২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতির প্রত্যাশা

অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতির প্রত্যাশা - ছবি : সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়েছে। হাজারো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয় দেশের ১৮ কোটি মানুষের বিজয়। কয়েক হাজার গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ ও আজীবনের অন্ধত্ববরণ করেছেন কয়েক হাজার। রক্তের বন্যায় অর্জিত ছাত্র-জনতার এ বিজয় দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বীকৃত। খুনি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের এমন ফ্যাসিস্ট ও বর্বরতম শাসন পৃথিবীর সভ্য সমাজে বিরল। আওয়ামী শাসনের এ ১৬ বছর (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী জাহেলিয়াত ছিল বললে ভুল হবে না।

গুম, খুন, মানুষ হত্যা, বিনাবিচারে আটক, জঙ্গি নাটক, সীমাহীন লুটপাট, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসকরণ, শিক্ষাব্যবস্থার কবরদান, ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের মূলোৎপাটন, এ জাতির ওপর হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেয়া, উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা, দেশকে প্রতিবেশী ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা, সর্বোপরি খুনি হাসিনার হাজারও অপকর্মের বিরুদ্ধে ছিল ছাত্র-জনতার এ গণ-অভ্যুত্থান। ইতোমধ্যে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বিশ্বাস করি, এ সরকার দেশ ও জাতির আশা আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম হবে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশার কিছু দিক তুলে ধরতে চাই।

শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি কমিশন গঠন করা। কমিশন শহীদদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের সুপারিশ করতে পারে। আহত ও পঙ্গুদের তালিকা করে তাদেরও চিকিৎসা ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার সুপারিশ করতে হবে।

হুকুমের আসামি হিসেবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। দেশে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির অশুভ পাঁয়তারা চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। বিগত ১৬ বছর ধরে এ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী ফ্যাসিস্ট হাসিনার অনুগত ও দলীয় কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপিকে প্রধান করে একটি স্বাধীন কমিশন করা যেতে পারে। এ কমিশন দীর্ঘ ১৬ বছরের যাবতীয় অপরাধের তদন্ত করে দোষী কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ করবে।

প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। শেখ হাসিনার সরকার দেশের প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঢেলে সাজাতে হবে। দীর্ঘ ১৬ বছরে অবৈধভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত দলবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করে পার্লামেন্ট ঘোষণা করার কারিগর সিইসি কাজী রকিবুদ্দীন ও তার সহযোগী নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ, ২০১৮ সালের নৈশভোটের কারিগর সিইসি নুরুল হুদা ও তার সহযোগী নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ, ২০২৪ সালে ‘আমি ও ডামি’ নির্বাচনের নায়ক হাবিবুল আউয়াল ও তার দোসর নির্বাচন কমিশনারদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

দেশবাসী মনে করে, ছাত্র-জনতার ওপর ইতিহাসের বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ড চালানোর অপরাধে ব্যক্তি হিসেবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের পাশাপাশি ঢাল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সব সংগঠনের রাজনীতি বাংলাদেশে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবিলম্বে গণভোটের আয়োজন করে বাংলাদেশের মানুষের রায় নেয়া যেতে পারে। গণমানুষের রায়েই নির্ধারিত হবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দল বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কি না।

দেশের মানুষ ৫ আগস্টকে দ্বিতীয় বিজয় দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়।
হত্যা, গুম, খুন ও বিচারের নামে নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসি দেয়ার ঘৃণ্যতম অপরাধের আন্তর্জাতিক তদন্ত নিশ্চিন্ত করতে হবে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন টিকিয়ে রাখতে বিরোধী মতের প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজারের অধিক নিরপরাধ লোককে হত্যা করা হয়েছে। তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে। জাতি আশা করে অবিলম্বে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এ অপরাধের তদন্ত করে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সেই সাথে কথিত আয়নাঘরের সাথে জড়িত পাপিষ্ঠদের চিহ্নিত করে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হত্যার বিচার করতে হবে। কোন অপরাধে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে ইতিহাসের জঘন্যতম কায়দায় হত্যা করা হলো এবং কেনইবা তাদের জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না জাতি তা জানতে চায়। অবিলম্বে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।

আগুন সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দেশবাসী আশা করে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাসে পেট্রলবোমা মেরে আগুন দিয়ে নৃশংসভাবে যেভাবে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে এবং শত শত বাসে আগুন দেয়া হয়েছে তার আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে হবে।
আর্থিক খাতের লুটপাটকারী মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিগত ১৬ বছর অর্থনৈতিক খাত সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব চালানো হয়েছে। আর্থিক খাত ধ্বংসের নায়কদের চিহ্নিত করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুটপাটের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারকারী রাঘববোয়ালদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছে তাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে।

১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্ব নেতৃত্বের উপযোগী হয়ে যেন আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠতে না পারে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমন সব পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। সৃজনশীল কারিকুলামের নামে পরীক্ষাবিহীন এক অদ্ভুত ব্যবস্থা চালু করে জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। অবিলম্বে এ কারিকুলাম বাতিল করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

গত ১৬ বছরে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের নিয়োগ পদ্ধতি, আবেদনের যোগ্যতা, পদোন্নতি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। শুধু দলীয় বিবেচনায় ক্যাডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে এ বিষয়ে তদন্ত করে অযোগ্যদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা থেকে বাদ দিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটব্যবস্থা ভেঙে দ্রব্যমূল্য মানুষের হাতের নাগালে আনা বর্তমান সময়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণ আশা করে, ছাত্র-জনতার সরকার এ ক্ষেত্রে সফল হবে।

বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপমুক্ত করা ও আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। বিচার বিভাগ ধ্বংসে যে দু’জন বেশি ভূমিকা রেখেছে বলে দেশের মানুষ মনে করে তারা হলো সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও সাবেক আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। দেশবাসী অবিলম্বে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চায়।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের সাথে যেসব দেশবিরোধী চুক্তি করেছে তা অবিলম্বে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। দেশের জনগণ ভারতের সাথে সুসম্পর্ক চায় সমমর্যাদার ভিত্তিতে।

নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দ্বিতীয় স্বাধীনতা ছাত্র-জনতার ত্যাগের ফসল। জীবন দিয়ে হলেও এ দ্বিতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে আমাদের। বাংলাদেশে আর যেন কোনো ফ্যাসিস্ট ব্যক্তি বা সরকার ক্ষমতায় জেঁকে বসতে না পারে তার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন শুধু কোটা সংস্কার নয়, এ জাতিকে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের সুযোগ করে দিয়েছেন। দেশবাসী আশা করে যথাশিগগির সম্ভব রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। দেশবাসী আরো আশা করে, সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু এবং দেশ বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবেন এবং নির্বাচন আয়োজনের একটি রোডম্যাপ জাতির সামনে পেশ করতে পারবে।

ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা। আমাদের তরুণ প্রজন্মের ওপর আস্থা ও ভরসা রাখতে চাই। আমাদের বিশ্বাস, তরুণ প্রজন্ম পথ হারাবে না।

লেখক : অধ্যাপক ও শিক্ষানীতি গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement