গণ-অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদের বিদায়
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০৬:০০
২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্তকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ইতিহাসের গৌরবময় স্থান দখল করেছিল। কিন্তু সব অভ্যুত্থানের চেয়েও সবচেয়ে বড় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের এই অভ্যুত্থান। ১৫ বছরের নির্মম শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষগুলোর পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলনে অনুষ্ঠিত এই মহান বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এই বিপ্লব একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির ইতিহাস-ঐতিহ্যের অধ্যায়গুলোকে। ছাত্র-জনতার সম্মিলনে এমন মহান ইতিহাস পৃথিবীর বুকে খুব কমই রচিত হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থান শিখিয়ে দিয়েছে একটি জাতির জন্য সাম্য ও স্বাধীনতার গুরুত্ব কতটা প্রয়োজন।
আমেরিকার একজন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল জন স্টার্ক (১৭২৮-১৮২২) ফরাসি ও ভারতীয় যুদ্ধ এবং বিপ্লবী যুদ্ধের সময় কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তি বা মৃত্যু : মৃত্যু খারাপের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ নয়।’ পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত না হয়ে জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে গৌরবের ইতিহাস যেমন রচিত হয়, তেমনই একটি রাষ্ট্র এবং একটি জাতির মধ্যে আলোর উৎস উন্মোচিত হয়। প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে পুঁজিবাদী কিংবা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় নাগরিকের স্বাধীনতা হয় বুটের নিচে চাপা পড়ে মরে, না হয় বন্দুকের নলে ঝাঁজরা হয়ে যায়। অথচ, স্বাধীনতা হলো, মানুষের প্রথম এবং মহত্তম অধিকার। অন্যায় অবিচার, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আসে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বাদ। আমাদের স্বাধীনতাও সেভাবেই এসেছিল। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তা একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ৫৩ বছর আগেও আমরা যে স্বাধীনতা ও অধিকার বোধের জন্য লড়েছিলাম, জীবন দিয়েছিলাম, ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়েছিলাম, এখনো সেই একই কারণে হারাতে হচ্ছে বহু তাজাপ্রাণ।
৫৩ বছর আগের স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে, জীবন দিয়ে যারা বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম ইত্যাদি খেতাব পেয়েছেন, আজকের দিনে আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ শত শত মানুষ যারা জীবন দিয়েছেন তারাও বাংলাদেশের ইতিহাসে একেকজন বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীরবিক্রম, বীর প্রতীকের মতোই গৌরবোজ্জ্বল জায়গা করে নিয়েছেন। পার্থক্য এই যে, তখন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, আর এখন একটি স্বাধীন দেশে সেই একই কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অসংখ্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে।
ক্ষমতার মোহ একটি পক্ষকে পেয়ে বসেছিল। কোটি কোটি জনতার ক্ষোভের আওয়াজ তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছেনি। বহু বছর ধরে জনগণ ভোটাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সরকারি দলের লোকজন ও সরকারি আমলাদের দুর্নীতির মহোৎসব এবং চাকরিসহ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্র তরুণসমাজকে বিষিয়ে তুলেছে। সেই জায়গা থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের সাথে আপামর জনতা রাজপথে নেমে আসে। রূপ পায় গণঅভ্যুত্থান। আর এই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। হারাতে হয়েছে ক্ষমতা।
বহু দুঃখ যন্ত্রণা ও স্বজন হারানোর ক্ষত থাকার পরও মানুষ উল্লাসে মেতে উঠেছে। কারণ একটিই, তারা ফ্যাসিবাদী সরকারকে বিদায় করতে পেরেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছয় থেকে সাতজন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ৬১ জন মারা গিয়েছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষকে পশুর মতো গুলি করে হত্যা করেছে। শিশু, নারী-পুরুষ, শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, দোকানি- কে নেই মৃত্যুর তালিকায়। মৃত্যুর মিছিল তাদের মনে ভয় ধরাতে পারেনি। কারণ, স্বৈরশাসনের দাম্ভিকতা তাদের হৃদয়তন্ত্রে আঘাত করেছে।
পিণ্ডি থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার চেতনা থেকে। কিন্তু অনেক বেশি দামে কেনা সেই স্বাধীনতাকে খুব কম দামেই বিক্রি করে হলেও নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সব ষড়যন্ত্রই করেছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার। যা, বিগত ১৫ বছর ধরে হয়ে আসছিল। জনগণ যখনই তাদের অধিকার ও দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলতে গেছে, তখনই তাদেরকে জেল-জুলুম এমনকি গুম-খুনের শিকার হতে হয়েছে। জনগণ যখন বুঝতে পারল, তাদের নাগরিক স্বাধীনতার শৃঙ্খল পিণ্ডি থেকে হাতবদল হয়ে দিল্লির কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। তখন তারা এমন একটি তাঁবেদার, দাসানুদাস সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে স্বৈরশাসনের মসনদ ছারখার করে দিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং ক্লেপ্টোক্রেসি বা চৌর্যবৃত্তির অর্থনীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটিই এই স্ফুলিঙ্গকে আগুনের শিখায় পরিণত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। রাজনীতির ময়দানে আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে বিগত হয়ে গেছে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার ও তার বৈধ-অবৈধ বাহিনী।
আমাদের বুঝতে হবে, আজকের যারা যোদ্ধা তাদের চিন্তার প্রসারতা অনেক বেশি। ছাত্র-জনতার এই গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে মিথ্যা আর ভুল ইতিহাস পড়িয়ে তাদের মস্তিষ্ককে ভুল পথে নেয়া যাবে না। সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, রাইফেলের গুলি, বুলেট, বোমা তাদের এই অদম্য গতিপথকে রুদ্ধ করতে পারে না। তারা জেগে উঠেছে একটি অসারতার বিরুদ্ধে। ইতিহাস থেকে তাদের জিজ্ঞাসা, ৫৩ বছর আগে আমাদের একটি প্রজন্ম যে অধিকারের জন্য দেশটা স্বাধীন করেছিল, আজকে আমাদের সেই অধিকার, সেই স্বাধীনতা কোথায়? তারা জানতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে, জিজ্ঞাসা করার সাহস জাগিয়েছে, জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, হয়তো এ কারণেই অসারতার সাথে তাদের এই যুদ্ধ, এত রক্ত দান।
শেখ হাসিনার অতি স্বৈরতান্ত্রিকতার কারণে রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল একীভূত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দোসর সুবিধাভোগী কোয়ালিশন যারা নিজেদের সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত ছিল, তারা একবারও জনগণের কথা ভাবেনি। দিনকে দিন তাদের দাম্ভিকতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তারা নির্বিচারে যা ইচ্ছা করে গেছে। ফলে তাদের পক্ষ থেকে যত বেশি সহিংসতা ও নির্মমতা চালানো হয়েছে, মানুষের ভেতরে তত বেশি ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। যার কারণে সর্বশ্রেণীর মানুষ রাজপথের সমাবেশে শামিল হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার যতটা নির্দয়ভাবে বর্তমানে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং গত ১৫ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে, গত ১০০ বছরে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো আন্দোলন দমনে এতটা নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞ দেখা যায়নি। সব দমন-পীড়ন হজম করে জনতার যে স্রোতে রাজপথে নেমে এসেছিল, তার বিজয়ও জনগণ দেখেছে। জনগণ এটাও দেখেছে, কিভাবে একটি অত্যাচারী জনবিচ্ছিন্ন সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজকের বাস্তবতায় প্রমাণ হয়েছে, জনগণের শক্তির কাছে কোনো ফ্যাসিবাদই টেকসই নয়।
পরিশেষে একটি কথা। যে জাতির ইতিহাস রক্ত দিয়ে লেখা হয় সেই জাতির সূর্যসন্তানরা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করে না। বিজয়ী তারা হবেই।
সাম্য ও ন্যায়ের ওপর রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের কথা শুনে, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেয়া, তথা একটি সভ্য সুন্দর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোই সরকারকে জনরোষের হাত থেকে রেহাই দিতে পারে। আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠলে জনরোষে অস্তিত্ব বিলীন হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা