২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাকস্বাধীনতার চরম সঙ্কটে বাংলাদেশ

বাকস্বাধীনতার চরম সঙ্কটে বাংলাদেশ - ছবি : সংগৃহীত

বাক-স্বাধীনতা মানুষের সভ্যতার নিদর্শন। ভাষা আছে বাক-স্বাধীনতা নেই, সেই ভাষা মূল্যহীন। গণতন্ত্র আছে, বাক-স্বাধীনতা নেই, সেই গণতন্ত্র মৃত।

মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা যদি রক্ষিত না হয় তাহলে অশুভ শক্তির বিকাশ দৃশ্য-অদৃশ্য সব স্তরে ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে, অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা করে নেয়; যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে। এজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষের চিন্তার অধিকার রক্ষা করা।

বাক-স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর দশটা গণতান্ত্রিক অধিকারের মতো নয়, এটি গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি। এটি গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। তাই এই অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া, সংরক্ষণ করা ও তাকে বিকশিত করা রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশের আইন দ্বারা এবং জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বলবৎযোগ্য। রাষ্ট্র এটা রক্ষায় ব্যর্থ হলে বুঝে নিতে হয়, সে নিজের প্রধান কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাক্‌-স্বাধীনতার মধ্যে কথা বলা,কথা শোনার অধিকারও রয়েছে; তথ্য পাওয়া, চাওয়া, আলোচনা ও বিতর্ক করাও এর মধ্যে পড়ে। সে কারণে এটি সর্বজনীন অধিকার, শুধু একক ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশের অধিকার নয়। বাকস্বাধীনতা হল এমন একটি নীতি যা প্রতিশোধ, সেন্সরশিপ বা আইনি অনুমোদনের ভয় ছাড়াই একজন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের তাদের মতামত এবং ধারণা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত করা হয়েছে । বাংলাদেশসহ অনেক দেশে সাংবিধানিক আইন আছে যা বাকস্বাধীনতা রক্ষা করে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, 'প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।' এরপরও অনেক দেশে বাক স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে।

বাকস্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্ট শাসকরা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই মূলত বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়। বাকস্বাধীনতা থাকলে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন দু'দিন আগে হোক বা দু'দিন পরেই হোক ঘটতে বাধ্য। এতে তাদের স্বৈরশাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে । বাকস্বাধীনতা দুর্নীতিবাজ, লুটেরা গোষ্ঠীসহ অশুভ শক্তির পছন্দের নয়। কারণ বলার অধিকার ও লিখার অধিকার না থাকলে অপকর্মগুলো করা সহজ হয়।

বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে চরম সঙ্কটে আছে বাক-স্বাধীনতা নিয়ে। বাক-স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় মানুষকে এখন খুবই ভেবেচিন্তে কথা বলতে হচ্ছে। পরিস্থিতির কারণে মানুষ নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। কিছু লিখলে বা কোনো কথা বললে সরকারের বিরুদ্ধে যায় কিনা, বক্তব্য কোনোভাবে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যায় কিনা, সরকার দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে যায় কিনা, মুজিব পরিবারের বিরুদ্ধে যায় কিনা, সরকারি দলের নেতার বিরুদ্ধে যায় কিনা, সেই ভাবনা এখন বড় শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

সমালোচনার সীমারেখা এমনভাবে টেনে দেয়া হয়েছে যে, কিছু রাজনীতিকের নাম মুখেও আনা যাচ্ছেনা। তাদের সমালোচনা মানেই চৌদ্দশিকের ভাত খেতে হবে। তাদের সময়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা। তাইতো নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন : 'বাক-স্বাধীনতা প্রকৃত পক্ষে মানব স্বাধীনতারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারা, অন্যের কথা (মতামত) শুনতে পারার সক্ষমতা; এটি হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্যবান হওয়ার কেন্দ্রীয় কারণ ।' আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই উপলব্ধি আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি।

বাংলাদেশে সমালোচনার করতে গিয়ে মানুষ জেলে যাচ্ছেন, গুম হচ্ছেন। ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সরকারের অসহিষ্ণু অবস্থান বাক-স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। সরকারের নানান পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেখানে অনেকেই মুক্তভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারছেন না । এ এক শ্বাসরোধী পরিস্থিতি ।

