হিন্দুত্ববাদের দর্পচূর্ণ
- মাসুম মুরাদাবাদী
- ২৫ জুন ২০২৪, ০৫:৫৮
![](https://www.dailynayadiganta.com/resources/img/article/202406/844803_112.jpg)
সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির দুর্বল কর্মদক্ষতার পর সঙ্ঘ পরিবারে শুরু হওয়া লড়াই থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যর্থতায় বিজেপি নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। আরএসএস বিজেপি নেতাদের অহমিকা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকে এর জন্য দায়ী করেছে। মূলত হিন্দু ভোটারদের প্রতি বিজেপির সব প্রার্থী এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, রামমন্দিরের মহামূল্যবান প্রাণপ্রতিষ্ঠা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভেল্কিবাজি সফলতার মালা তাদের গলায় পরিয়ে দেবে। এ জন্য তারা নিশ্চুপ বসে ছিলেন। কিন্তু যখন ফল সামনে এলো, তখন জানা গেল, না রামমন্দির তাদের কোনো কাজে এসেছে, না প্রধানমন্ত্রীর ভেল্কিবাজি কোনো চমক দেখাতে পেরেছে।
আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমার যেখানে বিজেপির ব্যর্থতায় অহঙ্কারীদের দায়ী করছেন, সেখানে স্বয়ং আরএসএস প্রধানও বিজেপিকে এক সাথে কয়েকটি উপদেশও দিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরএসএস সদস্যদের এ কথাও বলেছেন যে, ‘আামাদের সব ধর্ম ও ইবাদতকে (উপাসনা) সম্মান করতে হবে।’ এটি সেই আরএসএস যারা ইসলাম ও মুসলমানদের সব সমস্যার মূল অভিহিত করে আসছে। এটি প্রথমবার, বিজেপি ও আরএসএসের নেতারা জনসম্মুখে প্রকাশ্যে কথা বলছেন এবং একে অন্যের পাগড়ি টেনে খুলছেন। এতদিন এসব কিছু পর্দার আড়ালে হয়েছে এবং কেউ কারো বিরুদ্ধে বক্তব্য দেননি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জিব বালিয়ান মোজাফফর নগরে তার পরাজয়ে স্থানীয় বিজেপি পার্লামেন্ট সদস্য সঙ্গিত সোমকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। উত্তর প্রদেশে পরাজয়ে বিধ্বস্ত হওয়া অধিকাংশ বিজেপি প্রার্থী তাদের ব্যর্থতায় দলের মধ্যে চলা গৃহযুদ্ধকে দায়ী করেছেন। তারা সবাই একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন।
উত্তর প্রদেশে বিজেপির খারাপ কর্মদক্ষতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কারণ হচ্ছে, এ প্রদেশে অযোধ্যা, কাশি ও মথুরা- তিনটি অবস্থিত। যা বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মেরুদণ্ড। এবার বিজেপি হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে জয়ী করার মানত হিসেবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধের ঘোষণা করেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণগুলোতে অসংখ্যবার মুসলমানদের নিশানা করে কথা বলেছেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে তিনি সব সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী, বেশি সন্তান জন্মদানকারী এবং দেশের সম্পদ দখলকারী অভিহিত করেছিলেন। এ প্রচারণার একটিই উদ্দেশ্য ছিল, তিনি যেন হিন্দুদের বিজেপির পক্ষে এক করতে পারেন। তার ধারণা ছিল, এ গর্হিত প্রোপাগান্ডায় সব হিন্দুর ভোট তার ঝুলিতে পড়বে। কিন্তু যখন নির্বাচনী ফল সামনে এলো তখন হিন্দুত্ববাদীদের চেহারা মলিন হয়ে গেল। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বিজেপি সেই অযোধ্যাতেও নির্বাচনে হেরেছে, যেখানে রামমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে জয়ের পুরো স্থাপনা দাঁড় করানো হয়েছিল।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সবচেয়ে বড় স্লোগান ছিল রামমন্দির। জায়গায় জায়গায় পোস্টার সাঁটানো ছিল- ‘যিনি রামকে এনেছেন, আমরা তাকে নিয়ে আসব’। রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময় সারা দেশে যে পতাকা টাঙানো হয়েছিল, নির্বাচনের সময় সেগুলো ঝেড়ে মুছে নতুন করে টাঙানো হয়েছিল। অসম্পূর্ণ রামমন্দিরের উদ্বোধন করার উদ্দেশ্যই ছিল, এর ওপর ভর করে সব হিন্দুর ভোট বিজেপির ঝুলিতে পড়বে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। নিঃসন্দেহে রামমন্দির বিজেপির সবচেয়ে পুরনো অ্যাজেন্ডা। এটিও এক চরম বাস্তবতা যে, এটিতে ভর করেই বিজেপি সব রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে।
