক পদের সংস্কার ও রদবদল করলেই পুলিশ বাহিনীর প্রকৃত সংস্কার সাধিত হবে- এমন ভাবা হবে বোকামি। পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হলে কেবল এর একার সংস্কারই যথেষ্ট নয়। এই সংস্কারকে হতে হবে বৃহত্তর প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ। প্রশাসনের অন্যান্য বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন অংশ যদি দুর্নীতিতে জর্জরিত থাকে, তবে পুলিশ বাহিনী থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ হবে সুদূরপরাহত। তাই সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনী ও বৃহত্তর পরিসরে পুরো প্রশাসনকে নীতি-নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে হবে। প্রকৃত অর্থে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে :

পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির জন্য কেন্দ্রীয় স্বাধীন কমিশন গঠন করা। এ কমিশন সরকার প্রধান, বিরোধীদলীয় প্রধান এবং প্রধান বিচারপতির সম্মিলিত সিদ্ধান্তক্রমে গঠিত হবে। এ কমিশনের আওতায় কনস্টেবল থেকে এএসপি পর্যন্ত নিয়োগ দিতে হবে।

নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না। একই সাথে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় নৈতিক মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখা।

পুলিশ ট্রেনিং ম্যানুয়ালের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত করা। প্রত্যেক থানায় নিয়মিত (মাসিক/দ্বিমাসিক/ত্রৈমাসিক) পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী নৈতিক প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামাদির ব্যবস্থা করা।

প্রত্যেক জেলায় জেলা জজ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে একটি করে হুইসেলব্লো সেল গঠন করা, যেখানে কোনো পুলিশ সদস্য অন্য কোনো পুলিশ সদস্যদের অনৈতিক কিংবা বেআইনি কার্যক্রমের ব্যাপারে প্রমাণসহ অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে। মামলার আলামত সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক উপজেলায় কমপক্ষে একটি এভিডেন্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে সংগৃহীত আলামতগুলোর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেক থানায় একজন করে ফরেনসিক এক্সপার্ট নিয়োগ দেয়া।

ঔপনিবেশিক যুগে প্রবর্তিত পুলিশ আইনকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা। পুলিশের মধ্যে প্রাণঘাতী নয় (non-lethal) এমন আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি করা। প্রত্যেক থানায় ২৪ ঘণ্টা কলসেন্টার সেবা চালু করা। প্রত্যেক জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক মহিলা থানা চালু করা। ইউনিয়ন/গ্রামপর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং সিস্টেম চালু করতে হবে। এদের সাথে অবশ্যই মূল পুলিশের সমন্বয় থাকতে হবে।

পুলিশ বাহিনী ধারাবাহিকভাবে নিজেদের কাজকর্মে সততা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই দেশের অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। এভাবেই দেশ শান্তি-শৃঙ্খলা এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। পুলিশ বাহিনীর ব্যাপক সংস্কার এ সমুচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। আর এভাবেই পুলিশ বাহিনীর সব দুর্নাম-অপবাদ দূর করে দেশের পুলিশ হয়ে উঠতে পারে জনগণের আস্থা, নিরাপত্তা ও সম্মানের একটি বিশ্বস্ত প্রতীক।

লেখক : এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড থটস (CAST)


আরো সংবাদ



premium cement