মানব জমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সম্প্রতি 'অজানা ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন । ওই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন : 'আমি নিজেই অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। লিখলে ভয়, না লিখলে বাহবা। শেষের পথটা কখন যে আমি বেছে নিয়েছি। আমার হাত কি কেউ বেঁধে দিয়েছে? না এটা সত্য নয়। আমি অগোচরে নিজের হাত নিজেই বেঁধে নিয়েছি । খুলতে গিয়ে দেখছি, কোথায় যেন গোলমাল হয়ে গেছে ।'

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : 'লিখছি না এমন অনেক ইস্যু রয়েছে। অনেক ইস্যুতে লেখা উচিত। যেমন ধরেন গত নির্বাচন। এছাড়াও আরও ছোট নির্বাচনগুলো নিয়ে লেখা উচিত । যা লিখছি না। বলা উচিত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লিখতে পারছি না।'

লিখবেনই বা কী করে! বর্তমান সরকারের সময় মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৮০টির বেশি মামলা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ২১টি। মানহানির মামলাগুলোর মধ্যে ৫১টিতে এক লাখ ২২ হাজার ৪৭০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার মানহানি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

একইভাবে বেশ কিছু মামলা ঝুলছে মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে । প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের পর তো বলা ও লেখা তিনি অনেকটা বন্ধই করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতার কতটা নাজুক অবস্থায় আছে তার চিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কলামিষ্ট প্রফেসর ড. আসিফ নজরুলের লেখায় ফুটে উঠেছে। তিনি 'কী কী লেখা যাবে না' শিরোনামের এক প্রবন্ধ লিখেছেন, 'একটা সময় ছিল, পত্রিকার কলাম লিখতে বসলে মন খুলে লিখতাম। যা লিখতাম তাই ছাপানোও হতো। আর এখন লেখার আগে ক্লান্তিময় লড়াই চলে নিজের ভেতর। কী লিখলে মামলা হতে পারে, কী লিখলে অপপ্রচার বা আরও নানা সমস্যা সেটা নিয়ে চিন্তা করে করে বিমর্ষ হই। না ছাপানো গেলে শুধু শুধু লিখে লাভ কী—এটা ভেবে থেমে থাকি মাঝেমধ্যে।'

তিনি প্রবন্ধ আরো পরিষ্কার করে বলেন, 'আমার ধারণা, অন্য অনেকেরও একই অবস্থা। যাঁদের লেখা আমি পাঁচ–সাত বছর আগেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়তাম, তাঁদের অনেকে বিবর্ণ ও পানসে হয়ে গেছেন তাই। আমাদের বাক্‌স্বাধীনতা শুধু নয়, চিন্তার চর্চাও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। মনে মনে ঠিক করি কী লিখব, কী লিখতে পারি না। কী কী লিখতে পারি না তার তালিকা বিশাল। বিষয় হিসেবে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণও। রাখঢাক করে তার একটা তালিকা দিই।'

দ্য নিউ এজ এডিটর নুরুল কবির দৈনিক প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'একটি দেশে চিন্তা প্রকাশের অবারিত স্বাধীনতার যে গণতান্ত্রিক সুযোগ থাকা দরকার, তা নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক, আইনগত ও প্রশাসনিক—সব ধরনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ সরকার ভয়ের একটি পরিবেশ তৈরি করেছে। সংবাদমাধ্যম ও নাগরিকের মতপ্রকাশ করার ক্ষেত্র যতটা সংকুচিত করা সম্ভব, তার প্রায় পুরোটাই তারা করতে পেরেছে। এমন অবস্থায় কোনো একটি পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি যদি নিশঙ্কও হয়, সেটিও বাস্তবায়ন করা কঠিন।'

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সরকার নজিরবিহীনভাবে বাক-স্বাধীনতার উপর আঘাত হেনেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। আগের সরকারগুলো ‘সমালোচক' পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিত কিংবা বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিত । এ সরকারের সময় দেখা গেল, দেশের প্রধান দু'টি পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি টেলিফোন কোম্পানি, ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি করা হয়েছে সরকারি গোপন নির্দেশে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজটি হচ্ছে ভিন্নমতের পত্রিকা বন্ধ করে দিচ্ছে নানা অজুহাতে ।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। সার্কুলেশন ছিল প্রচুর। সরকারের সমালোচনা করত বলেই পত্রিকাটি বন্ধই করে দেয়া হলো। সম্পাদককে জেলে ঢোকানো রিমান্ডের পর রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হলো। আদালতে হাজিরা দিতে গেলে সেখানে সরকারের লেলিয়ে দেয়া ক্যাডাররা আদালত প্রাঙ্গণে তার রক্ত ঝরালো । এমনকি পত্রিকার অফিস রহস্যজনক আগুনে ছাই হয়ে গেল। জীবন বাঁচতে নিরুপায় হয়ে তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো! যার ফলে অনেক সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম শিল্পে একটা ভীতির সঞ্চার তৈরি হলো।

আমার দেশ বন্ধ হওয়ার পর সরকারের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছিল দৈনিক দিনকাল। ঠুনকো অজুহাতে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সিএসবিসহ অনেক গণমাধ্যম।

টিভি টকশোতে কেউ মন খুলে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। যারা সাহস করে সত্য কথা বলেন, তাদের পরে আর টকশোতে ডাকা হয় না । এক সময় টকশো ঝড় তুলতেন নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুলরা। এখন তাদের আর টকশোতে দেখা যায় না। মানে তাদের ডাকা হয় না।

শুধু নিপীড়ন চালিয়েই নয়, বিভিন্ন ধরণের কালা কানুন করে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে ভয়ঙ্কর এক কালাকানুন করে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়।এই আইনে সাংবাদিক ও ভিন্নমতের লোকজনের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। দুনিয়াজুড়ে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে এই বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে অন্য একটি আইন করে সরকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নের সব ধারা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই আইনটিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাংবাদিক ও ভিন্নমতের মানুষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে সামনে আসে।

শুধু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টই নয়, এ ধরণের অনেক গুলো আইন রয়েছে যে গুলোর মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা হরণ করা যায়। এরমধ্যে রয়েছে ১. পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২. ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩. অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪. আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫. প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬. প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭. সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯. ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১. ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২. (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।

এই মুহূর্তে, নিপীড়নমূলক আরো তিনটি খসড়া আইন পাইপলাইনে রয়েছে- একটি তথ্য সুরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তৃতীয়টি মিডিয়া কর্মীদের পরিষেবার শর্তগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তথ্য সুরক্ষার জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছ,এর বিপজ্জনক অংশটি হলো এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এর ফলে তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সমস্ত অধিকার লঙ্ঘন করে, যে কোনো উপায়ে ব্যক্তিগত উপাত্ত স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবে।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য খসড়া আইনটি শৈল্পিক সৃজনশীলতা এবং চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করে প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়া আইনটি গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির অবস্থার উন্নতি ঘটাতে তৈরি করা হয়েছে বলে বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি ঠিক তার বিপরীত কাজটি করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আড়িপাতা প্রযুক্তি এবং ট্র্যাকিং ডিভাইস দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করছে এবং সেটি অসহনীয় ও বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। এই বিষয়গুলো সাংবাদিক সংগঠনগুলো বিশেষ করে বিএফইউজে ও ডিইউজে বার বার তুলে ধরেছে। ঢাকার সাংবাদিকদের চেয়ে মফস্বল সংবাদদাতাদের মধ্যে অনেকেই বেশি মাত্রায় নজরদারির শিকার হচ্ছেন।তারা আরও সরাসরি এবং আরও স্থূলভাবে হুমকি-ধমকির শিকার হন। এমনও ঘটনা ঘটেছে বিরোধী রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের ডেকে পাঠানো হয় এবং তাদের সাথে কী কথা হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। কখনও কখনও, তথ্য সরবরাহকারী বা সোর্সদের ডেকে কর্মকর্তাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে সতর্ক করা হয়। যে লোকদের কর্তৃপক্ষ নিশানা করে বিব্রত করতে চায়, তাদের অনেকের ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ পাবলিক ডোমেইনে মাঝে মাঝে ফাঁস হয়ে যায়। এটি প্রমাণ করে, কর্তৃপক্ষ তার সমালোচনাকারী ও বিরুদ্ধমতের লোকদের টেলিফোনে আড়ি পাতার বিশদ জাল বিছিয়ে রেখেছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পুলিশ আটক করার পর ওই সময় তার এক নারী সহকর্মী এবং তার (ওই সহকর্মীর) বাবার মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথন হয়েছিল। ওই কথোপকথনে রোজিনা ইসলাম প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য ছিল। সেই কথোপকথন কে বা কারা ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়। রোজিনার ভাবমূর্তিকে খারাপভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে এটি ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছিল। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, রোজিনা এবং তার সহকর্মী—উভয়ের ফোনই ট্যাপ করা হয়েছিল।

এখানে থেমে নেই, আদালতকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার বক্তব্য দেশের কোনো মিডিয়ায় প্রচার করতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এটি তার সাংবিধানিক অধিকার।

নিপীড়নমূলক এসব আইন কিভাবে বাক স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের জন্য কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত এক সেমিনারে সেটি তুলে ধরেন, প্রথম আলোর হেড অব কনটেন্ট (ইংরেজি ওয়েব) আয়েশা কবির। সেমিনারে তিনি বলেন, 'সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে এমন কিছু দমনমূলক আইন আছে, যার কারণে সাংবাদিকতা সব সময় ভয় ও চাপের মধ্যে থাকে। যে কাউকে যেকোনো সময় পথ থেকে তুলে নেওয়া হতে পারে। যে কারও পরিবার হয়রানির শিকার হতে পারে। এসব ভয় ও চাপের মধ্যে থাকার কারণে সাংবাদিকতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বনিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে।'

প্রথম আলোর অপরাধ রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান রোজিনা ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ওই সেমিনারে বলেন, কোভিডের সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর পরও তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে, তাঁকে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তাকে নিয়মিত আদালতে হাজির হতে হয়। পাসপোর্ট আটকে রেখে দেশের বাইরে তার যাওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। যা মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।'

গত ১৫ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোকে তো কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে পালন করতে দেয়া হয়নি। এমন কি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরও বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তারা যখনই কথা বলতে চেয়েছে তখনই বল প্রয়োগ করে তাদের কন্ঠ স্তব্দ করে দেয়া হয়।

সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দাবি নিয়ে নয়, তারা সড়কে জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। নির্যাতন চালিয়ে তাদের কন্ঠকে স্তব্দ করে দেয়া হয়। সরকারি চাকরিতে নজিরবিহীন ভাবে ৫৬ ভাগ চাকরি হয় বিভিন্ন কোটায়। ফলে মেধাবীরা চাকরিবঞ্চিত হচ্ছে। কোটা বাতিলের দাবি শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে বল প্রয়োগ করে তাদের আন্দোলন থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। এবারও তারা আন্দোলনে নেমেছে। আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার জন্য নানান হুমকি ধমকি-ধামকি দিচ্ছে সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতা ও প্রশাসনের লোকেরা।

শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শহিদুল আলম। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।

লেখক মুশতাক আহমদ সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে লিখতেন। করোনাকালের অসঙ্গতি নিয়ে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় সরকার। র‍্যাব দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়।এরপর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখানো হয়। কারাবন্দী অবস্থায় নির্যাতনে লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান। তিনি বারবার জামিন চেয়েও পাননি। নিজের জীবন দিয়েই তাঁকে জামিন নিতে হয়েছে।

২০২০ সালের ৬ মে করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে র‍্যাব তাকে গ্রেফতার করে৷ তার সাথে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকেও গ্রেফতার করা হয়। ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়৷
মামলায় রাষ্ট্রচিন্তার সংগঠন দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান৷ মুশতাক ও কিশোরের পক্ষে বেশ কয়েকবার জামিনের আবেদন হলেও আদালতে তা মঞ্জুর হয়নি৷

মামলাটিতে আসামির তালিকায় আরো ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক, সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান (আল জাজিরার প্রতিবেদনের স্যামি), আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার৷ তদন্তের পর পুলিশ শুধু মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়৷ বাকি আট আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা৷

র‍্যাবের করা এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ফেসবুক ব্যবহার করে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস মহামারি সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায়ে অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি ছড়ানো, অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারার অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে কিশোর ও মুশতাকের সাথে তাসনিম খলিল, জুলকারনাইন সায়ের খান, শাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দিনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ’ পাওয়ার দাবিও করেছিল র‍্যাব৷

বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। তাই তারা গনতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী সবাই বাক স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন।

মার্কিন তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন যিনি দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। গণমাধ্যম নিয়ে তার বিখ্যাত উক্তিটি ছিল, ‘যদি কোনো সমাজে মিডিয়া ও সরকারের মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়, মুক্তমনের মানুষদের সুস্থ পছন্দ হিসেবে বেছে নিতে হবে মিডিয়াকে।’ কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন যে, ‘সংবাদ মাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ। ‘সাংবাদিকের কলম যত মুক্ত হবে সমাজ তত উপকৃত হবে। তিনি শুধু এটি মুখেই বলেননি, এটি কার্যকর করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন।

মিডিয়াকে সরকারসহ সব প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এতে বলা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে এমন কোনো আইন কখনো মার্কিন কংগ্রেসে পাস করবে না। সংবিধানে যুক্ত এই আইনটি 'মার্কিন মিডিয়ার রক্ষাকবচ’।

মার্কিন নীতি হচ্ছে- শ্লীলতা, অশ্লীলতা, নৈতিকতা, ধর্মীয় অবমাননা- কোনো অজুহাতেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা যাবে না।

মার্কিন আদালতও সবসময় বাক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা আমি তুলে ধরছি।আমেরিকার ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি রবার্ট এইচ জ্যাকসন বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলা পরিচালনা করেন। এর একটি হচ্ছে : ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেট বোর্ড অব এডুকেশন বনাম বার্নেট।’ এ রাজ্যের স্কুলগুলোতে বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকাকে শিক্ষার্থীরা কপালের হাত তুলে অভিবাদন জানানো। জেহেভো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক শিক্ষার্থী জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। মামলা রায় হয় ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি জ্যাকসনের কোর্টে। জ্যাকসন শিক্ষার্থীর পক্ষে রায় দেন।

রায়ে তিনি বলেন : রাষ্ট্রের তৈরি আইনের চেয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা বা ইনডিভিজুয়্যাল লির্বাটি বড়। ওই সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো কিছুকেই সালাম করে না। সুতরাং তাকে দিয়ে জাতীয় পতাকা অভিবাদন জানাতে বাধ্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি সংবিধানে বাক স্বাধীনতার ধারাটি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশে এখন ক্ষমতাসীনদের কারো নামে কিছু বললে বা লিখলেই মানহানির মামলা হয়। ঠুকে দেয়া হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা। যেতে হয় জেলে অথবা ঘুরতে হয় আদালতের বারান্দায় বারান্দায়। এমন নজির দুনিয়ার কোথাও নেই।

ছোট একটা উদাহরণ দেই : ৬০-এর দশকের মুম্বাইয়ের একজন খ্যাতিমান কলাম লেখিকা প্যাট শার্প। বেঙ্গলিতে প্রকাশিত একটি কলামে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। তিনি লিখেছিলেন: বাঙালিদের আর একমাত্র বীর সুভাষ চন্দ বসু একজন দেশদ্রোহী, যিনি জাপানের পক্ষে একজন মীরফাজর ছিলেন, কিন্তু তা সত্তেও তাকে শহীদের সম্মান দেয়া হয়, প্রতি বছর মৃত্যু দিবসে। নেতাজির পরিবার এ মন্তব্যে দারুণ ক্ষুব্ধ হন। শরৎ চন্দ্র বাবুর ছেলে শিশির বসু কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্যাটন শার্পের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। প্যাটের সাজা হয়। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ আপিলটি খারিজ করে দিয়ে রায়ে মন্তব্য করেন ‘আইনের দৃষ্টিতে সুভাষ চন্দ্রের ভাইপো একজন বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং মামলাটি একজন মৃত ব্যক্তির মানহানির জন্য দায়ের করা হলেও তা আইনে অচল নয়। দেশবাসী সুভাষ চন্দ্রকে স্মরণ করার কারণে তিনি তাদের একজন জনপ্রিয় নেতা। তাঁকে দেশদ্রোহী বা মীরজাফর আখ্যায়িত করে আপীল আবেদনকারী নিজেকেই অপমানিক করেছেন।'