রামমন্দির ইস্যু সৃষ্টির আগে পার্লামেন্টে বিজেপির আসন থাকত দু’টি। বিজেপি রামজন্মভূমি মুক্তি আন্দোলন পুঁজি করে অস্বাভাবিক সফলতা অর্জন করে এবং তাদের আসন বাড়তে থাকে। আদভানির রথযাত্রা এ ব্যাপারে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। রামমন্দিরের শিলান্যাস ও বাবরি মসজিদ ধ্বংস বিজেপিকে এতটা শক্তিশালী ও কংগ্রেসকে এতটা দুর্বল বানিয়ে দিয়েছে যে, বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হলেন, তবে তাকে তার বিতর্কিত বিষয়াবলি পেছনে ফেলে দিতে হলো। রামমন্দিরের মতো ইস্যুকে কিছু দিনের জন্য অবশ্যই হিমাগারে চলে যেতে হলো। তবে ভেতর ভেতর তার প্রস্তুতিও চলতে থাকল। ২০১৪ সালে পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর বিজেপির সব ইস্যু ফিরে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে রামমন্দির। এ ব্যাপারে বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ একসময় বলেছিলেন, এক চেক বারবার ক্যাশ করা যায় না। যাই হোক রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক ও ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি এমন ইস্যু ছিল, যা বিগত শাসনামলে কার্যত তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে হিন্দুত্ববাদীদের মনে হয়েছিল, এখন হিন্দুরাষ্ট্র আর মাত্র কয়েক কদম দূরে।
রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠাকে সফল করতে বিজেপি তার সব শক্তি নিয়োগ করে। প্রশাসনের পুরো জনবল এতে যুক্ত করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সংবিধানের শপথ গ্রহণ সত্ত্বেও নিজেকে হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় ঠিকাদার প্রমাণ করতে কোনো ত্রুটি করেননি। রামমন্দির নির্মাণের পেছনে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে আগ্রহী ব্যক্তিদের মনে হয়েছে, এখন দেশ হিন্দুরাষ্ট্র হতে শুধু ঘোষণা হওয়ার ফাঁকটুকু বাকি রয়ে গেছে। যদি তৃতীয়বারও নরেন্দ্র মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু যখন নির্বাচনী ফল সামনে এলো, তখন হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নবাজদের চেহারায় গভীর হতাশা ছেয়ে যায়। কেননা, তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বিজেপির গায়ে মারাত্মক ধাক্কা লাগে। তার কারণ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তাদের আসন বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে গেছে। তাদের সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনিটা লেগেছে উত্তর প্রদেশে, যেখানে তারা ৮০টি আসনের ৮০টিতে জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। এখানে ওই ৮০টির মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসনে বিজেপি সফলতা লাভ করে এবং বেশির ভাগ আসন সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস জোটের ঝুলিতে পড়ে।
হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্গ অযোধ্যাতেও বিজেপি হেরে গেছে। শুধু তাই নয়, অযোধ্যার আশপাশের এলাকাতেও বিজেপির প্রার্থীদের পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়। যেই মাত্র অযোধ্যায় বিজেপির শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদ প্রকাশ্যে আসে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় এক তুফান বয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদের সমর্থকরা অযোধ্যার অধিবাসীদের গাদ্দার বলা শুরু করে দেয়। তাদের গালিগালাজ করতে থাকে। অযোধ্যা পরাজয় হিন্দুত্ববাদীদের মুখে চপেটাঘাতের চেয়ে কম ছিল না। মূলত বিরেধী নেতারা কিছু বিজেপি নেতার দেশের সংবিধান বদলের বক্তব্যকে বেশ আমলে নেয়। ফলে যাদের হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে এক করা হয়েছিল, তারা রিজার্ভেশন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে জর্জরিত হয়ে বর্ণ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিজেপিকে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হয়। ধর্ম রাজনীতির উল্টা ফল দেখা দেয়।
প্রধানমন্ত্রী হিন্দু ভোট সংগ্রহে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে বক্তৃতাবাজি করেছেন, তার উল্টো ফল প্রকাশ হয়েছে। হিন্দুরা বর্ণে বর্ণে বিভক্ত হয়ে যায়। আর মুসলমানরা ইন্ডিয়া জোটের পতাকাতলে এক হয়। হিন্দুত্ববাদের দর্পচূর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে এখন বিজেপির সমর্থকরাও এ কথা বলছেন, এ দেশে সবাইকে সাথে নিলে নির্বাচনে জেতা যায়। হিন্দুত্ববাদ এখন নির্বাচন জেতার উপযুক্ত নয়।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ
১৬ জুন,
২০২৪ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা