২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
স্মরণ

এবনে গোলাম সামাদের মূল্যায়ন হোক

এবনে গোলাম সামাদ - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবিতার পথিকৃৎ ছিলেন এবনে গোলাম সামাদ (১৯২৯-২০২১)। তার চর্চার বিষয় বিবেচনা করে অনেকেই তাকে বলতেন ‘প্রাচ্যের সক্রেটিস’। তিনি নানাবিধ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে লেখালেখি করেছেন। ধারাবাহিকভাবে বই লিখেছেন, পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় কলাম লিখেছেন। তার রচিত এসব লেখা দু’টি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্ব স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের রচনা। এ সময়ে তিনি শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেন, একাডেমিক বিষয়ে বই লিখেন। এ পর্বে তার উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ : ‘শিল্পকলার ইতিকথা’ (১৯৬০), ‘উদ্ভিদ সমীক্ষা’ (১৯৬৬), ‘নৃতত্ত্ব’ (১৯৬৭)। ‘নৃতত্ত্ব’ বাংলা ভাষায় রচিত এ বিষয়ক প্রথম বই বলে স্বীকৃত।

তিনি ধর্মের ইতিহাস নিয়ে একটি ধারাবাহিক রচনা লিখতে শুরু করেছিলেন সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায়। শেষ পর্যন্ত বইটি রচনা কাজ শেষ করতে পারেননি। স্বাধীনতা-উত্তর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে তিনি একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন রাজনৈতিক কলাম। আর রাজনৈতিক কলাম রচনা করতে গিয়ে তিনি তুলনামূলক ইতিহাস পর্যালোচনার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। এ পর্বে তার রচিত বইয়ের তালিকা বেশ দীর্ঘ। শৈশবে শিল্পের প্রতি তার যে অনুরাগ তৈরি হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা এ পর্বেও দেখা যায়। এ পর্বে রচিত বইসমূহ : ‘বাঙালীর জন্ম পরিচয়’ (১৯৭২), ‘ইসলামী শিল্পকলা’ (১৯৭৮), ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ (১৯৮৭), ‘রাজশাহীর ইতিবৃত্ত’ (১৯৯৯), ‘নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ’ (২০০১), ‘বাংলাদেশে : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’ (২০০৩), ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’ (২০০৬), ‘প্রাথমিক জীবাণু তত্ত্ব’ (২০০৭), ‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’ (২০১৩), ‘আত্মপক্ষ’ (২০১৪), ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ (২০১৫), ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’ (২০১৭), ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট’ (২০১৮), ‘আমার স্বদেশ ভাবনা’ (২০২০) এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ কথা’ (২০২৩) উল্লেখযোগ্য।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবী। এ কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে তার ‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’, ‘বাংলাদেশ কথা’ এবং ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’ বইগুলো পড়লে। তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা রক্ষার বিষয় নিয়ে কতটা ব্যাকুল ছিলেন। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তার জনসমষ্টি, সাংস্কৃতিক পরিচয়, প্রতিরক্ষা কৌশল কতটা জরুরি বিষয় সে বিষয়ে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিককে সচেতন করতে। তিনি মনে করতেন, এখন আমাদের আর পাকিস্তানের আগ্রাসন নিয়ে ভাবার দরকার নেই; বরং ভাবতে হবে নিকটবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিয়ে। তিনি মনে করতেন, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আগ্রাসনমুক্ত হওয়ার জন্য ইসলামের সামাজিক বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। ধর্ম হিসেবে তিনি ইসলামকে বামপন্থী বলে ব্যাখ্যা করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে রবীন্দ্র পূজার যে মচ্ছব সে বিষয়েও সচেতন করার প্রয়াস ছিল তার। কবি রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় কার্পণ্য করেননি এবনে গোলাম সামাদ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে রাজনীতি তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন কবি ছিলেন, তেমনি ছিলেন জমিদার। পূর্ববঙ্গে ছিল তার জমিদারি। কিন্তু পূর্ববঙ্গের সমাজ উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল গৌন। এসব বিষয়ে রবীন্দ্রভক্তকুল একেবারেই নীরব। সেই নীরবতার জগদ্দল পাথরে বোধের নাড়া দিয়েছেন এবনে গোলাম সামাদ।

ভারতীয় সমাজে ইসলামের যে অবদান তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন রচনায়। তিনি বলেন, ‘ইসলাম হিংস্রতা সমর্থন করে না। ইসলামে বিষধর সাপকে কষ্ট না দিয়ে বধ করতে বলা হয়েছে (হাদিস)। মহানবী সা: তাঁর বিদায় হজের বক্তৃতায় বলেন, সকল ধর্মের মানুষের ওপর সুবিচার করতে। কারো প্রতি দুর্ব্যবহার না করতে। আল কুরআনে ১১৪টা সূরার (অধ্যায়) মধ্যে মাত্র একটি ছাড়া আর সব ক’টির শুরুতে বলা হয়েছে, আল্লাহ পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তবে মুসলমানরা যে কখনো তাদের ধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি এমন নয়।... বাংলাদেশে অনেকে ইসলামকে বলতে চাচ্ছেন জঙ্গীবাদী। কিন্তু ধর্ম হিসেবে ইসলাম জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ইসলামে জিহাদ করতে বলা হয়েছে জুলুমের বিরুদ্ধে। শান্তিপ্রিয় মানুষকে বলা হয়নি আক্রমণ করতে।’

এবনে গোলাম সামাদ মনে করেন, ‘সব বাঙলা ভাষাভাষী মানুষ একত্র হয়ে এখনো এক রাষ্ট্র গড়তে চাচ্ছেন না। বাঙলা যাদের মাতৃভাষা তাদের ৬০% বাস করে বাংলাদেশে। আর বাকি ৪০ শতাংশ বাস করেন ভারতে। ভারতে বাংলাভাষী হিন্দুরা বাঙালি হতে চাচ্ছেন না, থাকতে চাচ্ছেন ভারতীয় হয়ে।... আজকের বাংলাদেশের জাতিসত্তা কেবল ভাষাভিত্তিক নয়। ভাষার একটি মূল্যবান উপাদান। কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এর আরেকটি উপাদান হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্য। আজকের বাংলাদেশ টিকে আছে বাঙলাভাষী মুসলমান আছেন বলেই। তারা হলেন এ দেশের মেরুদণ্ড। আমি তাই বলব, সংস্কৃতির শিকড় খুঁজতে হলে খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। খুঁজতে হবে ইসলামের স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে। আরেক কথায় ইসলামী ঐতিহ্যের (Tradition) মধ্যে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানের বিশেষ মূল্যায়ন করতেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের রাজনীতি কেবল বাংলাদেশকে ঘিরেই ছিল।’ ‘জিয়া না থাকলে তখন বাংলাদেশ ইন্ডিয়া হয়ে যেত।’
আজ দেশ আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এবনে গোলাম সামাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য। তাকে যতটা সম্মান দেখানো উচিত জাতি হিসেবে তা আমরা দেখাতে পেরেছি বলা মনে হয় না। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে এবনে গোলাম সামাদের সঠিক মূল্যায়ন হোক।


আরো সংবাদ



premium cement