ওই আপলি মামলার রায়ে বলা হয় : ভাব ও মতামত প্রকাশে সংযম দরকার। কিন্তু তাই বলে মতপ্রকাশ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার রাষ্ট্র বাধা দিতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকরা যখন আইনি ও আইন-বহির্ভূত নানামুখী বাধা ও হস্তক্ষেপের সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি দৃষ্টান্ত বিশ্ব মিডিয়ায় কর্মীদের নজর কেড়েছে। (এক) ভারতের সাংবাদিক বিনোদ দুয়ারের বিরুদ্ধে বিজেপির এক নেতার দায়ের করা দেশদ্রোহের মামলা খারিজ করে দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিমকোর্ট। আদালত বলেছেন : ১৯৬২ সালে নির্দেশিকা অনুযায়ী দেশদ্রোহের মামলায় প্রত্যেক সাংবাদিকের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কেননা সরকারের সমালোচনা কোনভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্য যেমনও বড় ধাক্কা, তেমনি সাংবাদিকদের জন্য স্বস্তির খবর।

(দুই) যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (৫ জুন ২০২১ তারিখে) এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশনা অনুসারে দীর্ঘদিনের চর্চায় পরিবর্তন এনে বিচার বিভাগ তথ্য ফাঁসের তদন্তে সাংবাদিকদের তথ্যদাতার তথ্য জানতে আইনি বাধ্যবার্ধক্যতায় ফেলার চর্চা ভবিষ্যতে অনুসরণ করবেন। সিএনএনের খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের এই নির্দেশনা আসার আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় বিচার বিভাগ নিউইয়র্ক টাইমস-এর চার সাংবাদিকের ই-মেইল তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। জো-বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও এই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। যদিও গুগলের অনড় অবস্থানের কারণে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক দিয়ে বিশ্ব এগুলেও আমরা'যে তিমিরে ছিলাম, সে তিমিরেই রয়ে গেলাম'। বরং আগের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থানে যাচ্ছি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে পেছাতে পেছাতে এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও স্থান ঠেকেছে তলানিতে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। এই সরকারের ১৫ বছরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ৪৪ ধাপ পিছিয়েছে।শুধু তা-ই নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হন্তারক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের নাম।

বাকস্বাধীনতা ও গণধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সাংবাদিকদের আআন্দোলন শেষই হচ্ছে না। পাকিস্তান আমলেও 'গণতন্ত্র', 'বাক স্বাধীনতা'এবং 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতার' জন্য লড়েছি; এখনো লড়তে হচ্ছে। লাখো শহীদের রক্তে নতুন দেশ হয়, স্বপ্ন পূরণ হয় না। সরকার যায়, সরকার আসে অন্ধকার যেন কাটে না। মাঝে মাঝে আঁধারে আলোর রেখা দেখা গেলেও আবার ঢেকে যায় অন্ধকারে। এখানে স্বৈরাচার যায়, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র থাকে। এখানে ফ্যাসিস্ট যায়, কিন্তু ফ্যাসিবাদী কাঠামো থাকে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকদের সংগ্রামের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখবো ১৯৬৩ সালে তৎকালীন সরকার একটা প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অধ্যাদেশ জারি করেছিল। এর বিরুদ্ধে পুরো পাকিস্তানের সাংবাদিকমহল ফুঁসে উঠেছিল। প্রেস অধ্যাদেশ বাতিল, সকল প্রেস আইনের সংস্কার, ঢাকার তিনটি দৈনিক পত্রিকার কালো-তালিকাভুক্তি বাতিল এবং গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকদের মুক্তি এমন দাবিদাওয়াসহ পুরো পাকিস্তানে তখন সাংবাদিকরা হরতাল পালন করেন। তবে সে সময় কাউকে গ্রেফতারও হতে হয়নি,কারো নামে মামলাও দেয়া হয়নি।

১৯ সেপ্টেম্বরের পাকিস্তান অবজারভার লিখেছিল, খাইবার পাস থেকে চট্টগ্রাম সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে এই ‘কালাকানুনের’ বিরুদ্ধে আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছে। ঢাকায় সাংবাদিক সমাবেশে মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান বলেন, আমার এই বয়স ও শারীরিক অবস্থাতে বিছানায় শুয়ে থাকার কথা, কিন্তু দেশে যা হচ্ছে তা আমাকে উঠে দাঁড়াতে ও আওয়াজ তুলতে বাধ্য করছে। এই আইন কেবল সংবাদমাধ্যমকে শেকলে বাঁধেনি, বরঞ্চ পুরো জাতিকেই শেকল পরিয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে সাংবাদিকরা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে সংবাদপত্রে নিয়োজিত ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক, কর্মচারী ও প্রেস কর্মচারী এবং হকাররা অংশ নেন। সমাবেশ শেষে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের একটি দীর্ঘ মিছিল বের হয়।মিছিলকারীরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পূর্ণ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, দেশ রক্ষাবিধি, প্রেস অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালা কানুন বাতিল, সংগ্রামের মাঝে পূর্ব-পশ্চিম এক হও, নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশ প্রত্যাহার, ইত্তেফাক ছাপাখানার বাজেয়াপ্তি প্রত্যাহার, রাজ বন্দীদের মুক্তির দাবিতে গভর্নর হাউজের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।’

১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং আন্দোলনে সমর্থনে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় একটি সভা ও মিছিলের ঘোষণা দেন। প্রতিবাদ সভাটি ১৫ জানুয়ারি বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। ড. এনামুল হকের সভাপতিত্বে জয়নুল আবেদিন, আহমদ শরীফ, সুফিয়া কামাল, সিকানদার আবু জাফর, কে জি মোস্তফা, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন বক্তব্য রাখেন।

এ সভাকে কেন্দ্র করে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারত্রে বলা হয়, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। সকল উন্নত জাতির বিকাশের মূলেই রয়েছে এই অধিকারের নিশ্চয়তা। সে কারণেই প্রতিটি উন্নতিকামী স্বাধীন জাতিই চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাণেরও অধিক মূল্যবান বলে মনে করেন এবং তা সংরক্ষণের জন্য কোন ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধাগ্রস্ত হন না। পক্ষান্তরে এও লক্ষণীয় যেকোনো জাতিকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে তাদের শাসকবর্গ চান প্রথমেই সে জাতির চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে দিতে। এ উদ্দেশ্যে শাসকবর্গ জাতির চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিতে এমন ষড়যন্ত্র নেই যার জাল বিস্তার করতে ইতস্তত বোধ করেন, এমন কোনো সরকারি মাধ্যম নেই যার সাহায্য সক্রিয় হয়ে উঠতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেন। আমাদের বেলাতেও বিগত বাইশ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে, সরকার স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ করে এই প্রদেশের জনসাধারণের কণ্ঠ রোধ করা এক প্রধান নীতি হিসাবে অনুসরণ করে চলেছেন। কুখ্যাত প্রেস ও পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেয়ার যে স্বেচ্ছাচারী নজির স্থাপন করা হয়েছে, তা শুধু ব্রিটিশ শাসন নীতির সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। এই অর্ডিন্যান্স জারী করার পূর্বেই স্বাধীনতা লাভের পরপরেই পূর্ব বাংলার সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করা হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত প্রকাশনা ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধের খাঁড়া সমানভাবে ঝুলে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরের যে কোন কর্মচারীর মাধ্যমে লিখিত, অলিখিত যে কোন উপায়ে ‘প্রেস উপদেশ’ ও সংবাদ বিশেষের উপর ‘এমবার্গো’ জাতীয় ব্যবস্থার সাহায্যে জনমতের স্বাধীনতার উপর হামলা। অন্যদিকে জনসাধারণের অর্থে পরিচালিত রেডিও এবং টেলিভিশন সরকার সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব প্রচারযন্ত্ররূপে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। সকলের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ রেডিও, টেলিভিশনে তো নেই-ই, এমনকি এইসব প্রচারযন্ত্রে স্বাধীনভাবে শব্দও ব্যবহার করা যায় না।

এরই পাশাপাশি রয়েছে গ্রন্থ প্রকাশের ওপর সরকারের ধারাবাহিকভাবে অনুসৃত দমননীতি। স্বাধীনতার পর এ প্রদেশে সরকার যে একে একে কত বই বাজেয়াপ্ত করেছেন, তার হিসাব নেই। বিশেষ করে সম্প্রতি সেই কুখ্যাত প্রেস ও পাবলিকেশন্স-এর কালাকানুনের সাহায্যেগ্রন্থ বিশেষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে, কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি এবং কোনো বই আটক ও বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমে সরকার নতুনভাবে চিন্তা ও মত প্রকাশের কণ্ঠরোধে তৎপর হয়ে উঠেছেন। বস্তুত স্বৈরাচারী শাসকবর্গের নিকটও একটি জাতিকে অবদমিত রাখার জন্যে এটাই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা। তাই এ মুহূর্তে লেখকদের স্বাধিকার সংরক্ষণ এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের ওপর যে কোন প্রকারের হামলার প্রতিরোধে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। শেষবারের মতো এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে, আমরা স্বাধীন জাতি এবং আমাদের চিন্তা ও মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ আমরা যে কোন মূল্যে প্রতিরোধ করবো এবং এই অনাচারকে আমরা কিছুতেই কায়েম থাকতে দেবো না।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ‘সংগ্রামী ছাত্রসমাজ’ পক্ষ থেকে এগার দফার দাবি জানানো হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফাতে বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উল্লেখ করা হয়।এতে বলা হয়, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে।দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রামের কমিটির আহবানে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র ও গণহত্যা, সহকারী নির্যাতন ও ব্যাপক হারে গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ‘…দেশরক্ষা আইন ও নিরাপত্তা আইন বাতিল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান, ইত্তেফাক ও অন্যান্য সংবাদ পত্রের উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রদানের দাবি জানানো হয়।'

১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে পল্টনে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় কিছু প্রস্তাবলী গৃহীত হয়। সেখানে ‘শপথ প্রস্তাব’-এ বলা হয় : ‘এই সমাবেশ ঘোষণা করিতেছে যে, স্বৈরাচারী একনায়কত্ববাদী আইয়ুব সরকারের অবসান ঘটাইয়া অবিলম্বে সারা পাকিস্তানের সকল জনগণের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম.সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা কায়েম, সকল দমনমূলক আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে।’

১৯৬৯ সালের এপ্রিলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি কর্তৃক ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি পেশ করা হয়। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেনন। কর্মসূচির রূপরেখাতে বলা হয়, ‘জনগণের বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা প্রদান করা হইবে।’

১৯৬৯ সালের আগস্টে প্রচারিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’ অনুচ্ছেদে বলা হয়: ‘…মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ও প্রচারপত্র মুদ্রণ ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, সমবেত হইবার ও সংগঠন করিবার পূর্ণ স্বাধীনতা এবং দেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা থাকিতে হইবে।

১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ১১-দফা কর্মসূচি সম্পর্কিত একটি প্রচারপত্রের ৩ নম্বর দফাতে ছিল : ‘জনগণের সকল প্রকার মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতাদর্শের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হইবে’।

১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ১৪ দফা দাবি জানায়। সেখানেও ৪র্থ দফাতে ছিল : ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা, নিজ বিবেক অনুযায়ী দল, সংঘ-সংগঠন গঠনের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারের পূর্ণ গ্যারান্টি থাকিতে হইবে'।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে যে ইশতেহার পাঠ করা হয় সেখানে তিনটা লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়। তৃতীয় লক্ষ্যে স্পষ্টত বলা হয়েছে: ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে’।

ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালে, আমরা দেখি ৬০ বছর আগে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরীরা যে অভিযোগ গুলো করেছিলেন সে সঙ্কট এখনো রয়ে গেছে। বরং এখন আরো প্রকট হয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য স্বাধীকার আদায়ের জন্য দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে স্বাধীনতা আনলে ও স্বাধীনতা অর্জনের অল্প সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র ,বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। সকল দল বাতিল করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়। ৪টি মাত্র পত্রিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সকল সংবাদপ বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে দেশে আবারো স্বৈরশাসক কায়েম করা হয়।

শুধু তা-ই নয়, সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রেও জনগণের স্বপ্ন,ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া' পাওয়াকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানে কিছু শব্দ ব্যবহার করে জনগনের ন্যায় সঙ্গত অধিকার কেড়ে নেয়ার পথ বাতলে দেয়। ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা’ শীর্ষক ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেয়া হলেও বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে করা হয়েছে শর্তাধীন। ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’ ‘বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’, ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘শালীনতা’, ‘নৈতিকতা’, ‘অবমাননা’ ও ‘মানহানি’ এই শব্দাবলী এতোই আপেক্ষিক ও রাষ্ট্রীয় প্রদত্ত সংজ্ঞা-নির্ভর যে এগুলোর সাপেক্ষে যদি কথা বলতে বা লিখতে হয় তাহলে যা থাকে সেটাকে কোনোমতেই ‘বাক-স্বাধীনতা’ বলা যায় না।

এটা সত্য যে, মুক্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ না হলে মুক্ত সাংবাদিকতা যেমন করা যায় না, তেমনি বাক স্বাধীনতা হয় ভুলুন্ঠিত। তাই গণতন্ত্রের সঙ্কটই বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement