নেপালে নতুন সরকারের ভবিষ্যৎ কী
- আহমদ মতিউর রহমান
- ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:৩৬
নেপালে নতুন এক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হলো সম্প্রতি। বলা যায়, যা হবার তাই হয়েছে। ১৯ মাসের জোড়াতালির সরকারের অবসান হয়েছে। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একদা কমিউনিস্ট বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা নেতা সেই পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড। জোড়াতালির সরকার এ কারণে বলতে হয় যে, তিনি পার্লামেন্টে কম আসনের একটি দলের নেতা হয়েও ১৯ মাস দেশ শাসন করে গেছেন। বিশ্লেষকরা বলে আসছিলেন যে, তার সরকার দীর্ঘদিন টেকার মতো নয়। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। আর ১৪ জুলাই নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বিদায়ী সরকারের পার্টনার নেপালের আরেক কমিউনিস্ট দল সিপিএন-ইউএমএল নেতা কেপি শর্মা অলি। চতুর্থবারের মতো দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল ১২ জুলাই প্রতিনিধি পরিষদে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটে হেরে যাওয়ায় ১৪ জুলাই মি. অলিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মি. দহল গত মার্চ মাসে তার জোটে নতুন দফা পরিবর্তনের পর নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক নাটকীয়তার পর এটি হয়েছিল।
একটু পেছন ফিরে দেখা যাক, ১৯ মাসের সরকার কীভাবে ক্ষমতায় এলো এবং ছিটকে গেল।
২০২৩ সালের ২০ নভেম্বরের নির্বাচনের পর নানা নাটকীয়তা ও ডিগবাজির পর সরকার গঠনে মরিয়া ছিলেন পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড। ২৫ ডিসেম্বর প্রচন্ড সরকার গঠন করেছিলেন। নেপালের সেই নির্বাচনে কোনো দল সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। গঠিত হয়েছিল একটা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। ২৭৫ আসনের হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভসের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয় নেপালি কংগ্রেস। তাদের এমপির সংখ্যা ৮৯। ওলির সিপিএন (ইউএমএল) হয় দ্বিতীয়, আসন সংখ্যা ৭৯। আর প্রচন্ডের সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার)-এর রয়েছেন ৩২ জন এমপি। এ ছাড়া আরএসপির ১৯, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির ১৪, জনতা সমাজবাদী পার্টির ১১ জন এবং ২৩ জন নির্দল সদস্য রয়েছেন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে।
নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন পাঁচ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভসের ভোটে লড়েছিল প্রচন্ডের দল সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার)। কিন্তু নেপালি কংগ্রেস প্রধান শের বাহাদুর দেউবা অর্ধেক মেয়াদের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব চুক্তি অনুযায়ী প্রচন্ডকে দিতে অস্বীকার করায় নির্বাচনের পর জোট ভেঙে যায়। এরপর ওলির সিপিএন (ইউএমএল), রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি) এবং ছোট দলের সাথে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন প্রচন্ড। কথা ছিল বাকি অর্ধেক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হবেন ওলি বা তার দলের কোনো নেতা। ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে প্রচন্ড-ওলির চুক্তি হলেও গোড়া থেকেই দুই দলের সম্পর্ক মসৃণ ছিল না। সরকার পরিচালনায় সঙ্কট দেখা দেয় এবং ওলির দল সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এই পরিস্থিতিতে গত ১৫ জানুয়ারি প্রচন্ড সরকারের আস্থাভোটের প্রয়োজন পড়ে। আস্থাভোটের দিন নাটকীয়ভাবে দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেসের জোট প্রচন্ডকে সমর্থন করে। টিকে যায় প্রচন্ড সরকার। তবে এর পরে সিপিএন (ইউএমএল)-সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার) টানাপড়েন আরো তীব্র হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে জোটসঙ্গী আরএসপি মন্ত্রীরা ইস্তফা দিয়ে জোট ছাড়ার কথা ঘোষণা করায় সরকারের অন্দরে টানাপড়েন আরো বাড়ে।
জোট গড়ার সময় প্রচন্ড আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ইউএমএল প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন দেবেন তিনি। কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে আসা থেকেই সঙ্কটের সূচনা বলা যেতে পারে। তার আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডের সাথে মতবিরোধের জের ধরে নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। এর মাধ্যমে সেই সময়ের ক্ষমতাসীন জোটে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। উপ-প্রধানমন্ত্রী রাজেন্দ্র লিঙদেন ও অপর তিন মন্ত্রীও পদত্যাগ করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগ সত্ত্বেও সরকারের এখনই পতন হবে না। তবে এই গোলযোগের ফলে নতুন কোয়ালিশন গঠিত হতে পারে। আর সেটাই হয়েছিল। নেপালে অতীতে দেখা গেছে সরকারগুলো ছিল অস্থিতিশীল। গত ১৪ বছরে অন্তত ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে।
গত ২০ মার্চ সিপিএন-মাওবাদী সেন্টার নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড আস্থা ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। স্বল্প সময়ে তাকে দ্বিতীয় দফা ফোর টেস্টে যেতে হয়। তার সরকার ছিল দুর্বল এবং জোট টিকবে না বলে যা ভাবা হয়েছিল তিন মাসের মাথায় সে আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল।
কেমন হয়েছে ৭২ বছর বয়সী কেপি শর্মা ওলির সরকার। তার দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) মধ্য-বাম ঘরানার নেপালি কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেছে। ওলি প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। এরপর ২০১৮ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ২২ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন ১৫ জুলাই। এতে আছেন দু’জন উপ-প্রধানমন্ত্রী। তারা নেপালি কংগ্রেসের প্রকাশ মান সিংহ ও মি. ওলির দলের (সিপিএন-ইউএমএল) বিষ্ণু প্রসাদ পাউডেল। আগের দু’জন মন্ত্রী বহাল আছেন। তারা হলেন ভূমিমন্ত্রী বলরাম অধিকারী ও বাণিজ্যমন্ত্রী দামোদর ভান্ডারি।
ইউএমএল-এর বিদ্যা ভান্ডারিকে দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টির শারদ সিং ভান্ডারি শ্রমমন্ত্রী, জনতা সমাজবাদী পার্টি নেতা নওল কিশোর শাহ নারী শিশ ও প্রবীণ মন্ত্রী ও প্রদীপ যাদব পানীয়-জলমন্ত্রী হয়েছেন। দুই দলের চুক্তি অনুসারে কংগ্রেস ১১টি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবে। দেখা যাচ্ছে জোটের বিভিন্ন দল সরকারে স্থান পেয়েছে। আর বড় ভূমিকায় আছেন কংগ্রেসের নেতারা। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হবে বলেও জানাচ্ছে হিমালয়ান টাইমস অনলাইন। দুই প্রধান দলের ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি অনুযায়ী দুটি দলের প্রার্থী কেপি শর্মা ওলি ও মি. শের বাহাদুর দেউবা ২০২৭ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১৮ মাস করে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা এই চুক্তিতে কতখানি বহাল থাকবেন বা মেনে চলবেন সেটা নিয়ে বিশ্লেষকদের নানা মত আছে। তবে তা দেখার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। বিদায়ী সরকার মেয়াদ পুরো করতে পারেনি, নেপালে অনেক সরকারই তা পারেনি।
নেপালে চীন ও ভারতের মধ্যে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব পরিবর্তনে তাদের প্রভাব বা ইশারা ইঙ্গিত থেকে থাকবে। নেপালে অর্থনৈতিক সঙ্কট রয়েছে। কোভিডসহ নানা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছে দেশটি। কোভিড-পরবর্তী সময়টিতে সেই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দেশটি। জিনিসপত্রের দাম, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এর প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশটিকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করাচ্ছে। দুই ভিন্ন জোটের প্রধান দুই দলের বর্তমান মিলিঝুলি সরকার কত দিন থাকতে পারবে বলা মুশকিল। আপাতত নতুন সরকারের আস্থার সঙ্কট খুব একটা হবে না, কারণ পার্লামেন্টে তাদের দুই দলের এমপির সংখ্যা অনেক। তবে রাজনীতির মাঠে পরস্পরের মুখোমুখি ছিল যারা এতদিন, দুই মেরুর দুই দলের এই ‘ঐক্য’ কেমন হবে আর কতদিন টিকবে সেটা আগামীর দিনগুলোই বলে দেবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা