দুর্যোগের মুখে দেশের অর্থনীতি
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০৬:১১
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সঙ্কট দিন যত যাচ্ছে তত ঘণীভূত হচ্ছে। অনেক দিন ধরে অর্থনীতির অনেক খাতে নিম্নমুখী অবস্থানে থাকা অবস্থায় সম্প্রতি কোটা আন্দোলনের তীব্রতায় তা আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। জিডিপি, বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, মূল্যস্ফীতি, লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট), আমদানি রফতানি বাণিজ্য ইত্যাদি খাতের নিম্নমুখী অবস্থান নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা যখন উদ্বিগ্ন; তখন আবার কোটার মতো একটি অরাজনৈতিক বিষয় সময়মতো সমাধান না করার কী পরিণতি ডেকে আনলো অর্থনীতিতে। শুধু তা-ই নয় অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেল। ক্ষতি হয়ে গেল দেশের সম্পদ ও অর্থনীতির।
চলমান অস্থিরতায় আটকে আছে রফতানি, স্থবিরতা নেমে এসেছে শিল্প খাতে, উৎপাদন থেমে গেছে, দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ও নির্ভরতার ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও ইন্টারনেট বন্ধ বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকায় পণ্য সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দেয়। অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশ ছিল। চলমান অস্থিরতায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে নতুন সঙ্কট তৈরি করবে। বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে সঙ্কট, নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি, রাজস্ব ঘাটতিতে ঋণনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি, ঋণের সুদ পরিশোধের দায় নিয়ে অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে। ১০০ বিলিয়ন ডলার যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে সামনে তার কিস্তি শুরু হবে। এতে টাকার মান আরো কমতে পারে। বৈষম্য প্রকট হতে পারে। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পর্যায়ে চলে আসতে পারে। এমনি অনিশ্চিত ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে দেশ চলছে।
২০২১ সালে আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। ২০২৪ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগ নীতি অনুসারে তা দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। এতে দুই বছরে টাকার মান অবমূল্যায়ন হয় ৩৮ শতাংশ। তা ছাড়া প্রতি বছর টাকা পাচার হচ্ছে নানা ভাবে। হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংক ঋণ বিদেশে পাচার, রফতানি আয় দেশে না আসা, রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। এ ছাড়া আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের দ্যেরাত্ম বেড়ে যাওয়া। এসব ক্ষত অর্থনীতিকে দুর্যোগে ফেলেছে। করোনা কালে ২০১৯-২০ এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৮ শতাংশ তখন জিএনআই ছিল ১৯০৯ ডলার। ২০২৩-এর ৩০ জুনে ছিল ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। ২০২৪ এ জুনে জিএনআই ২৭৮৪ ডলারে পৌঁছে। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতিতে স্বস্তি কর অবস্থায় না থেকে বরং জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর ২০২৩-২৪ শেষ করেছে সরকার। বিদেশী ঋণের কিস্তির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলো ও নেতিবাচক ধারাতে রয়েছে অনেক দিন ধরে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সঙ্কুলানে সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী কনট্রাক্টরদের অর্থ যা এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ দিকে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোও আমাদের থেকে অর্থ পাবে। বিদেশ থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ আমদানি করছি, সে ক্ষেত্রে কিছু অংশ বকেয়া রয়েছে। এগুলো বাংলাদেশকে শোধ করতে হবে। শোধ করতে গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়বে, তা কি আমরা সামলাতে পারব?
চলমান সঙ্কট সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাংবাদিকদের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা এখন অস্বাভাবিক সময়ের মধ্যে আছি। এটি মহামারী বা বৈশ্বিক মন্দার মতো পরিস্থিতি না, এর শান্তিপূর্ণ সমাধান আসতে হবে রাজনৈতিক পর্যায় থেকে। সামনের দিনে এমন ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে ভাবতে হবে’।
স্বাভাবিকতায় ফিরতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা এসেছে। সেজন্য প্রথমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারফিউ ওঠাতে হবে, উৎপাদন ও বাণিজ্য কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থায়’। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, ‘অর্থনীতি আগে থেকে সঙ্কটে ছিল, এখন পরিস্থিতি আরো নাজুক। রাজনীতিকে বাদ দিয়ে অর্থনীতিকে চিন্তা করা যাবে না। টেকসই শান্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার’।
অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হলে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব পক্ষকে সহমর্মিতার পরিচয় দিতে হবে। প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে ভয়াবহ খাদের কিনারা থেকে রক্ষা করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আস্থার সঙ্কট দূর করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলের অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করে আস্থার জায়গা করতে হবে। খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে হবে। দুর্বল ব্যাংকের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। মেট্রো রেল ও জনকল্যাণ মূলক সেবার স্থাপনা দ্রুত মেরামত করতে হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁট করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিতে হবে। নৈতিকতা ও দেশের সম্পদ সুরক্ষায় শিক্ষাব্যবস্থায় সংযোজন করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের যে ব্যাপক বেকার, শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত জনবল রয়েছে তা বিদেশে পাঠাতে হবে। তারা আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও রাখেন। অর্থনীতির চাকা সচল করতে হলে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে তার দ্রুত সমাধান করতে হবে। যারা সম্পদ ধ্বংস করেছে; তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্দোষ কেউ যেনো হয়রানির শিকার না হন। সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে আসুক এটাই সবার প্রত্যাশা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা