২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অন্তর্বর্তী সরকার : নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার : নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ - ছবি : সংগৃহীত

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় গত ৮ আগস্ট। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকেই তিনি ও তার সরকার নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পুলিশ বাহিনীর নির্বিকার আচরণ, বিরূপ সিভিল প্রশাসন তো আছেই, এর সাথে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের গত ১৫ বছরের বঞ্চনা নিরসনের আবেদন। দেখা গেল, গ্রাম পুলিশের সদস্যরা ঢাকার মন্ত্রীপাড়া দখল করে তাদের দাবিদাওয়ার আন্দোলন করছেন। এর আগে আনসার-ভিডিপির সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার মানুষও দাবি তুলেছেন। আন্দোলন করে উপদেষ্টা পরিষদের আশ্বাস নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এসব মানুষের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের দাবিগুলো পূরণ করে না নিলে আর কোনো দিন পূরণ হবে না। এরপর যে পথে নামবে সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, তা অনুমান করার কষ্টকর নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় সম্পূর্ণ একটি হযবরল অবস্থার মধ্যে, যখন দেশের প্রায় সব ক’টি প্রতিষ্ঠান নির্বিচার দলীয়করণের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর সাথে যোগ হয় পতিত স্বৈরাচারের উচ্ছিষ্টভোগী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ষড়যন্ত্র, যারা মদদ পাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও তার অনুগত এদেশীয় অনুচরদের। সাবেক স্বৈরশাসক আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এবং তার নির্বোধ সন্তান আমেরিকা থেকে গরম গরম অসত্য কথা ও আশার বাণী শুনিয়ে এ দেশে তাদের রেখে যাওয়া অনুচরদের মাধ্যমে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়েছে।

নতুন সরকার শপথ নেয়ার আগেই বাংলাদেশে অবস্থানরত পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গী বা সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের মিথ্যা অপপ্রচার সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। ভারতের ‘মোদি মিডিয়াও’ এই অপপ্রচারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে নতুন সরকারকে প্রথম দিনেই ব্যাকফুটে চলে যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনূস অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে ও সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলে সত্যটাকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবিলম্বে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন, দেরি করলে তিনি অপপ্রচারের বিষয়টি তিনি মিস করবেন। এ দিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রেসার গ্রুপ, ‘বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ’ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনবিষয়ক সংবাদকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে।

স্বৈরাচারী হাসিনার মূল অপপ্রচারকারীদের সবাই পালিয়ে যাওয়ার কারণে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন এ দেশের এক অখ্যাত অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী (যিনি মূলত আলোচিত তার সাবেক স্বামীদের কল্যাণে)। তিনি গত ১৫ বছরের অবৈধ আয়-উপার্জনের ঋণ পরিশোধের জন্য ভারত সমর্থিত এই অপপ্রচারের মিশনে নতুন কুশীলব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে অবস্থান নেন। বাড়িটি স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক হিসেবে গত ৫ আগস্টেই পুড়িয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। যাই হোক, দেশের এই ক্রান্তিকালে বিভিন্ন দালাল প্রজাতির লোকজনসহ ওই বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে তারা মোমবাতি প্রজ্বলন করে। সে পর্যন্ত কেউ তাকে বাধা দেয়নি।

এরপর তার উচিত ছিল ওই স্থান থেকে চলে যাওয়া। কিন্তু তিনি তা করলে সেনসেশন তৈরি হবে কিভাবে? তাই তিনি ওখানে দাঁড়িয়ে পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়া শুরু করেন। এ সময়ে তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘শেখ মুজিবের সৈনিকরা ভয় করে না বুলেট বোমা।’ এসব দেখে উপস্থিত ছাত্র-জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তারা ধাওয়া দেয় এবং বুলেট-বোমার ভয়ে যারা ভীত নয়, সেই বীরেরা একটা সামান্য ধাওয়া খেয়েই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তারা তো স্থির থাকার জন্য পথে নামেনি, তারা তাদের প্রভুদের নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এ দেশের ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়, যার মূল বিষয় হলো এ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও অবাধ লুটপাট। এই অপপ্রচার এখনো চলছে।

এই প্রেক্ষাপটেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। ইতোমধ্যে আরো চারজন নতুন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন এবং বিতর্কিত একজনকে কমগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করায় তাদের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে খুব দ্রুত ফেলে দেয়া সম্ভব হবে বলে প্রথম দিকে যে আশা ছিল সেটি যে সফল হচ্ছে না তা তারা বুঝতে শুরু করেছে।

বর্তমান সরকারের একটি বড় দুর্বলতা হলো, এখনো এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আছে স্বৈরাচারী হাসিনার মনোনীত সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এ দুর্বলতাকে কেন্দ্র করেই এখনো স্বৈরাচারের দোসরদের অপপরিকল্পনা চলছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সংবিধানের বরাত দিয়ে লাভ নেই; গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এই ধর্ষিত সংবিধানের পরোয়া করে না। ১৯৯০ সালেও এভাবে এরশাদকে সরিয়ে জাস্টিস সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। এ কাজটি করা হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্যান্য জরুরি বিষয়ে নিরবছিন্নভাবে মনোনিবেশ করতে পারবে।

খবরে দেখলাম স্বৈরাচারী হাসিনা তার ভাগ্নি ও পুত্র মিলে এক ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প’ থেকেই পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি করেছে। কুখ্যাত দরবেশ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এক টাকাও পরিশোধ করেনি, পলক ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বীকার করেছে, জিয়াউল আহসানের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৯০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা, এস আলম শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছে। এসব তথ্য সবই দেশের নেতৃস্থানীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে আমার ধারণা মতে, এগুলো আইসবার্গের চূড়া মাত্র, তা হলে অনুমান করুন আরো কত হাজার কোটি টাকা এই স্বৈরাচার ও তার সাঙ্গপাঙ্গোরা মিলে আত্মসাৎ করেছে। টাকার এসব অঙ্কের কথা চিন্তা করলেও ভয় লাগে, অথচ এসব চোর আবারো এই দেশে এসে ক্ষমতা দখল করে সেই অরাজক দিনগুলো ফিরিয়ে আনার চক্রান্ত করছে! ভাবাই যায় না।

বর্তমানে যেসব সচিব চেয়ারে আছেন, তারা স্বৈরাচার কর্তৃক পছন্দ করে নিয়োগ দেয়া, যাতে তাদের অন্যায়কে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। একই কথা প্রযোজ্য পুলিশ প্রশাসনের ক্ষেত্রেও; যে কারণে বহু সচিব ও পুলিশের ৫৭ কর্মকর্তা গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই পালিয়ে গেছেন। এসব লোককে তাদের পদে রাখলে তারা এই সরকারের সব সংস্কার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করবে। এসব পদে অবিলম্বে ইতঃপূর্বে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে পূরণ করতে হবে।

দেশের সব মানুষের অধিকার রয়েছে তাদের ন্যায্য বেতনভাতা পাওয়ার এবং যারা শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থক না হওয়ায় বা কোনো অন্যায় কাজ সমর্থন না করায় নিপীড়িত-নির্যাতিত ও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন, তাদেরও অধিকার রয়েছে ন্যায্য পদোন্নতি বা ন্যায্য পাওনা পাওয়ার। যারা এখনো কর্মরত, তারা তাদের ন্যায্য পাওনা পেতে শুরু করেছেন। কিন্তু যারা ইতোমধ্যেই অবসরে গেছেন, তাদের প্রাপ্য পেতে হয়তো একটু বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের ভুললে চলবে না, ১৬-১৭ বছরের পুঞ্জীভূত এবং শত শত মানুষের বঞ্চনার প্রতিবিধান এত দ্রুত আশা করাটা এই নতুন সরকারের ওপর জুলুম হয়ে যাবে। সরকারকে কিছুটা সময় দিতেই হবে।

গত ১৭ আগস্ট, জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের’ একটি গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম। আলোচনার মূল বিষয় ছিল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনপ্রত্যাশা’। সেখানে উপস্থিত রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের অন্যতম মূল প্রস্তাব ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ভাগ করা এবং এই সুচিন্তিত প্রস্তাবগুলো যেন এই সরকারের মেয়াদ শেষ হলেই পরিত্যক্ত না হয়, তা নিশ্চিত করা। এ কাজটি করা সম্ভব শুধু দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement