পোশাক শিল্প না বাঁচলে অর্থনীতি বিপন্ন হবে
- খন্দকার হাসনাত করিম
- ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০৬:২৮
আমাদের রফতানিবাণিজ্য বরাবরই সর্বগ্রাসী আমদানি বাণিজ্যের কাছে ধরাশায়ী। তথাপি তৈরী পোশাক ছাড়া আর যেসব পণ্য ও সেবা রফতানি করে কিছু আয় উপার্জনের আশা করতে পারি, সেগুলোর মান বাড়ানো এবং দর প্রতিযোগিতামূলক করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। অথচ ১০০ শতাংশ মূল্য সংযোজিত এসব দেশী পণ্য রফতানি করতে পারলে অর্থনীতিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব যে পড়বেই তাতে সংশয় নেই।
ইতিমধ্যেই আমাদের অর্থনীতির মূল উৎস পাট শিল্প ধসে গেছে। আমাদের পাট নিয়ে ভারত পাটজাত পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে ঢুকছে। চায়ের বাজারও আমাদের কার্যত হাতছাড়া। চামড়া, চামড়াজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও অগ্রগতির কোনো সূচক চোখে পড়ছে না। বাকি থাকল তৈরী পোশাক। এ খাতের বাস্তব চিত্রটি হলো, তৈরী পোশাক কখনোই উচ্চমূল্যে সংযুক্তি ছিল না। কারণ আমরা সবাই জানি, আমাদের প্রাথমিক বস্ত্র শিল্পে রফতানিমান সম্পন্ন থানকাপড় তৈরি হলেও বেশির ভাগ অর্ডার বিদেশ থেকে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে কাপড় এবং বেশ কিছু ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ’ সামগ্রী আমদানি করে রফতানি করতে হয়। ডলারের প্রতিকূলে স্থানীয় মুদ্রার (টাকা) চরম দর-অবনতির ফলে তৈরী পোশাক শিল্পের অস্তিত্ব এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর ওপর রয়েছে এ খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর অব্যাহত চাপ।
আমাদের তৈরী পোশাক শিল্পে যেমন রফতানির সাফল্যে ধাপে ধাপে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছে; আমাদের সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো- বিশেষ করে এ খাতের মেধাবী ও নিষ্ঠাবান উদ্যোক্তারাও শিল্পটির মান নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রত্যাশা এবং শর্তাবলি পূরণে প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ বা পরিবেশ অনুকূল কারখানাও এ বাংলাদেশেই। কিন্তু এত প্রশংসনীয় কমপ্লায়েন্সের জন্য বাংলাদেশ বাড়তি কোনো সুযোগ পায় না। এটি দুঃখজনক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন চায়। এটি তো ভালো কথা। কিন্তু ভিয়েতনামে বা কম্বোডিয়ায় কি এখনো পুরোপুরি স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে? সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কোনো কথা বলে না। কারণ এশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব কমাতে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতিতে তার প্রভাব অটুট রাখা চাই। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো গ্রিন ব্যাংকিংয়ের কথা মুখে বলে বটে, তবে গ্রিন কারখানার জন্য ইটিপি, উন্নত কর্মপরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে জীবিকা ও শ্রমের নিশ্চয়তা বিধানের সাথে তো নানা পদের অনুপ্রেরণামূলক রেয়াতেরও প্রয়োজন হয়। ব্যাংক সুদের যে উচ্চহার, সেই তুলনায় পরিবেশ অনুকূল ব্যবস্থা বাস্তবায়নে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা সত্যিই কঠিন চ্যলেঞ্জের মুখে পড়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারি কর্তৃপক্ষ, বিজিএমইএ বা বিকেএমইএর মতো সংগঠনগুলোর মধ্যে আশানুরূপ সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।
সরকার তো ঠিকমতো হোমওয়ার্ক করা ছাড়াই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ঘোষণা করে বসল। কিন্তু এ গ্র্যাজুয়েশনের ফলে বাংলাদেশের রফতানিমুখী শিল্পগুলোর হালহকিকত কেমন সেই অতি দরকারি হিসাবটা কি করা হয়েছে? সরকার শ্রমিকদেরও পিঠে হাত বুলাচ্ছেন, সাফল্যের সুতীব্র তাগিদ থেকে হঠাৎ করে ধনী ক্লাবের সদস্যও হতে চাচ্ছেন। কিন্তু যে দামে বিদ্যুৎ খরচ, জেনারেটরের জ্বালানি বা গ্যাস বিল দিয়ে উদ্যোক্তাদেরকে ‘কমপ্লায়েন্স’ রক্ষা করতে হচ্ছে সেটা কি আমরা একবারও ভাবছি?
‘টার ওয়ার্ক বাংলাদেশ’ একটা জনপ্রিয় বুলিই বটে। তবে কত উচ্চ হারে ইউটিলিটিজ এবং বর্ধিত বেতন দিয়ে, ব্যাংকের উচ্চ হারের বাণিজ্যিক ধরনের সুদ দিয়ে উদ্যোক্তাদেরকে টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে, সে খবর কি জাতি জানে? রানা প্লাজার শোকাবহ দুর্ঘটনা এবং এরপর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডগুলো বিবেচনায় রেখে রফতানিমুখী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও রাজস্ব প্রশাসনের মধ্যে যে সমন্বিত কর্মকৌশল অবলম্বন করা একেবারেই ফরজ ছিল তা কি আমরা করতে পেরেছি? সরকারের কাঠামোগত নীতি সমর্থন নিতান্তই রাজনৈতিক প্রচার সাহিত্যের সাথে যায়, বাজার বাস্তবতার সাথে যায় কি?
তৈরী পোশাকে সাফল্য আমাদের অবশ্যই একটি বড় অর্জন। তবে এ অর্জনকে সম্ভব করতে এবং এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে সবচেয়ে বেশি নীতি-সমর্থনের হকদার এ খাতের ছোট, মাঝারি ও বড় উদ্যোক্তারা। হিসাব নিয়ে দেখুন তো, করোনা-প্রণোদনার এনাম তার কে কতটা পেয়েছেন? রফতানি সাফল্যের ধারায় এখন যুক্ত হয়েছে শ্রমশক্তির তুলনামূলক নিম্নহার থেকে তৈরি করা কাপড়ের মান উন্নয়ন, বিশেষ করে নতুন অর্ডার ধরার জন্য প্রতিযোগিতামূলক ‘সিএম’ বা ডজনপ্রতি দর। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন একটা বাস্তবতা, যা হলো করোনা-পরবর্তী জাহাজ ভাড়া এবং পোর্ট হ্যান্ডলিং ও পরিবহন ব্যয়। বেড়েছে বীমার প্রিমিয়াম। বেড়েছে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার খরচ।
কারখানাগুলোকে তাদের ক্রেতার মন রক্ষা করতে প্রবৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা, শ্রম ব্যয়সঙ্কোচন, নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি, কর্মীদের প্রশিক্ষণ এসব বাস্তবতা। ক্রেতারা চাহিদা দেবার বেলায় ‘শাইলক’ এবং দর অনুমোদনের বেলায় মহা কৃপণ। এ স্ববিরোধিতা আগেও ছিল, এখন অনেক বেশি এবং সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়াবে। এ যেসব অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ, এগুলো শেষ পর্যন্ত গিয়ে বর্তায় উদ্যোক্তাদেরই ওপর। সত্য বটে, ১০৩টি পোশাক কারখানায় কর্মরত দুই লাখ ৮০ হাজার শ্রমিককে মাতৃত্বকালীন ছুটির সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে আইএলও, ইউএনএফপিএ, ক্রেতা দেশগুলোর নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনগুলো খুবই সন্তুষ্ট। তবে এ মানবিক সন্তোষ অর্জনের জন্য এ দেশের উদ্যোক্তাদের ওপর যে বাড়তি চাপ নেমে এসেছে তা সত্যিকার অর্থেই ‘অমানবিক’।
কেননা দিনের শেষে সাফল্যের গৌরব শরিকানা হাতাতে সবাই ওস্তাদ; সরকার তো আছে কৈ-এর তেলে কৈ ভাজার মহা-আত্মতৃপ্তিতে। কিন্তু এ বিশাল চাপ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে এবং উচ্চ সুদের ঋণের ওপর যে গুরুতর প্রতিক্রিয়া রাখছে, সে হিসাব কে করছে?
পোশাক খাতে যে সাফল্য তা উদ্যোক্তাদেরই। তাদের সাফল্যের যোগফল। গত ১০ বছরে করোনা মসিবতের মধ্যেও এ খাতে রফতানি বেড়েছে ১৫ শতাংশ এবং রাজস্ব বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। তবেই আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক শিল্পের গর্বিত ভাগিদার হতে পেরেছি। এ কৃতিত্বের অর্ধেকটা হলো শ্রমিক-কর্মীদের অবদান (যাদের মধ্যে নারীশ্রমিককের সংখ্যা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ)। বাকি সব কৃতিত্ব এ শিল্পের কৃতী মেধাবী, শিক্ষিত ও বিপুল ঝুঁকি বহন করা উদ্যোক্তাদের, যাদের অধিকাংশই এ দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তা। তৈরী পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে না পারলে অর্থনীতি আসলেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা